* মোতায়েন থাকবে ৮০ হাজর সেনা, ১ লাখ ৭০ হাজার পুলিশ, ৫ লাখ ৭০ হাজার আনসার সদস্য। পাশাপাশি থাকবে বিজিবি, র‌্যাব ও অন্যান্য সংস্থা।

* প্রিজাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় থাকবে অস্ত্রসহ আনসার

* নতুন করে ১৭ হাজার পুলিশ বিজিবি নিয়োগ হচ্ছে

* পুলিশের হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রের সন্ধানে পুরস্কার ঘোষণা আসছে

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৬ মাস বাকি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। অতীতের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতার পর এবারের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এসময়ে তিনটি নির্বাচন ছিল পতিত সরকারের পাতানো। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের ভয়ে তখন ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেনি সাধারণ ভোটাররা। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ২০২৬ সালের নির্বাচন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও ঝঞ্ঝাটমুক্ত করার বিষয়টি বেশি নির্ভর করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে নির্বাচনি পরিবেশ সুষ্ঠু হয়। এ কারণে এখন থেকেই সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও এপিবিএনের সদস্যসহ সারাদেশে আট লাখের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন থাকবে। এরমধ্যে সেনাবাহিনীর ৮০ হাজরের বেশি সদস্য মোতায়েন থাকবে। ১ লাখ ৭০ হাজার পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং ৫ লাখ ৭০ হাজার আনসার বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। সারাদেশে মোতায়েন থাকবে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এছাড়াও সারাদেশে র‌্যাবের ব্যাটালিয়ানগুলো প্রস্তুত রয়েছে। র‌্যাব নিয়ে বিতর্ক থাকায় এবারের নির্বাচনে আনসার বাহিনীকে আলাদভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হবে। ভোটের আগে-পরে ১৩ দিন থাকবে সেনাবাহিনী।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনের আগে সরকার ৪৭ হাজার বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা বা বডিক্যাম কিনতে যাচ্ছে। ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্রের একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে ভোটকেন্দ্র থেকে রিয়েল-টাইম আপডেট পেতে ক্যামেরাটি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

এদিকে সরকার শিগগিরই পুলিশের হারিয়ে যাওয়া প্রায় ৭শ অস্ত্র উদ্ধারে তথ্য প্রদানের জন্য আনুষ্ঠানিক পুরস্কার ঘোষণা করতে যাচ্ছে, যেগুলো গত বছরের ৫ আগস্টের পর লুট করা হয়েছিল। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি এবং অন্যান্য স্থাপনা থেকে মোট ৫,৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬,৫১,৬০৯ রাউন্ড গুলি লুট করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। জব্দ করা অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে - রাইফেল, সাব-মেশিনগান (এসএমজি), লাইট মেশিনগান (এলএমজি), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার, টিয়ার গ্যাস শেল, টিয়ার গ্যাস স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড এবং গুলী। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের জন্য সরকার যৌথ অভিযান শুরু করেছে, যা এখনো চলমান। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এসব অভিযান অব্যহত থাকবে।

জানা গেছে, নির্বাচনের আগে নতুন করে ১৭ হাজার পুলিশ সদস্য এবং বিজিবির সদস্য নেয়া হবে। তাদের ডিসেম্বরের আগে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ৪৭ হাজার ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ১৬ হাজার ভোট কেন্দ্র ঝুঁকিপূণ রয়েছে। এই কেন্দ্র গুলোতে যেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ করা যায় সেটি করা হবে। সারাদেশের ভোট কেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করা পুলিশের বডি ক্যামেরা থাকবে। কোনো কেন্দ্রে অনিয়ম হলে তা বাতিল করতে পারবে। ভোটের ৭ দিন আগে এবং ৭ দিন পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে থাকবে। বিগত ১৮ এবং ২৪ সালে যেসব কর্মকর্তারা নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের এবার দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হবে না। ১৮ সালে যারা ৩০ বছরে ভোটার হয়েছেন তারা এবার ভোট দিবেন। নির্বাচনের সময় দেশের এবং বাহিরের দেশের ষড়যন্ত্র করে তাদের বিষয় গুলোর জন্য প্রস্তুতি নেয়া হবে।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচনের আগে সারাদেশে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের বদলী করা হবে। তার জন্য প্রস্তিুতি নেয়ার জন্যও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরইমধ্যে জাতীর উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে এমন বক্তব্য দেয়ার পর থেকেই দেশের রাজনীতির মাঠে কিছুটা নির্বাচনি হাওয়া বইতে শুরু করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের সংখ্যায় যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণে আগের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করলেও বিতর্কিত না হওয়া কর্মকর্তাদের আবার নেওয়া হতে পারে। তবে এতসব প্রস্তুতির মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ আতঙ্ক রয়েছে প্রশাসনে। গত বছরের আগস্টের ঘটনায় হারানো মনোবল পুলিশ এখনো ফিরে পায়নি। তাই নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের প্রস্তুতি বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত তিনটি নির্বাচনে পুলিশ কর্মকর্তাদের একাংশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে ভাবমর্যাদা সংকটও রয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের আসন্ন নির্বাচনে দায়িত্বে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ওই তিন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদেরও এবার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না। বিতর্কিত ওই তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী সব পুলিশ সদস্য, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের তালিকা করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর মোট জনবল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮৭ জন। নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব দিতে হবে দেড় লাখ সদস্যকে। বিগত তিন নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার (এসপি) ও উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার অভিযোগ আছে। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে তাদের বাদ রেখে তালিকা করা হয়েছে। তবে এতে প্রয়োজনীয় কর্মকর্তার সংখ্যা পূরণ হচ্ছে না।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে এসপি ও থানার ওসিদের লটারির মাধ্যমে পদায়ন করা হবে। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন চাইলে বদলি করতে পারবে। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, সেপ্টেম্বর থেকে দেড় লাখের বেশি পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনবিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ জন্য সদস্যদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার সম্প্রতি বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে নির্বাচন বিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলবে অক্টোবর ও নভেম্বর পর্যন্ত। নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় অস্ত্রসহ আনসার সদস্য রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আনসার। এবার আমরা আরেকটা জিনিস করছি, এবার প্রিজাইডিং অফিসারকে নিরাপত্তা দিতে হাতিয়ারসহ আনসার থাকছে। অনেক সময় প্রিজাইডিং অফিসারের ওপর (লোকজন) হামলা করতে যায়। এজন্য উনার জন্য হাতিয়ারসহ একটা গার্ডের ব্যবস্থা করছি। ওনাকে কেউ যেন কোনো কিছু না করতে পারে। এর আগে প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রে চারজন নারী ও ছয়জন পুরুষ আনসার সদস্য দেয়া হয়, যাদের কাছে হাতিয়ার থাকে না। হাতিয়াসহ থাকেন দুইজন আনসার সদস্য। এবার হাতিয়ারসহ তিনজন আনসার সদস্য থাকবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আনসার ছাড়াও পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েনের আলাদা ব্যবস্থা নেয়া হবেও জানান উপদেষ্টা। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। তিনি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য আগামী নির্বাচন, আমরা এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।