গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী একনায়কদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন বলে উল্লেখ করেছেন প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনকালে এ মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি।
এদিন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সূচনা বক্তব্যে উপস্থাপন করেন। এসময় শেখ হাসিনাকে বিশ্বব্যাপী একনায়কদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন বলে আখ্যায়িত করে প্রসিকিউশন। এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৮ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।গতকাল প্রসিকিউশনের পক্ষে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ান, সহিদুল ইসলাম ও মামুনুর রশীদ। সূচনা বক্তব্যে মামলার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার পাশাপাশি সাক্ষীর তালিকা, অডিও-ভিডিও, পত্রপত্রিকার তথ্যপ্রমাণের বিবরণ দেন। একইসঙ্গে এ অপরাধের দায়মুক্তির সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন। তবে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ করার কারণে যেন বিচার না হয়; এমন আর্জি জানান আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় মোট সাক্ষী ৩৮ জন। এর মধ্যে শহীদ পরিবারের ৮, প্রত্যক্ষদর্শী ৮, আহত ৮, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৬, পুলিশ ১, সাংবাদিক ১, জব্দ তালিকা ২, বিশেষজ্ঞ ২, বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ১ ও মূল তদন্ত কর্মকর্তা ১ জন রয়েছেন। এদিন প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের কথা থাকলেও প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৮ ডিসেম্বর নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
হানিফ ছাড়া বাকি তিন আসামি হলেন- কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান, জেলা সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, বিশ্বে একনায়ক এবং গণহত্যাকারী স্বৈরশাসকদের অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। সে তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। আমরা তার দোসরদের বিরুদ্ধে আজ আপনাদের কাছে ন্যায়বিচারের দাবি নিয়ে এসেছি।
তিনি বলেন, আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই, যুগে যুগে বিশ্বে স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হয়েছে। দেশে দেশে নিষ্ঠুর একনায়কের জন্ম হয়েছে। আমরা অ্যাডলফ হিটলারের নাম শুনেছি। মুসোলিনি, ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, পিনোশে, মার্কোসের নাম শুনেছি।
মিজানুল ইসলাম আরও বলেন, নীলনকশার নির্বাচন, লাইলাতুল ইলেকশন এবং আমি-ডামির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরে বিগত ১৭ বছরে বাংলাদেশের মাটিতে খুন, গুম, রাজনৈতিক নিপীড়নের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল, আজ তার চির অবসানের জন্য এই বিচার। আমরা চাই এই বিচার জাতির সভ্যতার ঐতিহাসিক যাত্রাপথে এক উজ্জ্বল মাইলস্টোন হিসেবে স্থান পাক, যাতে আগামীর বাংলাদেশে কেউ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের সাহস না দেখায়।
এই প্রসিকিউটর বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখেছি অনেক স্বৈরাচার পালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের স্বৈরশাসক পালিয়েই শুধু যাননি, তার ৩০০ এমপি, তার কেবিনেট, এমনকি কিছু বিচারক যারা নিজেদের শপথবন্ধ রাজনীতিবিদ বলে দাবি করতেন- তারাও পালিয়েছে।
এই বিচার কেবল একটি মামলার নিষ্পত্তি নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী বার্তা। এই জাতি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সে যত শক্তিশালী বা প্রভাবশালী হোক না কেন। এই বিচার হবে একটি ইতিহাস। এটি হবে সেইসব মানুষের আত্মত্যাগের সম্মাননা, যারা ন্যায়বিচারের এবং ভয়ভীতিহীন একটি সমাজের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এই ট্রাইব্যুন্যাল প্রমাণ করবে যে, বাংলাদেশ একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক এবং আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রাষ্ট্র।
প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে বলা হয়, আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, এই মামলায় নিরপেক্ষ, নির্ভুল এবং দৃঢ় বিচার নিশ্চিত করুন। দোষীদের যথাযথ শাস্তি দিন, যাতে জনগণের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে আসে। এ বিচার কেবল অপরাধীর শান্তি প্রদান নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা- অপরাধী যত বড়ই হোক, বিচারের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে।
প্রসিকিউটর মিজানুল বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশ কর্তৃক নিরীহ ও নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলীবর্ষণ, বেআইনি আটক ও নিপীড়নমূলক গ্রেফতার, নির্যাতন, অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর ধংসের কফিন ফ্যাসিস্ট সরকার প্রস্তুত করেছিল। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, কুষ্টিয়া সদর মডেল থানা এলাকায় আন্দোলনরত নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে ৬ জনকে হত্যা ও অনেককে গুরুতর আহত করে।
উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়। তাদের গুলীতে শহীদ হন শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম, সুরুজ আলী বাবু, শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মুস্তাকিন, উসামা, ব্যবসায়ী বাবলু ফরাজী ও চাকরিজীবী ইউসুফ শেখ। আহত হন বহু নিরীহ মানুষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই চারজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। পরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।