জুলাইয়ের গরম বাতাসের মতোই উত্তপ্ত ছিল সেদিনের রাজপথ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া ছাত্রদের ন্যায়বিচারের দাবিতে গর্জে ওঠা স্লোগান মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মতো মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্র/ছাত্রীরাও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিলো। বৈষম্যমুক্ত, সাম্যবাদী ও ইনসাফপূর্ণ বাংলাদেশ গড়া এটাই ছিল মিল্লাত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন। জুলাই বিপ্লবে একক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মিল্লাত মাদ্রাসার ৫ জন শিক্ষার্থী শহীদ হয়। শুক্রবার ১৯ জুলাই ২০২৪-এর সেই অগ্নিঝরা দিনে ক্ষমতার দম্ভে উন্মত্ত একদল আওয়ামী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ক্যাডার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হিংস্র হায়েনার মতো। লোহার রড-পাইপ, লাঠি, পাথরসহ দেশীয় অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর। তাদের বর্বরতা থেকে রেহায় পায়নি সাধারণ ছাত্রীরা ও মাদ্রাসার নারী আলেম ও নারী ছাত্রীরা। রক্ত ঝরলো কিন্তু থামল না বৈষম্যের বিরুদ্ধে মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্রদের আন্দোলন। আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠল মিল্লাত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। তেমনি এক প্রতিবাদী তরুণ মোহাম্মদ আদিল জুম্মার নামাযের পর শহীদদের রক্তের বদলা নিতে রাজপথে নেমে পড়ে। আদিলকে আমি বাসা থেকে ডেকে নিয়ে এসেছিলাম। সড়কে আন্দোলন করতেছিলাম আমরা, এমন সময় হঠাৎ পুলিশ গুলী শুরু করে। আমরা সবাই পিছনে ফিরতেছিলাম। কিন্তু আদিল নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। আন্দোলন চলাকালে আদিলের বন্ধু বলেছিল তুই বেশি সামনে যাস নে, সাহসী আদিল বলেছিল, ভয়ে সবাই পিছিয়ে গেলে সামনে এগিয়ে যাবে কে? এরমধ্যেই হঠাৎ একটা গুলী এসে ওর বুকে লাগে। ওর লাশটা যখন আমি নিয়ে আসি। তখনো ওর চোখ দুটি খোলা, যেন ওর লড়াই বাকি আছে। আমরা ভেবেছিলাম ও তখনো জীবিত। কিন্তু আদিল ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ মোহাম্মদ আদিলের মৃত্যু পূর্ববর্তী শেষ সময়ের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন তার চাচাতো ভাই সাজিদ। আদিল ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার তা’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার ১০ম শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থী ছিল। পরের বছর দাখিল পরীক্ষা। টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর ১৭ জুলাই ২০২৪ মাদ্রাসার ছাত্রাবাস থেকে বাড়ি ফিরেছিল আদিল। সন্তানের নামে সড়ক চান শহীদ আদিলের মা আয়েশা আক্তার ও পিতা মো: আবুল কালাম।
যেভাবে শহীদ হন মোহাম্মদ আদিল: শ্রক্রবার ১৯ জুলাই ২০২৪। নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ের বাড়িতে সবার সঙ্গে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল ১৬ বছরের মোহাম্মদ আদিল। দশম শ্রেণির ছাত্র আদিলের এক বন্ধু এসময় বাসা এসে জানায় কাছেই শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলী চালাচ্ছে। তখনই বাসা থেকে এক ছুটে বেরিয়ে যায় আদিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে যেখানে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করছিল সেদিকে ছুটে যায়। ছেলেকে আটকানোর বারবার চেষ্টা করেন বাবা-মা, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ‘আগেরদিন