সাদিক আল আরমান, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট-ওয়েস্টের শিক্ষার্থী। তিনি জুলাই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন অগ্রভাগে থেকে। পরবর্তীতে তিনি নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দৈনিক সংগ্রামকে শুনিয়েছেন আন্দোলনের গল্প। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : জুলাই আন্দোলনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা অনন্য ছিল। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন বন্ধ করে দেওয়া হলো তখন আন্দোলনের হাল ধরে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়গুলো। কিভাবে আপনারা আন্দোলনে যুক্ত হলেন?
সাদিক আরমান : আপনি জানেন যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতীয় আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয় না। কিন্তু কোটা আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একটা অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
দৈনিক সংগ্রাম : এটা কয় তারিখ থেকে?
সাদিক আরমান : ৫ জুন থেকেই আমরা সম্পৃক্ত ছিলাম। যারা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আন্দোলনের পলিসি মেইকার তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীতে ১০ জুলাই সম্মিলিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে একটা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার পর। সেদিন সকালে টিএসসিতে আমরা ছিলাম। আগের দিন রাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ১৬ জুলাই যে সমাবেশ হয় তাতে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বিশাল একটা সংখ্যা অংশগ্রহণ করে। কয়েকশ’ হবে। ১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজাতেও একটা বড় সংখ্যায় প্রাইভেট ভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলো।
দৈনিক সংগ্রাম : ঠিক কি কারণে আপনারা আন্দোলনে অংশ নেন?
সাদিক আরমান : মূলত আমাদের আন্দোলনের কারণ ছিল আমরা কোটা বা সরকারী চাকরির জন্য অংশগ্রহণ করিনি। আমরা অংশগ্রহণ করেছি শহীদ ভাইদের বিচারের দাবিতে। জাস্টিস এবং মৌলিক গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং ফ্যাসিজমের অবসানের জন্য। কথা বলার স্বাধীনতা, ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ফ্যাসিবাদের কারণেই আমরা বিরক্ত ছিলাম। প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্রদের আন্দোলন চাকরি কিংবা কোটার জন্য ছিল না। কারণ ছিল মুক্তি। ঠিক এই কারণে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। আপনি জানেন যে সারাদেশে সরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে যখন আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায় তখন রাতের বেলা আমরা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যারা আন্দোলন পরিচালনা করছিল তাদের সাথে বসি। তাদের সাথে আলাপ করে ১৮ তারিখ থেকে আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করি। এই আন্দোলনে দল মত নির্বিশেষে আন্দোলনে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে এবং আন্দোলন সফল করে।
দৈনিক সংগ্রাম : আমি একটু পিছনের দিকে যাবো, ঢাকা ভার্সিটিতে হামলা হলো ১৫ জুলাই। হত্যাকা- শুরু হলো ১৬ জুলাই। ১০ তারিখে কখন কিভাবে কোন প্রেক্ষাপটে বিক্ষোভ করলেন ?
সাদিক আরমান : আমরা প্রথমে ঢাকা ভার্সিটি রিলেটেড আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ১০ তারিখে আমরা বাংলা ব্লকের যে কর্মসূচি, এর সাথে সংহতি জানিয়ে রামপুরা ব্রিজে অবস্থান নেই।
দৈনিক সংগ্রাম : সময়টা কখন ?
সাদিক আরমান : সকাল ১১টার দিকে।
দৈনিক সংগ্রাম : তখন আপনাদের নেতৃত্বে কারা ছিলেন? কারা ভূমিকা পালন করেন? তখন প্রশাসনের ভূমিকা কেমন ছিল?
সাদিক আরমান : ওই দিন ছিল আমাদের শো ডাউন। তখন নেতৃত্বে আমাদের বায়জিদ ছিল। ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী বায়জিদ আন্দোলনের সমন্বয় করেন। তাতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রদলসহ সবগুলো দলের লোকজন ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : ১৮ জুলাই আপনারা রাস্তায় নামলেন প্রাইভেট ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। সেদিনের কথা যদি বলেন।
সাদিক আরমান : ১৮ জুলাই আমাদের কাছে ছিল বিভৎস একটা দিন। সেদিন সকাল থেকে নিজেরা সংগঠিত হতে শুরু করি। সেখানে ছাত্রলীগ, যুবলীগ পুলিশ সবাই মিলে আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। গুলী করে। তাতে আমাদের শত শত সহপাঠি, সহযোদ্ধা রক্তাক্ত হয়, আহত হয়। আমার সামনেই কয়েকজন ভাই শহীদ হয়। এরমধ্যে শহীদ জিল্লুরের মৃত্যু নিজ চোখে দেখেছি। তার রক্তমাখা লাশটা আমার হাতে ছিল। সে আমার হাতের ওপর মারা যায়। ঘটনা বাড্ডা পুলিশ ফাঁড়ির সামনের। জিল্লুর বলছিল তোমরা আগে যাও। তোমাদের পেছনে আমরা যাবো। আসলে আমাদের প্রস্তুতির বিষয় ছিল। লাঠিছোটা, ঢিলা এসব জোগাড়ের বিষয় ছিল। আমরা যখন এসবে ব্যস্ত ছিলাম তখন জিল্øুর এগিয়ে যায় এবং ডেড শট করে পুলিশ। মাথায় গুলী করে। জিল্লুর মারা যায়।
দৈনিক সংগ্রাম : এরপর সারাদিনের আন্দোলনের কথা বলুন।
সাদিক আরমান : এরপর সারাদিন কয়েক দফা সংঘর্ষ হয় আমাদের সাথে পুলিশ, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের। চৌধুরীপাড়া হয়ে বিটিভির সামনে ওরা অস্ত্র ও লাঠিসোঠা নিয়ে অবস্থান করে। পাশাপাশি বিটিভির সামনে থেকে পুলিশ সরাসরি গুলী করে। সেই সময় আমাদের ভাইয়েরা অকাতরে হতাহত হন। বাদ যায়নি রাস্তার শিশুরাও। আমরা সারাদিন সারাসন্ধ্যা সেখানে ফাইট করি। আমাদের সেখানে যারা আহত হন তারা মেডিকেলে ভর্তি হন। আমরা নিজেরা গুলীবিদ্ধ হই। রক্ত বমি হয়। আমি ঘ্রাণশক্তি হারাই ২৪ দিনের জন্য।
দৈনিক সংগ্রাম : রামপুরা ইস্টওয়েস্টের সামনের আন্দোলনে আর কারা অংশ নিলো?
