* ইসরাইলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইয়েমেন
* ইসরাইলের হামলাকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা চীনের
*মোসাদের দুই গোয়েন্দাকে গ্রেফতারের দাবি ইরানের
টানা কয়েকদিন ধরে ইরান এবং ইসরাইলের হামলা ও পাল্টা হামলায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩’ অভিযান শুরু করে ইরান। ইরানের আক্রমণে কার্যত বিপর্যস্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে ইসরাইলের জনগণ এবং অকার্যকর হয়ে পড়েছে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ইসরাইলের তেল আবিব ও আশপাশের শহরগুলোতে গত শনিবার রাতভর ব্যাপক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। সামরিক ঘাঁটিসহ ইসরাইলের কমপক্ষে ১৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এতে ইসরাইলের অনেক শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বিশেষ করে বাত ইয়াম শহর, হাইফা বন্দর, তামরা শহর, তেল আবিবের আশেপাশের শহরগুলো বেশি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এই হামলায় ইসরাইলের বহু ভবন বিধ্বস্ত হয়ে কমপক্ষে ১০ ইসরাইলী নিহত এবং প্রায় ২৪০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়াও কয়েক’শ ইসরাইলের নাগরিক এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। অন্যদিকে ইসরাইলী হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ৮০ জনে। তিন দিনে ইরানের ৭২০টির মতো সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করার দাবি ইসরাইলের। ইসরাইলের কর্তৃপক্ষ বলছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে ও ব্লাংকারে কেউ কেউ আটকে থাকতে পারেন। কিন্তু কতজন হতাহত হয়েছে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেনি তারা। এদিকে ইরানের সঙ্গে চলমান হামলা-পাল্টা হামলার মাঝে ইসরাইলে বড় ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ইয়েমেন। এবং ইসরাইলের হামলাকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা চীনের। এছাড়াও ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সর্বশেষ হিসাব অনুসারে- গত শনিবার রাতের হামলায় তিন ধাপে মোট ৭০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং কয়েক ডজন ড্রোন ছুঁড়ে ইরান। এর মধ্যে প্রথম দফায় রাত ১১টায়, দ্বিতীয় দফায় রাত ২টা এবং সর্বশেষ রাত ২টা ৫৫ মিনিটে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করা হয়েছিল। খবর টাইমস অব ইসরাইল, বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, আল জাজিরা, এএফপি ।
উল্লেখ্য যে, প্রথমে শুক্রবার (১৩ জুন) স্থানীয় সময় ভোররাতে ইসরাইল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করে। ইরানে ইসরাইলের হামলায় দেশটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়। ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করতে ইসরাইল এ হামলা চালায়। প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করে ইরান। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তেহরানে অন্তত ৮০টি লক্ষ্যবস্তুতে রাতভর হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলায় ডজনখানেক ইসরাইলী যুদ্ধবিমান অংশ নেয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে টানা তৃতীয় দিনে এ হামলা চালানো হলো। আইডিএফ আরও জানিয়েছে, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর অংশ হিসেবে তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে তারা ইরানের ১৭০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ইরানের ৭২০টির মতো সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, ইসরাইলের হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে ছিল ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর, সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা বলে দাবি করা হয়েছে। রয়টার্স এক সামরিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল দুটি ‘দ্বৈত-ব্যবহারের’ জ্বালানি কেন্দ্র। ওই জ্বালানি কেন্দ্র সামরিক ও পারমাণবিক কাজে ব্যবহার করা হতো। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদক সেই আবাসিক এলাকার বর্ণনা দিয়েছেন। যাতে একপর্যায়ে তিনি বলছেন, এই আবাসিক ব্লকে এখন ইটের টুকরো পড়ে রয়েছে। সিএনএনের প্রতিবেদন বলছে, গতকাল রোববার ভোরে একগুচ্ছ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরাইলে হামলা চালায় ইরান। ইসরাইলের স্থানীয় সময় রাত আড়াইটার দিকে এই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাত ইয়াম শহর। মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এখানকার একটি আবাসিক ব্লক। বড় বড় দালান ভেঙে এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে সব ইটের টুকরো। এক জায়গায় পড়ে আছে বাচ্চাদের খেলনা।
বিবৃতিতে বলা হয়, হামলায় একটি ক্ষেপণাস্ত্র তামরা শহরের একটি বাড়িতে আঘাত হানে, এতে চারজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন; আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র বাত ইয়ামে আঘাত হানে, যার ফলে কমপক্ষে ছয়জন বেসামরিক নিহত এবং প্রায় ২০০ জন আহত হয়। এছাড়াও একটি ক্ষেপণাস্ত্র রেহোভোটে আছড়ে পরলে আরও ৪০ জন আহত হন। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় তিনজন।
