আজ ইতিহাসের বাঁক ঘুরানো জুলাইয়ের ১৭তম দিন বৃহস্পতিবার। ২০২৪ সালে দিনটি ছিল বুধবার। আগের দিন রংপুরে আবু সাঈদসহ আরও কয়েকজন শহীদ হওয়ার পর পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসি চত্বরে একটি গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। একইসাথে সারাদেশে কর্মসূচি পালিত হয়। এদিন সারাদেশে স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে কর্মসূচি পালনে অভয় নিয়ে মাঠে নামে ছাত্র-জনতা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জানাযায় শিক্ষার্থী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের সবাই উপস্থিত হন। এদিনেও আইন-শ্ঙ্খৃলাবাহিনীর সাথে মিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। বিশেষ করে আগের দিনের ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। তবে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে এসে আন্দোলন তীব্রতা পায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে জনসম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে বহুগুণে। বিশেষ করে রংপুরে আবু সাঈদের হত্যাকা- আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গের জন্ম দেয়। তার বুক চিতিয়ে দেওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা অকুতোভয় হয়ে ওঠে। নতুন করে স্পৃহা তৈরি হয় রাস্তায় নামার। কর্মসূচিগুলোতে মানুষের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের সৃষ্টি হয়।
এদিন পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ছাত্রজনতা গায়েবানা জানাযা করে। ওই দিন শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত পুলিশ ও ছাত্রলীগের দখলে ছিল। পুলিশ কাউকে দাঁড়াতে দিচ্ছিলো না। তো একটা সময় আকতার রাজু ভাস্কর্যে শুয়ে পড়ে। সে বলে ক্যাম্পাস আমার, আমার ক্যাম্পাসে আমি থাকবো। আমাকে মেরে ফেলেন, তবু আমি ক্যাম্পাস ছাড়বো না। তখন সব সাংবাদিক ওকে ঘিরে রাখে। এক ধরনের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সাংবাদিকদের ওপরই টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তো একটা সাউন্ড গ্রেনেড দেশ টিভি কিংবা চ্যানেল এস’র এক সাংবাদিকের গায়ে লাগে।
এতে সাংবাদিকরা সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আর আকতারের সঙ্গে চার জন শুয়ে পড়েছিল। পুলিশ আকতারকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু বাকী তিনজনকে বাধার কারণে আর তুলে নিতে পারেনি। এরপর শিক্ষার্থীরা ভিসি চত্বরের দিকে আগায়। ওই সময় প্রতীকী ছয়টি কফিন নিয়ে মিছিল রোকেয়া হলের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ব্যাপক হামলা চালায়। পুলিশ টিয়ারসেল, জলকামান, টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়ে। পুলিশ যাকে পায় তাকেই মারে। ওই দিন আর দাঁড়ানোর কোনো অবস্থা ছিল না। কারণ টিয়ারগ্যাসে চোখ খোলা যাচ্ছিল না। রুমাল ও টিসু দিয়ে যার যার মতো চোখ বন্ধ করে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। যে যে দিকে পারে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কফিনও পড়ে থাকে রাজপথে। সেই ছবি কিন্তু ভাইরাল হয়। শিক্ষার্থীরা তবু মাঠ ছাড়ে না। তারা ভিসি চত্বরের দিকে যায়। এরপর পুলিশ ক্যাম্পাসে নজিরবিহীন হামলা করে। শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করে। অনেক শিক্ষার্থী গুলীবিদ্ধ হয়, আহত হয়।
ওইদিন রোকেয়া হলের সামনে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করার পর এক দফা হামলা-মারধর হবার পর তেমন আর শিক্ষার্থীরা ছিল না। কিন্তু হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমরা ভিসি চত্বরের রাস্তায় বসে পড়ে। সন্ধ্যার আগে আগে ওরা দুজন সাহস করে রাস্তায় বসে পড়ে। আরও কয়েকজন ছিল। হামলা হলেও পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢোকার পর শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে ভেতরে ঢুকে। কারণ অনেক ছাত্র তখনও ক্যাম্পাসে। হল পাড়াতে পুলিশ খুব বাজেভাবে হামলা করে। ওই সময় ১৭ তারিখ হান্নান মাসুদের সারা শরীরে শ’ খানেক ছররা গুলী লাগে। এতে হান্নান মাসুদ আহত হয়।
হাসনাত আব্দুল্লাহ তার বয়ানে বলেন, আমার মনে আছে, গায়েবানা জানাযা চলাকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদেরকে কনস্ট্যান্টলি ফোর্স করতে থাকে যেন আমরা গায়েবানা জানাযা না করি। কিন্তু সকল প্রেশার উপেক্ষা করে আমরা গায়েবানা জানাযা আদায় করার সিদ্ধান্ত নিই। গায়েবানা জানাযা শেষ করে আমরা যখন কফিন কাঁধে মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে চাই, তখনই আমাদের লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে মুহুর্মুহু টিয়ার শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে থাকে। আমাদের ওপর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হলেও আমরা তা প্রতিহত করি।
পুলিশকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয় এবং বিকাল পাঁচটার মধ্যে হলগুলো খালি করার ক্ষেত্রে প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে সবচেয়ে ঘৃণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি গণভবনের প্রেসক্রিপশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেন। আন্দোলন দমন করার জন্য চেষ্টা করেন। বার বার ফোর্স করেন যেন আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আমরা বলি আগে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার করতে হবে।
হাসনাত আব্দুল্লাহ আরো বলেন, হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা কীভাবে কী করব তা নিয়ে সন্দিহান অবস্থায় থাকি। তখন আমি সায়েন্স ল্যাবে আমার মামার বাসায় চলে যাই। তখন আমরা সবাই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাই। মজার বিষয় হলো তখন আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সারজিস আলমও আমার মামার বাসায় চলে আসে। তখন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গে আমরা ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এরমধ্যে আমাদেরকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল) সংলাপের প্রস্তাব দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন সাইন্সল্যাবে আমাদের বাসার নিচে আসে এবং আমাদেরকে বলে, মিটিং করার জন্য একটা জায়গায় আমাদেরকে যেতে হবে। তারা আমাদেরকে বলে, হয় মিটিংয়ে যাবেন, না হয় বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন তারা আমাদেরকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নিয়ে যায়।
আমাদেরকে পদ্মায় নিয়ে যাওয়ার পরপরই সেখানে তিন মন্ত্রী প্রবেশ করেন। তারা হলেন, তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তারা প্রবেশ করার পরেই আমাদেরকে বলেন, আমরা যেন তাদের সাথে মিটিং করি। তখন আমরা প্রত্যাখ্যান করি যে, ওনাদের সাথে আমাদের মিটিং করা সম্ভব না। বার বার আমাদেরকে পুশ করা হয় আমরা যেন ওনাদের সাথে বসি। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই ওনাদের সাথে মিটিং করতে রাজি হইনি। চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর তিন মন্ত্রী আমাদের সামনেই বের হয়ে চলে যান। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদেরকে সাইন্সল্যাবে না নিয়ে একটি সেইফ হোমে নিয়ে রাখে।
ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার, রাত। পরের দিন শুক্রবার। আমাদেরকে জুমার নামাজ পড়তে দেওয়া হয় নাই। তিন মন্ত্রীর সাথে দেখা না করায় আমাদেরকে সারারাত ইন্ডিভিজুয়ালি (পৃথকভাবে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমাকে একবার, সারজিসকে একবার, এভাবে পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। তারা আমাকে বলে, সারজিস রাজি হয়ে গেছে। সারজিসকে বলে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছি। আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে বলা হয়, যেহেতু আমার বাবা একসময় বিদেশে থাকতেন। নানানভাবে পারিবারিক বিষয়গুলো টেনে এনে আমাকে ভয়-ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা হতে থাকে। একপর্যায়ে আমাকে কিচেন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন বুঝতে পারি আমি কাকরাইল মসজিদ থেকে বেশি দূরে না।
কারণ ওইদিন জুমার নামাযের পরপরই কাকরাইল মসজিদ থেকে একটা বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। তখন এই মিছিলটাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এই মিছিলটা সম্ভবত বায়তুল মোকাররমের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। জুমার নামাযের পরে আরেকটা টিম আমাদের কাছে আসে এবং তারা আরও বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়। আন্দোলনের সময়ে তখন সর্বপ্রথম আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রথম লাঞ্ছনার শিকার হই। আমাকে কিচেনে একপর্যায়ে থাপ্পড় দেওয়া হয়। আমাকে বলে যে আমার পরিবার তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। যেন নাহিদসহ আরও যারা আন্দোলনকারী আছে তাদেরকে নিয়ে আমরা যেন মিটিং করি।
