গ্যাসের মোয়াদোত্তীর্ণ দেনা পরিশোধের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল আগামী ৩০ জুন। তবে লক্ষ্যমাত্রার দুই মাস আগে মেয়াদোত্তীর্ণ সব দেনা পরিশোধ করেছে পেট্রোবাংলা। অথচ সরকারি-বেসরকারি বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) পাওনা ২৮ হাজার ৫৭২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এতে বেশ বিপাকে পড়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। পাওনা আদায়ে অনেকটা মন্থরগতিতে চলছে সংস্থাটি। সঠিক সময়ে পাওনা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছ থেকে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ সুদে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে পেট্রোবাংলা।

পাশাপাশি চেষ্টা করছে পাওনা টাকা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট মাত্রায় তোলার। এরই মধ্যে আর্থিক লেনদেনে বেশ গতিও এসেছে। পাওনা টাকা থেকে আদায় এবং বিপিসির ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিদেশী কোম্পানির বকেয়ার সব অর্থ পরিশোধ করেছে নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, পাওনা অর্থ আদায়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে হয়েছে বৈঠক। দেনায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধীরে ধীরে অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী মিলছে সাড়া, প্রতিমাসে পেট্রোবাংলাকে বকেয়ার অর্থ পরিশোধ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

তথ্য বলছে, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সরকারি খাতে বিদ্যুতে পাওনা ১২ হাজার ২২৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ক্যাপটিভ পাওয়ারে পাওনা ২০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, আদায় ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সার কারখানায় পাওনা এক হাজার ১৫১ কোটি ৩ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শিল্পে পাওনা ১২২ কোটি ৩৩ লাখ, বকেয়া আদায়ের হার ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বাণিজ্যিক খাতে পাওনা ৯ কোটি ৯৩ লাখ, বকেয়া আদায়ের হার শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ। আবাসিকে পাওনা ৩৬৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সিএনজি ফিড গ্যাসে পাওনা ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ১৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সবমিলিয়ে সরকারি এসব খাতে মোট পাওনা ১৩ হাজার ৯০২ কোটি ৬০ লাখ টাকা, আদায় হয়েছে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

বেসরকারি খাতসমূহের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদ্যুতে পাওনা ৭ হাজার ৪৩৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ১৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। ক্যাপটিভ পাওয়ারে পাওনা এক হাজার ৬০৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ৩৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। সার কারখানায় পাওনা ৯৩৬ কোটি ১০ লাখ টাকা, কোনো বকেয়া আদায় হয়নি। শিল্পখাতে পাওনা এ হাজার ৯০১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ৩৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পাওনা ১৬৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ১৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আবাসিকে পাওনা ২ হাজার ৮৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। সিএনজি ফিড গ্যাসে পাওনা ৫১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ৪২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। চা-বাগানে পাওনা ৩ কোটি ২ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ৪০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। মৌসুমি পাওনা ৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে গ্যাস বিল বকেয়া ১৪ হাজার ৬৭০ কোটি ২৩ লাখ টাকা, বকেয়া আদায়ের হার ২২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে গ্যাস বিল বাবদ পেট্রোবাংলার পাওনা ২৮ হাজার ৫৭২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ দুই খাত মিলিয়ে বকেয়া আদায় হয়েছে ১৫ দশমিক ৯২ শতাংশ।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান বলেন, আমরা গত তিন মাস ধরে বিদ্যুৎ এবং সারখাতে পেট্রোবাংলার ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মাধ্যমে দেওয়া গ্যাসের পাওনা বাবদ অর্থ নিয়মিত পাচ্ছি। আমরা পিডিবি এবং বিসিআইসির সার কারখানা থেকে বকেয়ার টাকা পাচ্ছি। পিডিবি এবং বিসিআইসি সারখাতে সরকারের কাছ থেকে বর্ধিত হারে ভর্তুকি পাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের টিমওয়ার্কের কারণে।

পেট্রোবাংলার উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তারিকুল ইসলাম খানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় মোট দেনা ছিল ৭৩৭ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮ হাজার ৭০২ কোটি টাকা)। এরপর বকেয়াসহ এ পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৭৩৯ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় ৪৫ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা) পরিশোধ করা হয়েছে।

পেট্রোবাংলা জানায়, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি), দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তি ও স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা এলএনজি সরবরাহকারী, দুইটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের ঋণের সুদসহ পুঞ্জীভূত দেনা পরিশোধ করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, গ্যাস বিতরণ ও উৎপাদন কোম্পানির কাছে পেট্রোবাংলার পাওনা অর্থ আদায়ের জন্য মাসভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহক নিয়মিত গ্যাস বিল পরিশোধ করায় বিতরণ কোম্পানির পক্ষে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়েছে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানি কর্তৃক বিদ্যুৎ ও সার শ্রেণিতে সরবরাহ করা গ্যাস বিলের বকেয়া অর্থ আদায়ের জন্য নিয়মিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার মাধ্যমে সমন্বয় করায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বর্ধিত হারে গ্যাস বিল আদায় হয়েছে।

পেট্রোবাংলা জানায়, চলতি বছরের মার্চ এবং এপ্রিল মাসে এই চার শ্রেণির পাওনাদারদের যথাক্রমে ৬৫৪ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৭৯০ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ সর্বমোট এক হাজার ৪৪৫ দশমিক ৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে। এতে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে আইওসি শেভরন ও তাল্লো, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি সরবরাহকারী কাতার এনার্জি ও ওকিউটি, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সরবরাহকারী, এফএসআরইউ এবং আইটিএফসির মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো পাওনা নেই।