ঈদুল আজহার টানা ছুটিতে রাজধানীসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল তুলনামূলক ভালো। ঈদের ছুটির সুযোগে অপরাধীরা ফাঁকা ঢাকায় চুরি, ডাকি, দস্যুতা, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে। এবার যেহেতু সরকারি ছুটি ছিল টানা ১০ দিন। তাই জনমনে কিছুটা হলেও উদ্বেগ ছিল। সে তুলনায় আইনশৃঙ্খলা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেকটাই স্বস্তি ছিল বলে জানিয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
কুরবানির ঈদে পশুর মার্কেট কেন্দ্রিক মৌসুমী অপরাধীরাও এসময় রাজধানীতে এসে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে। অজ্ঞান ও মলম টার্টির তৎপরতা বাড়ে লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড ও ট্রেনস্টেশন এভং গরুর হাটে। পুলিশ ও র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগে থেকেই তাদের ব্যপক প্রস্তুতি থাকায় অপরাধীরা সুযোগ নিতে পারেনি। ঈদের আগে ঢাকায় তিন স্তরেরসহ দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত ছিল। এমনকি ঈদকে কেন্দ্র করে এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ছুটিও বাতিল করে অনডিউটিতে রাখা হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেনি। এদিকে ঈদুল আজহা উপলক্ষে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সোমবার দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের টানা ছুটিতে অধিকাংশ এলাকাই ছিল ফাঁকা। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। নেই চিরচেনা যানজট ও কোলাহল। যেন এক অচেনা নগরী। কারণ আপনজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে গত কয়েকদিন থেকেই ধাপে ধাপে গ্রামে চলে গেছেন নগরবাসী। শনিবার ঈদুল আজহার দিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, রাজধানীজুড়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্বে থাকছেন। পাশাপাশি মাঠে রয়েছে র্যাব, সেনাবাহিনী, আনসার সদস্যসহ ৭৫০টির বেশি টহল দল ও শতাধিক চেকপোস্ট। নানা অপরাধ ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নজরদারি। ঈদ ঘিরে কোরবানির হাট, শপিংমল, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশনগুলোতে তৎপর রয়েছে নিরাপত্তাবাহিনী। ছিনতাই, মলম পার্টি ও জাল নোটের কারবার ঠেকাতে র্যাব ও পুলিশ কড়া নজরদারির কথা জানিয়েছে। গত ঈদুল ফিতরের নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তার কারণে রাজধানীতে বড় কোনো অপরাধের ঘটনা না ঘটায় সেই নিরাপত্তাব্যবস্থাকে আদর্শ ধরে এবারের ঈদুল আজহায়ও রাজধানীতে নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছে। তবে গত ঈদের চেয়ে রাজধানীতে এবারের ঈদের নিরাপত্তায় টহল ও চেকপোস্টের সংখ্যা আরো বাড়ানো হয়। সঙ্গে পশুর হাট ও আবাসিক এলাকার জন্য দুই ভাগে নিরাপত্তার আয়োজন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। অন্যদিকে অজ্ঞান পার্টিসহ প্রতারকচক্রের ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ও অপরাধ দমনে অধিকতর সফল হওয়া সম্ভব বলে জানায় পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক বিজ্ঞপ্তিতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকাবাসীকে ১৮টি নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ জানায়। এছাড়াও দীর্ঘ ছুটিতে ফাঁকা রাজধানীতে চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধের আশঙ্কা থাকায় ৯৯৯ নম্বরও ছিল প্রস্তুত। ঈদের ছুটিতে রাজধানী ফাঁকা হয়ে যাওয়ার কারণে আবাসিক এলাকায় টহল বৃদ্ধি ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়। এ ছাড়া অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, জাল টাকার কারবারিদের গ্রেপ্তারে বিশেষ নজর দেওয়া হয়।
ঈদুল আজহায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার পাশাপাশি ঈদকেন্দ্রিক যাতায়াত, পশুবাহী যানবাহন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধ, চামড়া পাচার রোধ এবং ‘ফাঁকা’ ঢাকায় নগরবাসীর নিরাপত্তায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিশেষ সময়ে সেনাবাহিনীর বাড়তি নজরদারি, টহল, চেকপোস্ট ও অভিযান অব্যাহত আছে। পাশাপাশি র্যাব, হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশও বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে ঈদের ছুটিকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায়। রাজধানী ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের শহর এলাকাতে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ঈদকেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে