জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজধানীর সড়কগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও আলেমরাও। বিশেষ করে সেখানে মাদরাসার শিক্ষার্থী ও আলেম সমাজ আত্মত্যাগ ও অদম্য সাহসিকতা দেখিয়েছেন। ৩৬ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়ক ভিজে উঠেছিল মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র ও আলেমদের রক্তে। এই স্মৃতি, সংগ্রাম, প্রতিরোধের বীরত্বগাঁথা ও আত্মত্যাগকে স্মরণ করতেই গতকাল সোমবার প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় মাদরাসা রেজিস্ট্যান্স ডে-২০২৫। মাদরাসা রেজিস্ট্যান্স ডে-২০২৫ অনুষ্ঠানে জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা, আহত জুলাইযোদ্ধা এবং কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার জুলাইযোদ্ধারা বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি; গণহত্যার বিচার ও জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররাও জুলাই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দমনপীড়নে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও আলেমরাও কোনো অংশে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। হাজার হাজার মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও আলেম জুলাই আন্দোলনে আহত এবং শকাধিক শহীদ হয়েছে। তাই জুলাই ঘোষণাপত্রে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অবদানের স্পষ্ট স্বীকৃতি দিতে হবে। জুলাই সনদে কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের অবদান স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
গতকাল সোমবার বিকেলে যাত্রাবাড়ীর ইবনে সিনা হাসপাতালের পাশে জামিয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসা উত্তর কাজলা সংলগ্ন রাজপথে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে দিবসটি পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তারা এই দাবি জানান। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রালয়ের উপদেষ্টা মো: মাহফুজ আলম, দৈনিক আমারদেশ সম্পাদক মো: মাহমুদুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টা প্রেস সচিব শফিকুল আলম, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা, আহত জুলাইযোদ্ধা এবং কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার জুলাইযোদ্ধারা।
ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশের ছাত্রসমাজসহ আপামর জনসাধারণ অংশ নিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও জুলাই বিপ্লবে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শতাধিক মাদ্রাসার ছাত্র, আলেম ও হাফেজ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছে। ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভূমিকা যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়নি। তিনি গণমাধ্যমকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরার অনুরোধ জানান।
আহত জুলাইযোদ্ধা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, এ আন্দোলনে যারা আহত হয়েছে তাদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য সরকার কাজ করছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যক্তিবর্গ আহতদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মাদ্রাসার আলেম ও শিক্ষার্থীদের ওপর ট্যাগ দিয়ে ইসলাম বিদ্বেষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতীতের ফ্যাসিস্ট শাসনামলে আলেম ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ভয়ের মধ্যে দিন কাটিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, যারা যাত্রাবাড়ীতে শহীদ হয়েছে এবং আহত হয়েছেন তাদের স্মরণে আজকে রেজিস্ট্যান্স ডে পালন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ভাবে। এভাবে প্রতিবছর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অবদানকে স্মরণ করে মাদরাসা রেজিস্ট্যান্স ডে পালন করা হবে। ২০২১ সালে মোদী বিরোধী আন্দোলনে এবং ২০১৩ শাপলা চত্বরে হেফাজতের অন্দোলনের সময় অনেক আলেম ও মাদ্রাসার ছাত্রদের হত্যা করা হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১০০ উপরে শহীদ হয়েছে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও আলেম এবং হাফেজ। মাদ্রাসা শিক্ষা হলো একটি আখলাক গঠন করার কেন্দ্র। মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের