আজ ২২ জুলাই মঙ্গলবার। ২০২৪ সালের এই দিনটি সোমবার ছিল। এদিনও দেশজুড়ে কারফিউ অব্যাহত রাখে স্বৈরাচার হাসিনার সরকার। ইন্টারনেটও বন্ধ রাখা হয়। উদ্দেশ্য একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ বন্ধ রাখা। যাতে ছাত্ররা একত্রিত হতে না পারে। দেশে কি হচ্ছে তা সহজে মানুষ না জানতে পারে। অন্যদিকে পুলিশ র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তাদের গোলাগুলী ও ধরপাকড় অব্যাহত রাখে। এদিকে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন কায়দায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। তবে বড় কথা হলো ততদিনে আন্দোলনের স্টিয়ারিং জনগণের হাতে চলে যায়। জনগণ নিয়মিত রাস্তায় নামতে থাকে। আন্দোলন করতে থাকে। ছাত্র-জনতা কারফিউ অমান্য করে বিক্ষোভ, রাস্তা ব্লকেড অব্যাহত রাখে। মানুষের মধ্যে অভয় চলে আসে। পুলিশের গুলী উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। সারাদেশজুড়ে মানুষ হাসিনার সরকারকে লালকার্ড দেখিয়ে দেয়।
এদিকে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত রাস্তায় নামার পরও স্বৈরাচার হাসিনার সরকার নানা কূটকৌশল অব্যাহত রাখে। নানা বাহানা দিতে থাকে। ততদিনে হাসিনার ক্ষমতার তখত নড়বড়ে হয়ে যায়। এরপরও নতুন নতুন কায়দা কানুন চালাতে থাকে। আশ^াসের বানী শোনাতে থাকে। কিন্তু মানুষ তার কথায় কোনরকম কর্ণপাত না করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এদিন সারাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীসহ ১ হাজার ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে গত ছয় দিনে (১৭ থেকে ২২ জুলাই) সারাদেশে গ্রেফতারের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। সারাদেশে সোমবার পর্যন্ত ১৬৪টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ডিএমপিতে ৭১টি, চট্টগ্রাম মহানগরে ১৪টি এবং অন্যান্য জেলায় ৭৯টি মামলা করা হয়। চিরুনি অভিযানে গ্রেফাতার ব্যক্তিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এদিকে র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন সোমবার সারাদেশে অভিযান চালিয়ে ৪০ জনকে গ্রেফতার করে। আগের দিন রোববার নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে সারাদেশে ৩৯ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এদিকে ২২ জুলাই পঞ্চম দিনের মতো পুরো দেশকে ইন্টারনেটবিহীন রাখে সরকার। এক নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি আরও একদিন (২৩ জুলাই) বাড়ানো হয়। এদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুইজন আন্দোলকারীর মৃত্যু হয়। সোমবার পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আন্দোলনে নিহত ৬৮টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২২ জুলাই সেনাপ্রধান যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েন করা সেনা সদস্যদের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। এ সময় সেনাপ্রধান বলেন, ‘জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া এদিন যাত্রাবাড়ী এলাকা পরিদর্শন করেন তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, র্যাবের মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ ও ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। এ সময় আইজিপি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিটি অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য পাই পাই করে হিসাব দিতে হবে।’
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘পরিস্থিতির আরও উন্নতির জন্য কারফিউ অব্যাহত থাকবে। মঙ্গলবার দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আস্তে ধীরে কারফিউ শিথিলের সময় পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে।’
রোববার দিবাগত রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চট্টগ্রাম মহানগরে ৪৬ জন, নারায়ণগঞ্জে ১১০ জন, গাজীপুরে ২৫ মামলায় ১৫৬ জন, বগুড়ায় ১০ মামলায় ৯৪ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ২৫ জন, লালমনিরহাটে দুই জন, টাঙ্গাইলে ৩৯ জন, রংপুরে ১৮ জন, জয়পুরহাটে ৩৬ জন, কক্সবাজারে তিন মামলায় ২৪ জন, বরগুনায় ২৫ জন, বরিশালে ১৩ জন, দিনাজপুরে ৩১ জন, জামালপুরে আটটি মামলায় ১৮ জন, ঝিনাইদহে ১৩ জন, কুমিল্লায় ৯১ জন, নাটোরে চার জন, ফেনীতে আট জন, গাইবান্ধায় দুই নাশকতার মামলায় ৪৫ জন, ফরিদপুরে ১৭ জন, পঞ্চগড়ে চার জন, কিশোরগঞ্জে ২৬ জন, লক্ষ্মীপুরে ১৪ জন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
২২ জুলাই সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরির সব গ্রেডে (২০তম থেকে নবম গ্রেড) ৯৩ শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে করার বিষয়ে উচ্চ আদালতের আদেশের পর সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দেন। এ দিন বিকালে প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। বিশেষ করে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে একধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে, তখনই ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এই সময়ে কী করণীয় সে বিষয়ে কথা বলেন তারা।
দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এই বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। দৈনিক কালের কন্ঠের রিপোর্টে বলা হয়, এই বৈঠকের যে বিষয়টি সবার আগে দৃষ্টি কাড়ে সেটি হচ্ছে, চলমান সংকটকালে প্রধানমন্ত্রী প্রথম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসলেন। সবচেয়ে বড় বিবেচনার বিষয়টি হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা দেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এই বৈঠকের বিষয়গুলো হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন ব্যবসায়ীরা। জঙ্গী দমন করা এবং ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্য নির্ধারণের বিষয় উঠে এসেছে এই বৈঠকে। ব্যবসা যাতে ভালোভাবে চলতে পারে, সেটা করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞ যারা চালিয়েছে, সহজে ছাড়া হবে না বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিদেশ থেকে হুকুম দেয়Ñএমন কথা যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনি এটাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে জামায়াত, শিবির ও বিএনপি একসঙ্গে মানুষ খুন করছে।