যখন বাইরে বিক্ষোভ চলছিল আমরা ওকে বাইরে বেরোতে দেইনি। কিন্তু জুলাইয়ের ১৯ তারিখে কিছুতেই বাড়িতে রাখতে পারিনি। আর যখন ফিরল তখন তো লাশ হয়েই ফিরল,’ কান্নায় গলা ধরে আসা কণ্ঠে বলছিলেন আদিলের মা আয়েশা আক্তার। বুকে দুইটা গুলি লেগেছিল। এসবি স্টাইল কম্পোজিট লিমিটেডের সামনে বিক্ষোভ করার সময় বুকে গুলীবিদ্ধ হয় আদিল। আদিলকে ধরাধরি করে লোকজন সাইনবোর্ড এলাকায় কাছের যে বেসরকারি হাসপাতালটি ছিল সেখানে নিয়ে যায়। চিকিৎসক জানিয়ে দেন মারা গেছে আদিল। রাতেই ভূঁইগড় কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় আদিলকে।
তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল আদিল। বড় ভাই আবদুল্লাহ আল নোমান দুবাই থাকেন, আরেক ভাই বায়েজিদ আহমেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের নার্সিংয়ের ছাত্র। ১৬ বছর বয়সি আদিল ছিল প্রবল উদ্যমী ও সাহসী। জয়ী হয়েছে একাধিক ম্যাথ অলিম্পিয়াডে। ‘আদিল সেনাবাহিনীতে যেতে চেয়েছিল। অফিসার হবে, দেশের কাজ করবে। ওর মামা একজন সেনাসদস্য। তাকে দেখেই বলত একদিন আমিও আর্মি অফিসার হবো। আর সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলীতেই কিনা ছেলেটা মরে গেল,’ বলছিলেন আদিলের মা।
পরিবারের অভিব্যক্তি: স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হবে। ছেলের সেনাসদস্য হওয়ার স্বপ্নের কথা জানিয়ে তার মা আয়েশা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে এক দিন রাতে কোচিং থেকে ফেরার পথে পুলিশ ‘রাতে বাইরে কি কর’ এই ধরনের প্রশ্ন করে। ছোট্ট ছেলে আমার ভয়হীন সাবলীলভাবে উত্তর দেয়। সেদিন তারাও আমার ছেলের কথায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিল, তোমার মতো ছেলেই হবে দেশের ভবিষ্যৎ। আমার ছেলে চেয়েছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের জন্য কাজ করবে। আদিলের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন হারিয়ে গেলেও দেশের ভবিষ্যতের জন্য কাজ করার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।
তুমি আন্দোলনে যাইয়ো না আদিল। তুমি ছোট মানুষ। আমারে উল্টো জবাব দিয়ে বলতো, যারা মারা যাইতাছে তারাও তো তোমার মতো কোনো মায়ের সন্তান। মেজো ছেলেটারে পারলেও ওরে আমি আটকাইতে পারি নাই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন আয়েশা বেগম।
তিনি আরো বলেন, আমার বড় ছেলে নোমান স্কলারশিপ নিয়ে দুবাইয়ে পড়াশোনা করছে। মেজো ছেলে বায়েজিদ অনার্সে পড়ে। আমার তিনটা ছেলে। তবে আদিল সবচেয়ে বেশি সাহসী ও মেধাবী ছিল। ছেলেটারে মাদরাসার আবাসিক হোস্টেলে দিয়েছিলাম এ বছর। হোস্টেল থেকে প্রতিদিন আন্দোলনে যাচ্ছিল। কত যে বলেছি তুমি যাইয়ো না। অনেক জোরাজুরি করেও ওরে ঘরে আটকায় রাখতে পারি নাই। ছেলে আমার সেই যে গেল তো গেল, ফিরল লাশ হয়ে।’
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফান্ড ও জামায়াতে ইসলামী থেকে অনুদান প্রদান: শহীদ আদিলের মৃত্যুর পর ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়। শহীদ আদিলের মা নিজের ইচ্ছা পোষণ করে বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর আমরা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফান্ড থেকে ৫ লাখ টাকা ও জামায়াতে ইসলামী থেকে ২ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু আমার ছেলেটা দেশের জন্য প্রাণ দিল, আমি চাই ওর একটা স্মৃতি থাকুক। সবাই ওরে মনে রাখুক। আমাদের বাড়ির সামনের সড়কটি ওর নামে হোক এটাই আমার শেষ চাওয়া।