বড় ভূমিকম্পের শঙ্কায় বাংলাদেশ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ এই চারটি অঞ্চল ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে। এ অবস্থায় সতর্কতামূলক একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (এফএসসিডি) অধিদফতরও মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের পর বাংলাদেশেও একইমাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ওই দুই দেশের ঘটনায় বাংলাদেশেও ঝুঁকি বেড়ে গেল।
জানা গেছে, ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে দেড় হাজার মানুষ মারা যান।
যোগাযোগ করা হলে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, এখন আমাদের ভূমিকম্প থেকে বাঁচার সকল প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এর জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। জনগণকে ব্যাপকভাবে সচেতন করে তোলার বিকল্প নেই। মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। আর দরকার নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করা।
শুক্রবার মিয়ানমারে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে গতকাল শনিবার পর্যন্ত এক হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর দিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের এক মডেলে মিয়ানমারে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়াতে পারে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ওই ভূমিকম্পের ধাক্কায় থাইল্যান্ডেও বেশকিছু স্থাপনা বিধ্বস্ত এবং কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে ঢাকার ৫৬% ভবন : ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে এমন শীর্ষ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ, অপ্রশস্ত সড়ক অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবই এ ঝুঁকি তৈরি করেছে। মাঝারি থেকে প্রবল মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী। সাম্প্রতিক সময়ে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা শহরে যত কংক্রিটের ভবন বিদ্যমান তার ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ রয়েছে ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকির মধ্যে। মাঝারি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ৩৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন। রিখটার স্কেলে ৪ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে এসব ভবন। আর তুরস্ক ও সিরিয়ায় সম্প্রতি যে মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে ঢাকার ৮০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) জিআইএস ডাটাবেজ থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৯৩টি ভবনের তথ্য নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছে এইচবিআরআই।
গবেষণায় উঠে এসেছে, বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঝুঁকিতে থাকা ৭ শতাংশ ভবন ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে ৩১ শতাংশ ভবনের। অন্যদিকে প্রায় ৪০ শতাংশ ভবনের ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। যেসব ভবনের উচ্চতা বেশি, সেগুলো রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
বড় ধরনের ভূমিকম্পে ধসে পড়ার উচ্চঝুঁকি রয়েছে, এমন ভবনের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। এসব ভবনকে ‘ই’ ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হয়েছে এইচবিআরআইয়ের গবেষণায়। ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে ধসে পড়ার মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ ভবন। ক্ষতি হলেও ধসে পড়বে না এমন ভবনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘সি’ ক্যাটাগরিতে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পরিমাণ ৪৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৪৮টি ওয়ার্ডে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ভবনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ‘খুব উচ্চঝুঁকি’র মধ্যে রয়েছে ১, ৩, ৭, ১২, ১৪, ২২, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড। আর ‘উচ্চঝুঁকি’র মধ্যে রয়েছে ২, ৫, ১১, ১৩, ১৬, ১৮, ১৯, ২১, ২৩, ২৫, ২৬ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ‘খুব উচ্চঝুঁকি’র মধ্যে রয়েছে ১, ১২, ১৩, ১৬, ১৭, ২৩, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩০ ও ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড। আর ‘উচ্চঝুঁকি’র মধ্যে রয়েছে ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১৫, ১৯, ২৭, ৩৯, ৪৫, ৪৭ ও ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড।
চট্টগ্রামে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আড়াই লাখ ভবন : দেশের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার অন্যতম বন্দর নগর চট্টগ্রাম। মিয়ানমারের মতো বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এই অঞ্চলের প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম নগরে থাকা ৩ লাখ ৮২ হাজার ভবনের মধ্যে ২ লাখ ৬৭ হাজার ভবন কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চট্টগ্রামে ভূমিকম্পে ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নিয়ে এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আইন-বিধি না মানা, নকশা না মেনে ভবন করা এবং গুণগত মানসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণসামগ্রী ব্যবহার না করার কারণে বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো ও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যত কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই বলেও দাবি তাঁদের।
সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে ৬ দশমিক ৯৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নগরে ১২টি ভবন হেলে পড়েছিল। এর আগে ১৯৯৭ সালের ২১ নবেম্বর ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম নগরে পাঁচতলা ভবন ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল।
সিডিএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১১টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একতলা ভবন রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫টি। ২ থেকে ৫ তলাবিশিষ্ট ভবন রয়েছে ৯০ হাজার ৪৪৪টি। ৬ থেকে ১০তলা পর্যন্ত ভবনের সংখ্যা ১৩ হাজার ১৩৫। ১০তলার ওপরে ভবন রয়েছে ৫২৭টি। নগরে এখন ২০তলার বেশি ভবন রয়েছে ১০টি। এই বিপুলসংখ্যক ভবন নির্মাণ করা হলেও এগুলোর অধিকাংশই ইমারত বিধিমালা মানেনি।
ঢাকা কতটা প্রস্তুত? : সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকা ২০০৯ সালে এক যৌথ জরিপ চালিয়ে জানিয়েছিল, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে; এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর কেটে গেছে ১৫ বছর। এই সময়ে নিয়ম না মেনে গড়ে তোলা ভবনের সংখ্যা কেবলই বেড়েছে। ভূমিকম্পের মত দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমানো বা উদ্ধার তৎপরতার প্রস্তুতি এগোয়নি খুব একটা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মত দুটি উৎস আছে। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের সাবডাকশন জোন এবং ডাউকি ফল্ট, যার পূর্বপ্রান্ত সুনামগঞ্জ থেকে জাফলং পর্যন্ত বিস্তৃত। এ দুটি উৎস থেকে যে কোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। সাবডাকশন জোনে ইন্ডিয়া প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি গত ৮শ থেকে হাজার বছর সেখানে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তার মানে যে শক্তি জমা হয়ে আছে, তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে ৮ দশমিক ২ বা বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে। আর ডাউকি ফল্টের ওই এলাকায়ও চার থেকে পাঁচশ বছর কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। সেখানে সাত থেকে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। আজ, কাল বা ৫০ পর হোক, ভূমিকম্প একদিন হবেই।
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভূমিকম্পের এ দুটি উৎসের খুব কাছে দেশের কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র এবং বড় বড় শিল্প স্থাপনা রয়েছে। রাজধানী ঢাকাও উৎসের খুব কাছে। ফলে তার ভাষায়, ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ানোর জন্য যতগুলো উপাদান দরকার, তার সবগুলোই এখানে উপস্থিত। ঢাকায় ৬ লাখের বেশি ইমারত আছে। এদের ৬৬ শতাংশই নিয়ম মেনে হয়নি, ঝুঁকিপূর্ণ। বড় ধরনের ভূমিকম্প যদি হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতিটা এখানেই বেশি হবে। একটা মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। ঢাকা যেভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে রাতারাতি পরিবর্তন করে ফেলা যাবে না। এ কারণে এই ঝুঁকি সহজেই কমার সুযোগ নেই।
ফায়ার সার্ভিসের একগুচ্ছ পরামর্শ: গতকাল শনিবার ফায়ার সার্ভিসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশেও একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশেষত চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা অঞ্চল উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় ভূমিকম্প মোকাবেলায় জন্য পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য ফায়ার সার্ভিস কিছু পরামর্শ দিয়েছে- বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ। ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা। ইউটিলিটি সার্ভিসের মধ্যে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইনের সঠিকতা নিশ্চিত করা। ভূমিকম্প চলাকালীন সময়ে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত মহড়া অনুশীলন ও প্রচারের ব্যবস্থা করা। জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন- ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসাপাতাল ও অন্যান্য জরুরি নাম্বারসমূহ ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সকল ভবন বা স্থাপনায় সংরক্ষণ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখা। ভলান্টিয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দুর্যোগকালীন সময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা। জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সরঞ্জামাদির মধ্যে টর্চলাইট, রেডিও (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ), বাঁশি, হ্যামার, হেলমেট- কুশন, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ঔষধ সামগ্রী, ফার্স্ট এইড বক্স, শিশু যতেœর সামগ্রী ইত্যাদি বাসা-বাড়িতে নির্ধারিত স্থানে সংরক্ষণ করা যাতে ভূমিকম্প পরবর্তীতে আটকা পড়লে তা ব্যবহার করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যায়। সকল পর্যায়ে তদারকি সংস্থার কার্যক্রমে সহযোগিতা করা।