প্রধানমন্ত্রী এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে চলমান অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হবে। তিনি বলেছেন, শক্ত পদক্ষেপ নিয়ে পরিবেশ উন্নত করা হবে। যে অবস্থা ছিল, তা এরই মধ্যে অনেকটা শান্ত করে নিয়ে আসা হয়েছে। আস্তে আস্তে আরো ভালো হবে। কারফিউ পর্যায়ক্রমে শিথিল করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা তার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ব্যবসায়ীদের অসুবিধা বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান দেশের স্বার্থে সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ব্যবসায়ীদের আস্থা ও বিশ্বাস আছে। সরকার অনেক বেশি চেষ্টা করছে শিগগিরই সব কিছু স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে। এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের হৃদয়ে আজ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এমন ধ্বংসলীলা ব্যবসায়ীরা মানতে পারছেন না। যারা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে, তাদের পরাজিত করার কথাও বলেছেন ব্যবসায়ীরা। জানিয়েছেন, তারা সব সময় সরকারের সঙ্গে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।
সাধারণ মানুষ চায় দেশের পরিবেশ ভালো থাক। দেশের বিশেষ সময়ে ব্যবসায়ীরা এক হয়েছিলেন। গত কয়েক দিনে দেশের জাতীয় সম্পদ যেভাবে ধ্বংস হয়েছে, সেটা কেউই কল্পনাও করতে পারেননি। শেখ হাসিনা দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের জানান, মানুষের জান-মাল রক্ষা করার জন্য সরকার কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে। ব্যবসা সচল রাখতে হবে বলেই তাদের ডাকা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। কারণ ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।
দেশের চলমান পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে আসবে, এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। কিন্তু এভাবে তো দেশ চলতে পারে না। এই অনিশ্চয়তা কেন? ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আগুন যারা দিল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করল. তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে এক হতে হবে। চিহ্নিত অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে হামলা-অগ্নিসন্ত্রাস করেছে মন্তব্য করে ওই মতবিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখনও তারা জ্বালাও-পোলাও আন্দোলনের হুকুম দিয়ে যাচ্ছে। যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, এত সহজে ছাড়া হবে না। শক্ত অ্যাকশন নিয়ে এটা দমন করে পরিবেশটা উন্নত করা হবে। সরকার বাধ্য হয়ে কারফিউ ও সেনা মোতায়েন করেছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এটা আমরা চাই না। তারা (ছাত্ররা) যখন সরে এসেছে সেই সময় আমি আর্মি নামিয়েছি। আমি কিন্তু তার আগে আর্মি নামাইনি। আমরা শেষ চেষ্টা করি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে। তারপর আর্মি নামাতে বাধ্য হয়েছি। কারফিউ দিয়েছি। আস্তে আস্তে কারফিউ শিথিল করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জামায়াত-শিবির পেছনে থেকে সারা দেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়েছে। বিএনপি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এবার কাউকে সহজে ছাড় দেওয়া হবে না। দালাল ব্যবসায়ীরা নৃশংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় এবং দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা ও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রয়াসে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা দেওয়ায় ব্যবসায়ীদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের দেওয়া সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, যে কারণে আমরা সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্যবাদী জামায়াত-শিবির ও বিএনপির বিরুদ্ধে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পেরেছি। আপনাদের সহযোগিতা তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নে আমাদের জন্য সহায়ক হবে।’
প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়িক কর্মকা- পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সবকিছু করার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, আমরা তাই করব।’
প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দেন, নৈরাজ্যবাদীরা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য দেশে ও বিদেশে অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা রক্ষা করার জন্য আপনাদেরকে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।’ তিনি বলেন, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হলে আপনাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীরা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন জানান এবং তার পাশে থাকার আশ্বাস দেন। কেননা প্রধানমন্ত্রী সব সময় ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে তাদের সব দাবি পূরণ করেছেন। ব্যবসায়ীরা বলেন, তারা সব সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন, সঙ্গে আছেন এবং সঙ্গে থাকবেন। আটজন ব্যবসায়ী তাদের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন। ব্যবসায়ীরা সারা দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং যত দ্রুত সম্ভব দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার দাবি জানান। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য সারা দেশে কারফিউ জারি করেছে। সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান প্রতিদিন কারফিউ জারি করে দেশ পরিচালনা করতেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত করল যে তারা সারা দেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে লিপ্ত নেই, বরং তারা যৌক্তিকভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর বিষয়। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষতি না হয়। পুলিশ মোতায়েন করে আমরা সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়েছি। যখন অগ্নিসংযোগ করা শুরু হলো, তখন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলল যে তারা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নয় এবং তারা এর নিন্দা জানাল। তারপরই আমরা সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছি, তার আগে নয়।’