এই আখলাকই প্রেরণা ও সাহস দিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য। মাদ্রাসা ছাত্রদের ট্যাগ দিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনকালে অনেক জুলুম করা হয়েছে। যেকোনো জুলুমের বিরুদ্ধে মাদ্রাসা ছাত্র প্রতিরোধী ভূমিকা রাখতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মাদ্রাসার ছাত্রদের অনেক বড় ভূমিকা ছিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, মাদ্রাসার ছাত্ররা আন্দোলনে অসম্ভব অবদান রেখেছে। প্রচুর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আন্দোলনের মাঠে নেমেছিলেন। হাসিনার আমলে তাদের ওপর ভয়াবহ রকমের অত্যাচার হয়েছে। তাদের সঙ্গে যেন আর কোনো বৈষম্য না হয় আমরা সেই চেষ্টা করছি। প্রেস সচিব বলেন, যে প্রত্যাশাকে সামনে রেখে জুলাই বিপ্লব হয়েছিল, তা ব্যাহত হয়নি। জন-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করে যাচ্ছে। স্বৈচারারী হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসার চাত্র-শিক্ষকদের সাহসী অবদানের কথা রাষ্ট্র স্বীকার করে আর এই কারণেই আজকে মাদ্রাসা রেজিস্ট্যান্স ডে পালিত হচ্ছে। দেশের উন্নয়নে মাদ্রাসার ছাত্রদের আরও ভূমিকা রাখতে হবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসার ছাত্রদের অবদান সম্পর্কে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ১৫ বছর ধরে দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এমন কোন সেক্টর নাই সে (হাসিনা) ধ্বংস করেনি। ফ্যসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৩ সাল থেকে। তখন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছিল। আলেমদের অবদান বাংলাদেশের কোন মিডিয়ায় এ পর্যন্ত সেভাবে তুলে ধরেনি, যেভাবে তুলেধরা উচিত ছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসার ছাত্রও শিক্ষকরা সাহসী ভূমিকা রেখে ছিল বলেই আজকে আমরা ফ্যাসিস্ট মুক্ত হতে পেরেছি।
মাহমুদুর রহমান বলেন, আমার দেশ পত্রিকা এদেশের আলেমদের নিয়ে গণমাধ্যমের বৈষম্য রুখে দিয়েছে। আমার দেশ নিয়মিত আলেমদের উপর ফ্যাসিস্ট হাসিনা আমলের নির্যাতনের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরছে। এবং তুলেধরছে ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাদ্রাসার ছাত্রও আলেমদের আত্মত্যাগের কথা। আর ২০২৪ সালের ফ্যসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে দেশের আপামর জনতা অংশ নিয়েছিল। আমরা দেখেছি এ প্রজন্মের কিশোর, যুবক ও তরুণ মাদ্রাসার ছাত্র ও আলেমরা তাদের বুক পেতে দিয়ে আন্দোলন করেছে। যেকারণে, ভারতের সাম্রাজ্যবাদীরা কোনভাবে ক্ষমতা আর দখল করে রাখতে পারেনি। এদেশের মানুষ নতুন করে স্বাধীনতা লাভ করেছে।
খ ম কবিরুল ইসলাম সচিব বলেন, বিমান দূর্ঘটনার এখনও পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসা ছাত্রদের অবদান নিয়ে আরও অনেক কাজ করতে হবে। আজকে যতটুকু হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। অন্য এক দিন আরও বড় করে করবো। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসা ছাত্রদের স্বীকৃতি এবার দিতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ‘মাদ্রাসা রেজিস্ট্যান্স ডে-২০২৫’ এর অনুষ্ঠান বিকাল ৩টা থেকে শুরু করে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও বিকাল ৬ টার মধ্যেও অনুষ্ঠান শেষ করে দেয় উত্তরাতে বিমান দূর্ঘটনার কারণে। এবং আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। উত্তরায় বিমান দূর্ঘটনার কারনেই মূলত অনুষ্ঠানটি সংক্ষিপ্ত করা হয়। এই মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠানটি আবারও করা হবে বলে জানিয়েছেন কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে জুলাই শহীদ পরিবারের স্মৃতিচারণ, শহীদদের তালিকা উপস্থাপন, মাদরাসা প্রধান, শিক্ষকম-লী ও ছাত্র সমন্বয়কদের বক্তব্য, আহতদের অভিজ্ঞতা, এবং ২০১৩, ২০২১ ও ২০২৪ সালের ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের প্রামাণ্য গল্প। কবিতা আবৃত্তি, হামদ, নাত ও নাশিদের পাশাপাশি পরিবেশ করা হয় দ্রোহের গান। আয়োজন করা হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিভিন্ন ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর। প্রদর্শিত হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে তৈরি দুটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্র ‘ছত্রিশে জুলাই’ ও ‘সাদা জোব্বা, লাল রক্ত’।