# ঋণ নিয়ে দেয়না, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন না, তারাই বড়লোক : জ¦ালানি উপদেষ্টা
# খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনের কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে : গভর্নর
# গ্যাস-বিদ্যুৎ চুরির দায় নিতে চাই না : সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত এক সেমিনারে বিশিষ্টজনরা অভিযোগ করে বলেছেন, আমাদের দেশে বড়লোক কারা? যারা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে দেয় না। সম্পদশালী কারা? যারা গ্যাস বিল দেয় না, বিদ্যুৎ বিল দেয় না। যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন না, তারাই মূলত এ দেশে বড়লোক । একই অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা বলেন টাকা পাচার ও বিত্তবান হওয়ার দৌড়ে কেবল ব্যবসায়ীরা নন, আমলারাও জড়িত।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়’। যৌথভাবে সেমিনারের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) । অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. আহসান এইচ মনসুর ছাড়াও প্রায় ৫০ জন শীর্ষ ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
সেমিনারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন না, তারাই মূলত এ দেশে বড়লোক।
দেশের বেসরকারি খাতের বিকাশকে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম (স্বজনতোষী পুঁজিবাদ) হিসেবে অভিহিত করে ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমাদের দেশের বেসরকারি খাত ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে যে আপনার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক থাকে। আমাদের দেশে বড়লোক কারা? যারা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে দেয় না। সম্পদশালী কারা? যারা গ্যাস বিল দেয় না, বিদ্যুৎ বিল দেয় না।’
তবে এই পরিস্থিতির জন্য তিনি এককভাবে ব্যবসায়ীদের দায়ী করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের জন্য আমি বেসরকারি খাতকে দোষ দেব না, আপনাদের দোষ দিতে চাই না সিস্টেমই ছিল এমন।’
উপদেষ্টা আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা মূলত পণ্য উৎপাদন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমেই সম্পদ গড়ে তোলেন। বেসরকারি খাতের জন্য আরও সুযোগ উন্মুক্ত করে দেবে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় কার্যকর করতে অর্থ ঋণ আইনের কিছু পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি ও ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হবে।
ড. আহসান বলেন, “প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দেশের জাতীয় সম্পদ। কোনো ব্যক্তির কারণে আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারি না। এসব প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান দিয়েছে। তবে আইনের নিয়ম অনুযায়ী যারা দায়িত্ব পালন করেননি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ব্যক্তিকে ছাড় দেব না, আইন সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। এই নীতি এখনও আমাদের মূলমন্ত্র। এ পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি।”
তিনি ব্যাংক খাতের বর্তমান সংকট নিয়ে বলেন, ‘সঙ্কট কাটাতে আমাদের অন্তত ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। তবে একবারে এত বড় অর্থ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আগামী অর্থ বছরের বাজেট থেকে প্রথম ধাপে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাতে সরবরাহ করা হবে। এতে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সহায়তা মিলবে এবং ব্যাংক খাত আরও মজবুত হবে।’
ড. আহসান দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘দেশে প্রচুর ছোট ব্যাংক রয়েছে, যেগুলোকে আমরা ‘লিলিপুট’ ব্যাংক বলি। এগুলো স্থানীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক আমরা তৈরি করতে পারিনি। এটি আগামী ২০ বছরেও সম্ভব নয়। তবে যদি সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়, ১০-১৫ বছরের মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানের একটি ব্যাংকে পরিণত হতে পারে।’
তিনি সভায় ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি সহায়তার গুরুত্বও আলোচনা করেন। গভর্নর বলেন, ‘আইনগতভাবে শক্ত ব্যবস্থা নিলে খেলাপি ঋণ হ্রাস পাবে। এতে ব্যাংক খাত আরও স্থিতিশীল হবে এবং বিনিয়োগকারীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিনিয়োগ করতে পারবে।’
জ¦ালানি উপদেষ্টার বক্তব্যের জের ধরে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, বাংলাদেশে বিত্তবান কারা হয়েছেন আমরা শুধু ব্যবসায়ীরা না, আমলারাও হয়েছেন। এ কথা বলা হয় না। টাকা পাচার আমলারা বেশি করেছেন। ব্যবসায়ীরা এ দায় নিতে চায় না। নাসিম মঞ্জুর আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ী যারা টাকা চুরি করে, গ্যাস চুরি, বিদ্যুৎ চুরি করে তাদের ধরেন। ওনাদের দায় আমরা নিতে চাই না।
জানা গেছে, দেশের সব বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থাকে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই প্রক্রিয়ার কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ সংক্রান্ত রোডম্যাপ [রূপরেখা] অনুমোদন দেওয়া হবে এবং এপ্রিল মাস থেকে তা বাস্তবায়ন শুরু হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বা শিল্প স্থাপন-সংক্রান্ত কার্যক্রমে বিডা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ এবং হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষসহ একাধিক সরকারি সংস্থা কাজ করছে।
এর মধ্যে বেজা, বেপজা ও হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে শিল্প প্লট বরাদ্দ দিয়ে থাকে। ফলে জমির জন্য বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়, যা একদিকে জটিল এবং অন্যদিকে সময়সাপেক্ষ। এই পরিস্থিতিতে সরকার ‘সেন্ট্রাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি’ (আইপিএ) বা কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থা গঠনের মাধ্যমে সব সংস্থাকে একীভূত করার পরিকল্পনা করেছে।
বিডার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে একাধিক সংস্থা মূলত একই ধরনের কাজ করছে। এককভাবে বিনিয়োগকারীদের সব চাহিদা পূরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সংস্থাগুলো একীভূত হলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ সহজ হবে, নীতি-নির্ধারণ আরও শক্তিশালী হবে এবং কর্মকর্তাদের কারিগরি দক্ষতা ও তথ্য-উপাত্তের সমন্বয় বাড়বে।