যারা এ কথা বলার চেষ্টা করছে যে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সেনা মোতায়েন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের সমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা ছাত্ররাজনীতি করে এসেছি।’ কোভিড-১৯ মহামারির মতো বিভিন্ন কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান বলেন, কোটা আন্দোলনে ভর করে বিএনপি-জামায়াত যখন সারা দেশে জ্বালাও–পোড়াও করছে, দেশের সম্পদ নষ্ট করছে, এই কঠিন সময়েও তারা বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে আছেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা প্রস্তুত এবং রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, মতবিনিময়ে বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, অল্প সময়ের ব্যবধানে যে তা-ব করা হয়েছে, তা চিন্তাই করা যায় না। এটা আসলে সংগঠিত অপরাধ। তিনি বলেন, ‘সরকারের পাশে আমরা ছিলাম, আছি ও থাকব।’ অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর কারখানা চালু করার দাবি জানান। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অন্তত ইমেইল যোগাযোগটা চালু করুন।’ অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ চলছে বলেও উল্লেখ করেন নাসিম মঞ্জুর।
বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে একক স্পট হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির ঘোষণার দিন সন্ধ্যা থেকেই এই এলাকায় সংঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়। থেমে থেমে এটি চলমান ছিল ২২ জুলাই পর্যন্ত। আদালতের শুনানির আগের দিন ২০ জুলাই সারা দেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন হলেও যাত্রাবাড়ী এলাকায় কারফিউয়ের মধ্যেও সংঘর্ষ চলতে থাকে। এ এলাকা কারফিউর দ্বিতীয় দিনে ২১ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে সেখানে সেনা ও পুলিশ প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা পরিদর্শনে যান। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এ এলাকায় অন্তত ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে। তবে পুলিশ বা হাসপাতাল থেকে কোনও নিশ্চিত সংখ্যা পাওয়া যায়নি।
২২ জুলাই রাজধানীর রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় তিন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, তিনজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ১ হাজার ১১৭ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩২ জন গুরুতর আহত, ৩ জন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি। তিনি বলেন, এভাবে এত পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার নজির ইতিহাসে নেই।
সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে আদালত রায় দিয়েছেন জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, কোটা থাকবে না। সংক্ষুব্ধ হয়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আদালতে গিয়েছিলেন। হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছিলেন। সেটিও সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করা হয়েছিল। তারপরও কেন আন্দোলন, সেটাই আমাদের প্রশ্ন। শুরু থেকেই বলে আসছি, এর পেছনে উসকানিদাতা রয়েছে। সেই আশঙ্কাই এখন সত্যি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে দুষ্কৃতকারীরা নাশকতা করেছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
যাঁরা নাশকতা করেছেন, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্জন বিনষ্ট করার জন্য একের পর এক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নরসিংদীতে কারাগারে হামলা চালানো হয়েছে। ৯ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, অস্ত্রাগার লুট করা হয়েছে। সেই অস্ত্র দিয়ে নাশকতা করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনেও আগুন দেওয়া হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ।
২২ জুলাই, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দুই দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইন্টারনেট সংযোগ চালুর দাবি জানায়। কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান, গত বুধবার ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের চার দফার মধ্যে রয়েছে- ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেট চালু, ক্যাম্পাসগুলো থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাস চালু, সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা প্রদান এবং কারফিউ প্রত্যাহার”। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ হলে সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত বক্তব্য ও দফা দাবি পেশ করা হবে বলেও জানান বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এই সমন্বয়ক। এই সমন্বয়কারী জানান, বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে দাবি মেনে নেয়া হলেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পরের দিন, ২৩ জুলাই, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান যে, সরকার ইন্টারনেট সংযোগে বিঘœ ঘটার পর তা আংশিকভাবে আবার চালু করবেÑব্যাংক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রপ্তানি খাত ও নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়।