রিফাত রশিদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টের এক স্ট্যাটাসে বলেছেন জুলাইয়ের ১৭ তারিখের ঘটনা। তিনি লিখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্র্যাকডাউন চালাচ্ছিলো স্বৈরাচারী হাসিনার পুলিশ, বিজিবি ও সোয়াটের সম্মিলিত টিম। সেখানে আমাদের টিয়ারশেল, রাবার ও ছররা বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড মারতে মারতে অল্প কয়েকজনকে হলপাড়ায় বন্দি করে ফেলে। আমি (তখন আমি ডান হাতে রাবার বুলেট জখম) আর আসিফ ভাই তখন জসিমউদদীন হলে আটকে পড়েছে, নাহিদ ভাইসহ অন্যরা তখন বিজয় একাত্তর হলে আটকা। সংখ্যায় দু’জন হওয়ায় আমাদেরকে একাত্তর হলে যেতে হতো ইমার্জেন্সি মিটিং এর জন্য।
তখন হলগেটের সামনে থেকে পুলিশ ফোর্স পিছিয়ে সূর্যসেন হলের দিকে গিয়েছে। আমরা বের হয়ে একাত্তর হলের দিকে যখন যাচ্ছিলাম দেখি আব্দুল হান্নান মাসউদ ভাই পুলিশের দিকে তেড়ে যাচ্ছিলেন। তার দিকে তাক করা অনেকগুলো বন্দুক। অথচ সে হনহনিয়ে বন্দুকের দিকে ছুটে গিয়ে আবু সাঈদের মতো হাত প্রসারিত করে পুলিশকে বলছিলো, করেন গুলী, গুলী করেন। আমি পেছন দিক থেকে দৌড়ে গিয়ে হান্নান ভাইকে ডাকছিলাম, ব্যাক করার জন্য, কিন্তু আমি পৌঁছানোর আগেই মাসুদ ভাইয়ের দিকে ছররা গুলী ছোড়ে পুলিশ। গিয়ে দেখি পুরো শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে ছররা বুলেটের আঘাতে।
কয়েকজন সাংবাদিক আর সিনিয়র দুই চারজন মানুষ এসে মাসুদ ভাইকে নিয়ে রিক্সায় তুলতে যায় হাসপাতালে নেয়ার উদ্দেশ্যে। তখন আমি মাসুদ ভাইকে ধরতে গেলে আমাকে আরিফ আদিব ভাই (তখন উনি ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত ছিলেন) ধরে বললেন যে, পুলিশের আশেপাশে থাকা অবস্থায় উনি একজন পুলিশ অফিসারকে কমান্ড দিতে শুনতে পেয়েছেন যে (সম্ভবত অফিসার ইমরুলের নাম বলেছিলেন) আসিফ আর রিফাতকে এখান থেকে এরেস্ট করতে হবে। এবং তিনি আমাকে আড়াল করে কোনোভাবে মুহসিন হলে পৌঁছে দেন।
১৭ জুলাই ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতদের গায়েবানা জানাযা পড়ার সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলা করে। এদিন বিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন শেখ হাসিনা।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য চ্যানেলে এই ভাষণ সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
নি¤েœ ভাষণের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ছিল এরকম ---
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
প্রিয় দেশবাসী,
আসসালামু আলাইকুম
হিজরী ৬১ সনের পবিত্র এই দিনে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়াসাল্লাম-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা শহিদ হয়েছিলেন। আমি তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলার মাটিতেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে আরেক কারবালা বাংলার মাটিতে সৃষ্টি হয়েছিল। যাঁরা শাহাদাতবরণ করেছেন, আমি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ এবং ২ লাখ নির্যাতিতা মা-বোনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
প্রিয় দেশবাসী,
আজকে অত্যন্ত বেদনা-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি।
লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছি। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহার এবং মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার ব্যবস্থা করে জনগণকে উন্নত জীবন দেওয়ার যাত্রা শুরু করেছি। অনেক সাফল্যও অর্জন করেছি। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। তারপরও আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ যখন একটু স্বস্তি-শান্তিতে ফিরে, তখন মাঝে-মধ্যে এমন কোন ঘটনা ঘটে যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
