নাগরিক প্লাটফর্ম আয়োজিত খসড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ-২০২৫ সংক্রান্ত বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে নাগরিক সংলাপে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নামে বিগত সময় নখদন্তহীন মানবাধিকার কমিশন উপহার দেওয়া হয়। যে কোনো কামড় দিতে পারে না, যার কোনো দক্ষতা নেই কিংবা কার্যক্ষমতা নেই এ রকম মানবাধিকার কমিশন আমাদের দেওয়া হয়েছে। আমার প্রথম চাওয়া হলো- আমরা এরূপ নখদন্তহীন মানবাধিকার কমিশন চাই না। যারা কার্যকরভাবে মানবাধিকার রক্ষা করতে পারবে সেইরকম কমিশন চাই।
গতকাল শনিবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে খসড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ-২০২৫ সংক্রান্ত বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে নাগরিক সংলাপে এসব কথা বলেন তিনি। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ এ সংলাপের আয়োজন করে।
নাগরিক সংলাপে আরও বক্তব্য রাখেন গুম কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চোধুরী, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রিয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এডভোকেট মো. মতিউর রহমান আকন্দ, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক, সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের শাহীন আনাম, মায়ের ডাকের সানজিদা ইসলাম, খন্দকার জহিরুল আলম, মানবাধিকার কর্মী সুস্মিতা চাকমা, গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ারকারের সভাপতি কল্পনা আক্তার প্রমুখ।
সংলাপে সেন্টার ফর পলিসির ডায়লগ (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, যে প্রতিষ্ঠান মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণ করতে পারে না, এমন একটি নখন্তহীন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেখতে চাই না। তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে আমাদের নখদন্তহীন মানবাধিকার কমিশন উপহার দেওয়া হয়েছিল। আমরা ওই রকম নখদন্তহীন ও মেরুদন্ডহীন মানবাধিকার কমিশন চাই না।
সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে কোনো মেরুদন্ডহীন ভালো মানুষকে এই কমিশনে বসিয়ে দেবেন না। যারা সৎ ও সাহস করে সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে পারে তাদের এই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব দিন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে মানবাধিকার কমিশন গঠনে ড. ফখরুউদ্দিনের সরকারের সময় আইনের খসড়া তৈরি হয়। ওই আইনের ভিত্তিতে পরবর্তী সরকারের সময় কমিশন গঠিত হয়। নতুন সরকার আইনটি অনুমোদন দেন। ওই আইনের অধীনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য নিয়োগ হয়। এরপর ২০২৪ সাল পর্যন্ত একাধিক চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর কমিশন বাতিল করা হয়। এরপর প্রায় এক বছর ধরে বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নেই। অথচ সরকার এ সময় অন্যান্য কমিশন গঠন করেছেন।
তিনি বলেন, এই সময় কমিশন গঠিত না হলেও সরকার মানবাধিকার বিষয়ে আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছেন। সেই আইনের খসড়া নিয়ে আজকের আলোচনা। বিগত সময় কমিশনের ইতিহাস বিবেচনায় নিলে প্রশ্ন থেকে যায় দেশের মানবাধিকারের কি কোনো উন্নতি হয়েছে? অন্যদিকে নতুন খসড়া আইনে নতুনত্ব কী আছে, যার ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষের মানবাধিকারের বিষয়টি বাস্তবায়ন হবে? আমার উপলব্ধি হলো,
তিনি বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নামে বিগত সময় নখদন্তহীন মানবাধিকার কমিশন উপহার দেওয়া হয়। যে কোনো কামড় দিতে পারে না, যার কোনো দক্ষতা নেই কিংবা কার্যক্ষমতা নেই এ রকম মানবাধিকার কমিশন আমাদের দেওয়া হয়েছে। আমার প্রথম চাওয়া হলো- আমরা এরূপ নখদন্তহীন মানবাধিকার কমিশন চাই না। যারা কার্যকরভাবে মানবাধিকার রক্ষা করতে পারবে সেইরকম কমিশন চাই।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আরেকটি হলো নখদন্তহীন মানবাধিকার কমিশনের মাথায় একজন মেরুদণ্ডহীন ভালো মানুষকে বসিয়ে দেবেন না। সেই মানুষ কোনো দিন অন্য মানুষের জন্য মেরুদণ্ড শক্ত করে কাজ করতে পারবে না। এজন্য মেরুদণ্ডহীন ভালো মানুষের প্রয়োজন নেই। আমাদের সৎ, নীতিবান ও সাহস করে সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে পারে, সেই মানুষ প্রয়োজন। সেই রকম মানুষ যাতে কমিশনে দেওয়া হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, সেনাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা যারা মানবাধিকার লংঘন করছে তাদেরকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আইনের আওতায় আনতে হবে। কমিশনকে আয়নাঘর পরিদর্শনের এখতিয়ার দিতে হবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে জাতীয় মানবাধিকার আইন সংশোধন করতে হবে। কমিশনের তদন্ত করা ও বাস্তবায়নের পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। কমিশনের প্রধান হিসেবে সরকারের সাবেক আমলা এবং রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়দেরকে না রাখার দাবি জানান তিনি।
বক্তারা বলেন, গত এক বছরে বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের সময়ে বিভিন্ন কমিশন পুনর্গঠন করা হলেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। অবিলম্বে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ-২০২৫ সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রেখে কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন তারা।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া খসড়া আইন নিয়ে আলোচনায় বলেন, বিগত সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে মানবাধিকার ইস্যু কাজ করে নাই। অন্যান্য ক্ষেত্রে সফল হয়। কেন হয় না, সেটা বিবেচনা করা উচিত। খসড়া আইনেও বিষয়টি উপেক্ষিত মনে হয়েছে। নতুন আইন দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিক কমিশনে নিয়োগে বাধা নেই। এটা কেন করা হয়েছে জানি না। তবে থাকা উচিত ছিল। কোনো আমলাকে এখানে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, কিন্তু এখানে সেই সুযোগ রয়েছে।
‘বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ’ এর উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান দুটি উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রেক্ষাপটে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) ম্যান্ডেট ও কার্যপরিধি, গঠন এবং স্বাধীনতাভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতার বিশ্লেষণ। দ্বিতীয়ত প্রস্তাবিত খসড়াকে অধিকতর কার্যকর করার জন্য পরামর্শ দেওয়া, যাতে অধ্যাদেশটিকে নির্ভরযোগ্য অনুসন্ধানী ক্ষমতা প্রয়োগ, ভুক্তভোগী ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা প্রদান এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ম্যান্ডেট দ্বারা সমৃদ্ধ করা যায়।