পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা সভা-সমাবেশতো দূরের কথা রাস্তায় নামতে পারেনি। গোপনে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে পরেনি। এমনকি মায়ের জানাযা থেকেও গ্রেফতার করে নেয়া হয়েছে এবং নির্যাতনে মারা গেছে এমন নজিরও আছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ ইসলামী দলের নেতা-কর্মীদের দমনে ব্যাপক তৎপর ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র্যাব, পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থা এবং একাধিক ইউনিট ও গোয়েন্দা তৎপরতায় কেউ বাসা-বাড়িতে ঘুমাতে পারেনি। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদেরকে টার্গেট করে সব চেয়ে বেশি তৎপর ছিল পুলিশ ও র্যাব। যেখানে পেয়েছে ধরে নিয়ে গেছে। গুম করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিরোধী নেতা-কর্মীরা কোথায় আছে এসব ছিল নখদর্পণে।
কিন্তু পাঁচ আগস্টের পর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের অধিকাংশই পালিয়ে গেছেন। তবে তার দলের নেতাকর্মীরা এখনো প্রকাশ্যে। পতিত সরকারের সময় বিরোধী মতের লোকজনকে দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতটা তৎপর ছিল বর্তমানে সেরকম পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। অল্প কিছু পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে যোগ না দিলেও বিগত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই এখনো কর্মস্থলে। নিষিদ্ধ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মোটেও তৎপর নয় বলে অনেকেই মনে করছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠন এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সারাদেশে ব্যাপক তৎপর। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি তারা প্রায়ই ঝটিকা মিছিল করছে। ব্যাপক তপরতা চালাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমেও তাদের তৎপরতা বেড়েছে। ঝটিকা মিছিল থেকে রাষ্ট্র বিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলে তারা প্রকাশ্যে এসব কর্মকাণ্ড কিভাবে চালায়?
এর মধ্যে গত ৯ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুুলিশের (ডিএমপি) এক অফিস আদেশের পর বিভিন্নস্থানে নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কোনো আসামী গ্রেফতারের আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি যে ঘটনায় যুক্ত ছিলেন, সে বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ হাজির করার কথাও বলা হয়েছে ওই আদেশে। এতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সংক্রান্তে রুজু করা মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজাহারনামীয় আসামীর সংখ্যা অধিক।
এ বিষয়ে যুগ্ম কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানি শিকার না হন এবং প্রকৃত অপরাধীরা যেন ছাড়া না পান সে ব্যাপারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই আদেশ র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন দফতরে পাঠনো হয়। কিন্তু ডিএমপির ওই আদেশটি জারির পর তা সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। এই আদেশ গণমাধ্যমে প্রকাশের পর বাড়তে থাকে ঝটিকা মিছিলসহ নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মকাণ্ড। এরপর নিষিদ্ধ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল ও তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় হুঁশিয়ারি দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ভবিষ্যতে যেন আওয়ামী লীগ আর কোনো মিছিল করতে না পারে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। রাজধানীর বিমানবন্দর থানা পরিদর্শনে গিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ও জুলাই আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর দায়ে বিচারের দাবি উঠেছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের মিছিলের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারকে কঠোর হওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কিত মামলায় আসামী গ্রেফতার সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করার বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জসিম উদ্দিন রিট দায়ের করেন। এতে সংশ্লিষ্ট মামলায় আসামী গ্রেফতারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে, ঢাকা মহানগর পুলিশের এমন অফিস আদেশ স্থগিত করেন হাইকোর্ট। বুধবার বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। রুলে ৯ এপ্রিলের অফিস আদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ডিবি, সিআইডি ও এসবি প্রধানসহ সাতজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। ৯ এপ্রিলের অফিস আদেশে বলা হয়েছিল, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সংক্রান্ত মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজাহার নামীয় আসামী অনেক থাকে। এজাহার বা তদন্তে প্রাপ্ত আসামী গ্রেফতারের জন্য উপযুক্ত প্রমাণ (ভিকটিম/বাদী/সাক্ষী, ভিডিও/অডিও/ছবি, সিডিআর ইত্যাদি) এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন।’ আদেশে আরও বলা হয়, উপযুক্ত প্রমাণ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনার মামলার এজাহারনামীয় কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত কোনো আসামী গ্রেফতার না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এ ব্যাপারে পুলিশের একজন ডিআইজি পর্যায়ের কর্মকর্তা দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, যেহেতু গ্রেফতারের বিষয়টি ডিএমপি থেকে এসেছিল তাই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে তিনি বলেন-পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে এখনো কলকাঠি নাড়াচ্ছেন ফ্যাসিস্ট আমলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, যেহেতু আমিও চাকরিরত তাই পরিচয় প্রকাশ না করে বলছি-যারা এসব করছে তারা চিহ্নিত। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তাদেরকে সরানো হচ্ছে না বা সরানো যাচ্ছে না। তাই পুলিশে এখনো অনেকটো হযবরল অবস্থা। তিনি বলেন, ডিএমপি থেকে যে অফিস আদেশ জারির এক সপ্তাহের মাথায় সেটি উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত করতে হলো (!) তা হলে এমন আদেশ দেয়া হলো কার স্বার্থে? ডিএমপির ওই আদেশটি নিয়েই এখন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের সমন্বয়হীন সিদ্ধান্তের কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না বলেও মনে করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্নস্থানে অভিযান পরিচালনা করে ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণকারী নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের আরও ১১ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গত বৃহস্পতিবার ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। গ্রেফতাররা হলেন- বংশাল থানার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী যুবলীগের সহ-সভাপতি আসাদুল্লাহ শিপলু (৪৫), ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাকিল আহমেদ (৫৬), ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য মো. হাবিবুর রহমান হাবিব (৪৫), ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আসলাম চৌধুরী ইমন (২৪), যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগ নেতা ও অর্থ সরবরাহকারী মোবাশ্বের রহমান (৫৫), ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানার কুশঙ্গল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রুহুল আমীন (৫৪), সাবেক মেয়র ও কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. কামাল হোসেন শেখ (৬২), উত্তরা পশ্চিম থানা শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. বাবুল (৫৫), বাংলাদেশ স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সম্পাদক ও সুনামগঞ্জের তাহেরপুর থানার বালিজুড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজাদ হোসেন (৫২), শেরেবাংলা নগর থানার ৯৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক মো. রেজাউল করিম (রানা) ও মিরপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজালাল (৪৫)।
তালেবুর রহমান বলেন, বুধবার রাত আনুমানিক ৮টা ৫৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে মোবাশ্বের রহমানকে এবং রাত আনুমানিক ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে শান্তিনগর এলাকা থেকে আজাদ হোসেনকে গ্রেফতার করে ডিবি-ওয়ারী বিভাগের পৃথক টিম। এছাড়াও একইদিন রাত আনুমানিক ১২টা ৫ মিনিটের দিকে উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর থেকে মো. বাবুলকে এবং রাত আনুমানিক ২টার দিকে মোহাম্মদপুর থানাধীন চন্দ্রিমা মডেল টাউন এলাকা থেকে মো. শাহজালালকে গ্রেফতার করে ডিবি-সাইবার ক্রাইম বিভাগের পৃথক টিম। রাত আনুমানিক ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে শেওড়াপাড়া এলাকা থেকে রেজাউল করিম রানাকে গ্রেফতার করে ডিবি-মিরপুর বিভাগের একটি টিম। তিনি বলেন, এদিন রাত আনুমানিক ১২টা ৩৫ মিনিটের দিকে ভাষানটেক এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মো. কামাল হোসেন শেখকে গ্রেফতার করে ডিবি-তেজগাঁও বিভাগের একটি টিম। এছাড়াও বংশাল এলাকা থেকে আসাদুল্লাহ শিপলুকে এবং মতিঝিল এলাকা থেকে শাকিল আহমেদকে গ্রেফতার করে ডিবি-লালবাগ বিভাগের পৃথক টিম। এছাড়া বুধবার সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টার দিকে রুহুল আমীনকে লালবাগ এলাকা থেকে, রাত আনুমানিক ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে হাবিবুর রহমান হাবিবকে গ্রেফতার করে ডিবি-মতিঝিল বিভাগ। একই সময় পৃথক অভিযানে বাড্ডা এলাকা থেকে আসলাম চৌধুরী ইমনকে গ্রেফতার করে ডিবি-গুলশান বিভাগের একটি টিম। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে নানাভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ও দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন বলে জানান এ কর্মকর্তা। এর আগে গত রোববার ৯ জন, সোমবার ১০ জন, মঙ্গলবার ৩ জন এবং তার আগে আরও দুই ধাপে ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা বিভাগ।