সব ইউনিটকে বিশেষ নজরদারিসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঈদে ঘরমুখী মানুষের চলাচল, কোরবানির পশুর হাট ঘিরে যে ধরনের অপরাধ ঘটে থাকে, সেসব বিষয়ে নাগরিকদের সচেতন করতে নানাভাবে চেষ্টা চলছে। বিশেষ প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক নিকটস্থ পুলিশকে অথবা জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে কল করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশ সংঘবদ্ধ অপরাধী ও প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে সজাগ রয়েছে। জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। ঈদকেন্দ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে সারা দেশে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। র্যাবের কন্ট্রোলরুম, মোবাইল প্যাট্রোল, ক্যাম্প, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, চেকপোস্ট এবং সিসিটিভি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ঈদে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বড়ধরণের কোনো কিছু ঘটার খবর পাওয়া যায়নি। তারপরও র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি ও সাইবার মনিটরিং বাড়ানোর মাধ্যমে যেকোনো ধরনের অপরাধ দমনে র্যাব সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। সাদাপোশাকে গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি টহল, প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ, চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযানসহ সার্বিকভাবে রাজধানীবাসীর নিরাপত্তায় কাজ করছে পুলিশ। তিনি জানান, ঈদের আগের ব্যবস্থাপনায় রাজধানী ঢাকা থেকে বের হওয়া এবং ঢাকায় বা প্রবেশপথগুলো যানজটমুক্ত রাখা, টার্মিনালকেন্দ্রিক ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, টার্মিনাল ও পশুর হাটকেন্দ্রিক অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও জাল নোটের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান চলছে।
এর আগে ৬ জুন জাতীয় ঈদগাহের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, সারাদেশে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। তারাও ছুটিতে যাননি সবার নিরাপত্তা দিতে। ঈদের সময়ে চুরি ছিনতাই বেড়ে যায়। ফাঁকা ঢাকায় কেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রাজধানীর নিরাপত্তায় ৫০০ পেট্রোল টিম কাজ করবে। তারা অলিগলিতেও কাজ কাজ করবে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীবলেন, এই ঈদে সার্বিকভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো ছিল। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্য কোথাও বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া গোটা দেশেই শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ উদযাপন হয়েছে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। পরিদর্শনের সময় তিনি যাত্রাবাড়ী থানার বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন। থানার ডিউটি অফিসারের ডেস্ক, নারী ও শিশু সহায়তা ডেস্ক, হাজতখানা, পুলিশ সদস্যদের থাকার স্থান ও খাবারের মান পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছাও বিনিময় করেন। ঈদুল আজহা এবং পরবর্তী ছুটির সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাজধানীর বিভিন্ন থানায় সরেজমিনে যাচ্ছেন। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে সোমবার তিনি যাত্রাবাড়ী থানায় যান। তিনি আরও জানান, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই ঈদের সময় দেশের মানুষ নির্বিঘ্নে আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছেন।
গলাকাটা লাশ উদ্ধার: রাজধানীর পল্লবীতে রাকিবুল ইসলাম সানি ওরফে পেপার সানি নামে এক যুবকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খবর পেয়ে পল্লবী থানাধীন মিল্লাত ক্যাম্প থেকে নিহতের লাশহ উদ্ধার করে পল্লবী থানা পুলিশ। পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল ইসলাম জানান, সকালে খবর আসে পল্লবী থানাধীন মিল্লাত ক্যাম্পে একটি রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার ও সুরতহাল করা হয়। নিহত যুবক শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পরিহিত ছিল। পা ছিল গামছায় বাধা। গলা ছিল কাটা ও রক্তাক্ত। ময়না তদন্তের জন্য লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ওসি বলেন, নিহত পেপার সানির বিরুদ্ধেও পল্লবী থানায় মাদকসহ ৫ টি মামলা রয়েছে।