২০১৮ সালে ছাত্র সমাজের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল করে একটা পরিপত্র জারি করে। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কোটা বহাল রাখার পক্ষে উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের জারি করা সরকারের পরিপত্র বাতিল করে দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে পরিপত্র বহাল রাখার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হয় এবং মহামান্য আদালত শুনানির দিন ধার্য করে। এ সময় আবার ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকার যথেষ্ট ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে। বরং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ সহযোগিতা করে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যখন আন্দোলনকারীরা স্মারকলিপি প্রদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো কিছু মহল এই আন্দোলনের সুযোগটা নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়। এর ফলে এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে যে সকল ঘটনা ঘটেছে তা খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। অহেতুক কতগুলো মূল্যবান জীবন ঝরে গেল। আপনজন হারাবার বেদনা যে কত কষ্টের তা আমার থেকে আর কে বেশি জানে।
যারা মুত্যুবরণ করেছে তাদের আত্মার মাগফিরাত কমনা করছি। পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমি প্রতিটি হত্যাকা-ের নিন্দা জানাই। যে সকল ঘটনা ঘটেছে তা কখনই কাম্য ছিল না। চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। অনেক ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। তাদের উপর লাঠিপেটা এবং ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে, একজন মৃত্যুবরণ করেছে, অনেকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ঢাকা, রংপুর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবন ও ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। সাধারণ পথচারী, দোকানীদের আক্রমণ, এমনকি রোগীবাহী এম্বুলেন্স চলাচলে বাধা প্রদান করা হয়। মেয়েদের হলে ছাত্রীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে এবং লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। আবাসিক হলে প্রভোস্টদের হুমকি দেওয়া হয় এবং আক্রমণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের উপর চড়াও হয়ে তাদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে।
আমি বিশ্বাস করি যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত তাদের সাথে এই সকল সন্ত্রাসীদের কোন সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সংঘাত ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। যারা হত্যাকান্ডের স্বীকার হয়েছে তাদের পরিবারের জন্য জীবনজীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা দরকার তা আমি করব।
আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকান্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছে এরা যেই হোক না কেন, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি আরও ঘোষণা করছি, হত্যাকান্ডসহ যে সকল অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু বিচারের ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে সে সকল বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে। কাদের উস্কানিতে সংঘর্ষের সূত্রপাত হলো, কারা কোন উদ্দেশ্যে দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিল, তা তদন্ত করে বের করা হবে। আমি আন্দোলনরত কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এই সন্ত্রাসীরা যেকোনো সময়ে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রতি আমার আবেদন, তারা যেন তাদের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ থাকেন। একই সাথে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে নজর রাখেন।
সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছে। আপিল আদালতে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। আদালত শিক্ষার্থীদের কোন বক্তব্য থাকলে তা শোনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সুযোগ রয়েছে।
এই আইনী প্রক্রিয়ায় সমাধানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় আন্দোলনে নেমে দুষ্কৃতিকারীদের সংঘাতের সুযোগ করে দেবেন না। সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য আমি সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমাদের ছাত্র সমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায় বিচারই পাবে, তারা হতাশ হবে না। ইনশাআল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আামাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সকলের সহযোগিতায় স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। আমি আবারও এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় যারা নিহত হয়েছে তাদের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি এবং পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাচ্ছি।
খোদা হাফেজ
জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু,