ইরানের আক্রমণে বিপর্যস্ত ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: আল জাজিরা সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গত কয়েকদিন ধরে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান সংঘাতে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কিছু দুর্বলতা দেখা গেছে। বিশেষ করে দেশটির সুপরিচিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ চাপে পড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন একজন বিশ্লেষক। দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের গবেষক মুহাম্মদ সেলুম বলেন, আয়রন ডোম মূলত স্বল্পপাল্লার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর জন্য তৈরি। কিন্তু এখন ইরান থেকে যেসব হামলা হচ্ছে, তা হচ্ছে ক্রুজ মিসাইল, ব্যালিস্টিক মিসাইল ও হাইপারসনিক মিসাইলÍযেগুলো আটকানো আয়রন ডোমের সক্ষমতার বাইরে। তবে তিনি জানান, ইসরাইলের কাছে আরও উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। যেমন, ‘অ্যারো ১’ এবং ‘অ্যারো ৩’ যেগুলো প্রায় ১০০ কিলোমিটার উঁচুতে গিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারে। ‘ডেভিড স্লিং’ নামের আরেকটি ব্যবস্থা রয়েছে, যা মাঝারি দূরত্বে ২০ থেকে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত আসা হামলাও প্রতিহত করতে সক্ষম। মুহাম্মদ সেলুম বলেন, ইসরাইলের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত এবং সমন্বিত হলেও তা চরম মাত্রার হামলায় ভেঙে পড়তে পারে। আর গত ৪৮ ঘণ্টায় আমরা তারই উদাহরণ দেখেছি।
এদিকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সাথে কথা বলেছেন। ম্যাক্রোঁ তাকে “উত্তেজনা এড়াতে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের” আহ্বান জানিয়েছেন। একইসাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইরানকে পারমাণবিক আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু ইরানি প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান ফরাসি প্রেসিডেন্টকে বলেছেন, ইসরাইলের হামলা অব্যাহত থাকলে ইরান আলোচনার টেবিলে বসবে না। রোববারের নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনা বাতিলের ঘোষণা করার পরই ইরান এই কথা জানাল।
জনগণকে সতর্ক করলো ইসরাইলের প্রতিরক্ষাবাহিনী: ইরান আগামী দিনে আরও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। এক সংবাদ সম্মেলনে আইডিএফ’র মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন বলেন, চ্যালেঞ্জিং দিন সামনে আসছে। আগামী দিনগুলোতে আরও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ এবং আঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি জানান, ইসরাইলী বিমান বাহিনীও এক মুহূর্তের জন্য হামলা থামাচ্ছে না। এই বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পরিস্থিতি এখনো অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এবং সামনের দিনগুলোতে সংঘাত আরও গভীর হতে পারে।
ইসরাইলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইয়েমেন: ইরানের সঙ্গে চলমান হামলা-পাল্টা হামলার মাঝে ইসরাইলে বড় ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ইয়েমেন। গতকাল রোববার ভোরের দিকে ইসরাইলের বাণিজ্যিক রাজধানী তেল আবিবে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী। ইয়েমেনের সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে সমন্বয় করে ইসরাইলের তেল আবিবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরাইলের হামলাকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা চীনের: চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইরান ও ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ইরানের ওপর ইসরাইলের হামলাকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। একইসঙ্গে ইরানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রচেষ্টাকে চীন সমর্থন করে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। গতকাল রোববার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। ইসরাইলী পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেওন সায়ারের সঙ্গে ফোনালাপে ওয়াং বলেন, ইরানের ওপর সামরিক হামলা চালিয়ে ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে এবং এটি চীন স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। তিনি আরও বলেন, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনও কূটনৈতিকভাবে ইরানের পারমাণবিক ইস্যুর সমাধানের চেষ্টা করছে, তখন এই ধরনের শক্তি-প্রয়োগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, ইরানের পারমাণবিক ইস্যুতে কূটনৈতিক পথ এখনও শেষ হয়ে যায়নি এবং সংঘাত বা শক্তি দিয়ে কখনোই টেকসই শান্তি আনা সম্ভব নয়।
ইরানের হামলায় বিধ্বস্ত এলাকায় নেতানিয়াহু: ইরানের হামলায় ইসরাইলের বিধ্বস্ত এলাকা বাট ইয়ামে পরিদর্শনে গিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার জন্য ইরানকে চড়া মূল্য দিতে হবে। খবর আলজাজিরার। নেতানিয়াহু আরও বলেন, আমরা এখানে আছি কারণ আমরা একটি অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছি এবং আমি মনে করি এখন প্রতিটি ইসরাইলী নাগরিক তা বুঝতে পারছে।
মোসাদের দুই গোয়েন্দাকে গ্রেফতারের দাবি ইরানের: ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করা দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরান। রোববার (১৫ জুন) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের খবরে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে। ইরান জানিয়েছে, আলবুর্জ প্রদেশে মোসাদের দুই গোয়েন্দাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা বিস্ফোরক ও ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস প্রস্তুত করছিল।