সাদিক আরমান : ফ্যাসিবাদী বিরোধী যত শক্তি সক্রিয় ছিল সবাই এই আন্দোলনে অংশ নেয়। বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, ছাত্রশিবির, পাশাপাশি বামদলগুলোও আন্দোলনে জড়িত ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আর কোন প্রাইভেট ভার্সিটি অংশ নিয়েছিল?
সাদিক আরমান : সব ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিল। কারণ আমরা সবার সাথে সমন্বয় করেই আন্দোলনটা করেছিলাম। এজন্য ১৮ তারিখ সকাল থেকেই এই স্পটে ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : তার মানে আগেই প্ল্যান ছিল?
সাদিক আরমান : ১৭ তারিখ রাতের বেলায় প্লান হয়।
দৈনিক সংগ্রাম : কিভাবে প্ল্যানটা হয়?
সাদিক আরমান : ঢাবির হলগুলো যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেদিন ঢাকা ভার্সিটির সমম্বয়কদের সাথে যোগাযোগ হয়। আমাদের একটা ওয়াটস অ্যাপ গ্রুপ ছিল। পাশাপাশি সাদিক কায়িম ভাই, তিনিও সমন্বয়ক ছিলেন। তার সাথে আমাদের গোল টেবিল বৈঠক হয়, অনলাইনে মিটিং হয়। অনলাইনের মিটিং নর্থসাউথ, ব্র্যাক, আইইউএবিসহ প্রত্যেকটি বিশ^বিদ্যালয় থেকে আন্দোলনে অংশ নেয়। পাশাপাশি শিবিরের, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক এবং অন্যান্য যারা ছিল তারাও ছিলেন সেদিন। শিবিরের প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় শাখার সভাপতি সেক্রেটারি রেজাউল করিম সিদ্দিকী, জাহিদুল ইসলাম তারাও ছিল। সেখান থেকে আগামী দিনে কি হবে, কিভাবে আন্দোলনটা শুরু হবে সেই দিকনির্দেশনা বা একটা গাইডলাইন তৈরি করা হয়। পাশাপাশি আমাদের যত পেইজ ছিল, ফেক আইডি ছিল, ওয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জারগ্রুপ, পাশাপাশি ফেসবুক গ্রুপ, ইউনিভার্সিটির জন্য তৈরি করা গ্রুপগুলোতে প্রচারণা চালাই। আমরা ব্যক্তিগত আইডি থেকেও প্রচারণা চালাই। সেইসাথে অভয় দিই যে, তাদের আমরা আশ্রয় দেবো। আমরা থাকার জন্য অনেকগুলো বাসা ভাড়া করি। পাশাপাশি আরেকটা কাজ করি, সেটা হলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখি। আমরা মধুবাগ থেকে লাঠি সোটা নিয়ে আসি। এক হাজার প্লাস্টিকের পাইপ, কেউ কেঊ ইট এবং কংক্রিট পর্যন্ত নিয়ে আসে। রাতের বেলায় এগুলো সিএনজিতে ভরে রাখি। সকাল বেলায় সেগুলো নিয়ে স্পটে চলে আসি।
দৈনিক সংগ্রাম : সেদিনের একটা স্মৃতির কথা বলেন।
সাদিক আরমান : সেদিন দুপুর আড়াইটার দিকে, একজন অপরিচিত মহিলা আমার মায়ের বয়সি, পলি ব্যাগে করে খিচুড়ি নিয়ে এলেন এবং আমাকে খিচুড়ী খাইয়ে দেন।
দৈনিক সংগ্রাম : দিন শেষে কি জানতে পারেন, কত জন হতাহত হয়?
সাদিক আরমান : এটা ফিক্সড বলা সম্ভব না। তবে হতাহতের সংখ্যা কয়েকশ’ হতে পারে। এখন পর্যন্ত প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি। অনেকে শহীদ হয়েছে। অনেকে আন্দোলন শেষে ক্লাসে ফিরে গেছে। আমরা মূলত একটা নতুন বাংলাদেশ চেয়েছি। আমরা ক্ষমতা চাইনি।
দৈনিক সংগ্রাম : আন্দোলনের পর এক বছরের মূল্যায়ন বলেন।
সাদিক আরমান : আমরা হাসিনা রেজিমের চেয়ে ভাল আছি। কিন্তু যে আশা আকাঙ্খা এবং প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম তা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এই সরকার আমাদের রক্তের ওপর বসা। এটা আমাদের জন্য বড় সুযোগ, যদি আমরা নতুন করে ফ্যাসিবাদ ঠেকাতে না পারি, শহীদের রক্ত এবং যারা আহত হয়েছে তাদের রক্তের সাথে বেঈমানি করা হবে।