বাংলাদেশ চিরজীবি হোক
বুধবার ১৭ জুলাই রাত ১০টার দিকের ঘটনা। ওই রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেসবুক। শিক্ষার্থী ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনকারী ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় শনির আখড়ার কাজলায় হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানা থেকে কুতুবখালি পর্যন্ত মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকটি মোটরসাইকেল ও সিএনজি পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকরীরা। এদিন দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন কোটা আন্দোলনকারীরা। এতে ওই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায়-দফায় সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের সময় শিশুসহ ছয়জন গুলীবিদ্ধ হয়। পরে আহতের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. বাচ্চু মিয়া গণমাধ্যমকে জানান, শনির আখড়া থেকে আসা আহত ছয়জনকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় কোটা আন্দোলনের ঘটনায় অন্তত ৫২ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এদের মধ্যে আন্দোলনকারী, ছাত্রলীগ সদস্য, পুলিশ ও সাংবাদিক রয়েছে।
এদিকে পরদিন সারাদেশে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। তিনি বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই সারা দেশে সম্পূর্ণ শাটডাউন পালন করার ঘোষণা দেন । আসিফ মাহমুদ ফেসবুকে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, সোয়াটের ন্যাক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত ও এক দফা দাবিতে ১৮ জুলাই সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করছি। তিনি বলেন, শুধুমাত্র হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ব্যতীত কোনো প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলবে না, অ্যাম্বুলেন্স ব্যতীত সড়কে কোনো গাড়ি চলবে না। সারাদেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাচ্ছি আগামীকালকের কর্মসূচি সফল করুন।
১৭ জুলাই সকালের দিকে আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তাড়িয়ে দেয় এবং ক্যাম্পাসকে 'রাজনীতিমুক্ত' ঘোষণা করে। ছাত্ররা নিহতদের জন্য 'গায়েবানা জানাযা' আদায় করার চেষ্টা করে, কিন্তু পুলিশ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সমাবেশে হামলা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস বন্ধ করে ছাত্রদের ছাত্রাবাস খালি করার নির্দেশ দেয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে, হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং ঘোষণা করেন যে, তিনি অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু করবেন। কোটা প্রসঙ্গে তিনি শিক্ষার্থীদের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই সিদ্ধান্ত তাদের হতাশ করবে না। এদিন আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের বাধা ভেঙে এগিয়ে যায় এবং ‘ভাই তুমি বেরিয়ে পড়ো, নিজ অধিকার আদায় করো’Ñএই স্লোগান দিয়ে ছাত্রদের হল থেকে মিছিলে আহ্বান জানাতে থাকে। ছাত্রী হল থেকেও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ দেখে সাহস পায় আন্দোলনকারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে গত এক দশকে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এমন সম্মিলিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। পরদিন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, আল্টিমেটলি সেদিন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে। এতে ছয়জন নিহত এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীসহ কয়েকশ’ আহত হন। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে সরকার। আন্দোলন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতারা।
বৈঠকে নেতারা মোবাইলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে দিকনির্দেশনা নেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক নেতা বলেন, পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার কঠোর অবস্থানেই আছেন তারা। সবাইকে এমন নির্দেশনাই দেওয়া হয়েছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্ররা কারও শেখানো ‘বুলি’ বলছে দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এগুলো তাদের নিজেদের বুলি নয়। তারা ভুল করছে। আমি মনে করি তারা আদালতে এসে তাদের দাবি বলুক।