গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে ঘিরে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায় পৃথক চারটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। সবকটি মামলায় বলা হয়েছে, নিহতরা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও দুষ্কৃতিকারীদের গুলীতে নিহত হয়েছে। চার মামলায় মোট আসামী করা হয়েছে ৫ হাজার ৪০০ জনকে। অপর দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যাওয়া গুলীবিদ্ধ রমজান মুন্সির বিষয়ে আলাদা একটি হত্যা মামলা করা হবে বলে জানা গেছে। এই নেয় গোপালগঞ্জে হামলা-সংঘর্ষ, গাড়ি পোড়ানো এবং হতাহতের ঘটনায় মোট ৮টি মামলা করা হলো।

শনিবার গভীর রাতে চার উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানায় হত্যা মামলা চারটি দায়ের করেন। গোপালগঞ্জ সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আইয়ুব হোসেন বাদী হয়ে রমজান কাজী নিহতের ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আসামী করা হয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ জনকে। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, গত বুধবার এনসিপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষে পৌর পার্ক থেকে দুপুরে মাদারীপুরের উদ্দেশে গাড়িবহর নিয়ে রওনা দিয়ে নেতৃবৃন্দ গোপালগঞ্জ শহরের এসকে সালেহিয়া মাদ্রাসার কাছে পৌঁছালে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং দুষ্কৃতকারীরা গাড়ি বহরে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতে বাধা দেয়। হামলাকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলী চালায়। এ সময় রমজান কাজী (১৭) গুলীবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

দীপ্ত সাহা (২৭) নিহতের ঘটনায় সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শামীম হোসেন বাদী হয়ে ১৯ জুলাই গভীর রাতে অজ্ঞাতনামা ১ হাজার ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামী করে ওই থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, গত বুধবার এনসিপির গাড়ি বহরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং দুষ্কৃতকারীদের হামলার ঘটনা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। কলেজ মসজিদের পাশে মিলন ফার্মেসির সামনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটি প্রতিরোধ করতে গেলে হামলাকারীরা গুলী করে। সেখানে দীপ্ত সাহা গুলীবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। সংকটজনক অবস্থায় তাকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

মোবাইল ব্যবসায়ী সোহেল রানা মোল্লা নিহতের ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন একই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ। আসামী করা হয়েছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ৫০০ জন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, লঞ্চঘাট এলাকায় হোটেল রাজের সামনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও দুষ্কৃতকারীরা এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনী এগিয়ে এলে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলী চালায় তারা। এ সময় সোহেল রানা মোল্লা (৩০) মারাত্মক আহত হন। তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

অপরদিকে সদর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ১ হাজার ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে ইমন তালুকদার হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন গত ১৬ জুলাই আসামীরা শহরের পুরাতন সোনালী ব্যাংকের সামনে এনসিপির গাড়ি বহরে হামলা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতে বাধা দিলে দুষ্কৃতকারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গুলী করে। গুলীবিদ্ধ হয়ে ইমন তালুকদার আহত হয়। পরে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মো. সাজেদুর রহমান বলেন, পাঁচজন নিহতের ঘটনায় চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরেকটি মামলা রাতে হতে পারে। তিনটি মামলায় আসামী করা হয়েছে ১৪০০ থেকে ১৫০০ জন করে। আরেকটি মামলায় আসামী করা হয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ জনকে। এরআগে গোপালগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়ানোর অভিযোগে চারটি মামলা করা হয়েছে। সদর, কাশিয়ানী ও কোটালীপাড়া থানায় মামলাগুলো করে পুলিশ। চারটি মামলায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৩৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ২ হাজার ৬৫০ জনকে আসামী করা হয়েছে।

লাশ জোর করে নিয়ে যায়, দাবি চিকিৎসকের: এনসিপির পদযাত্রা ঘিরে দফায় দফায় হামলা ও সংঘর্ষের মধ্যে গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত চারজনের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত না হাওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাসের স্বাক্ষর করা ব্যাখ্যাটি গেতকাল রাববার বিকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে ময়নাতদন্ত না করে লাশ হস্তান্তর করেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অসত্য। গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, বুধবার জেলায় অপ্রত্যাশিত ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের লাশ ময়নাতদন্ত না করার বিষয়ে কিছু সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনদের বক্তব্য তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে ময়নাতদন্ত না করে লাশ হস্তান্তর করেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অসত্য। প্রকৃত ঘটনা এই যে, ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর জরুরি বিভাগে প্রথম লাশটি আসে, কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণার পর রোগীর স্বজনদের লাশ ময়নাতদন্তের কার্যক্রম শেষ করে লাশ নেওয়ার কথা বললে স্বজনরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে জোরপূর্বক লাশ নিয়ে যায়। জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, পরবর্তীতে বাকি লাশগুলোর স্বজনরা ময়নাতদন্ত করাতে রাজি হয় না এবং হাসপাতালে কর্মরত কর্মচারীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে জোরপূর্বক লাশ নিয়ে যায়। এই সময় উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং চারিদিকে সংঘর্ষ চলমান থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন সেখানে না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অসহায় বোধ করেন। তাছাড়া আহত লোকজনের চিকিৎসা প্রদানের জন্য ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় এবং অন্যান্য কর্মচারী আত্মনিয়োগ করায় এবং বাইরের পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের সাথে যোগাযোগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে ঘটনা পুলিশকে মোবাইল ফোনে এবং লিখিতভাবে জানানো হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, গোপালগঞ্জ নাসীর স্বাস্থ্য সেবায় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ পরিবার সর্বদা আত্মনিয়োজিত। আমরা আশা করি উল্লেখিত বিবৃতির মাধ্যমে জনমনে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে।

কারফিউ শিথিল, ১৪৪ ধারা ধারা জারি: সংঘর্ষের জেরে তিন দিন কারফিউর পর আবার ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, গোপালগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় জনশৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য গতকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এর আগে, গতকাল সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল, পরে রাত ৮টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ ছিল। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গোপালগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।