দ্রুত মজুত ফুরিয়ে আসছে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত বিবিয়ানা গ্যাস খনিটির মজুতের একেবারে শেষ দিকের গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। নতুন অনুসন্ধান কূপগুলোতে গ্যাস না পাওয়া গেলে সামনে ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র জানায়, গেলো ৩০ জুন পেট্রোবাংলা দেশের খনিগুলো থেকে মোট ১ হাজার ৮৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে বিবিয়ানা একাই সরবরাহ করেছে ৯২৭ মিলিয়ন ঘনফুট, যা মোট সরবরাহের ৫০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ খনিটি এখনও দেশের গ্যাস সরবরাহের প্রধান ভরসা। হঠাৎ করে এর উৎপাদন কমে এলে সারা দেশে গ্যাস সংকট দেখা দিতে পারে।
হাইড্রোকার্বন ইউনিটের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিবিয়ানায় প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩২১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫৩১ বিসিএফ এরই মধ্যে উত্তোলন হয়ে গেছে। ফলে অবশিষ্ট মজুত রয়েছে মাত্র ৭৮৯ দশমিক ৭ বিসিএফ। এই খনি থেকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে খনিটি দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক জোগান দিয়ে এসেছে। কিন্তু খনিতে অফুরন্ত গ্যাস নেই প্রতিটি কূপের আয়ু নির্দিষ্ট।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বিবিয়ানার ২৬টি কূপের মধ্যে ১১টি থেকে নিয়মিত গ্যাস তোলা হচ্ছে। কিছু কূপে গ্যাসচাপ কমে আসায় সেখানে কম্প্রেসার বসিয়ে উত্তোলন চলছে। বছর পাঁচেক আগেও এই খনি থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হতো। এখন তা কমে ৯২৭ মিলিয়ন ঘনফুটে এসে ঠেকেছে।
সূত্র জানায়, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মজুত ছিল বিবি ৬০ এবি কূপে মোট ৩ হাজার ৩৬৪ দশমিক বিলিয়ন ঘনফুট। আর ৬-বিসিএফ, যার মধ্যে ৮৭ শতাংশ (২ হাজার ৯২৭ দশমিক ৯ বিসিএফ) উত্তোলন হয়ে গেছে। প্রায় একই হারে উত্তোলন হয়েছে বিবি ৬৫ কূপ থেকে বিবি ৭০ কূপে উত্তোলনের হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৮৯ শতাংশ ।
অন্যদিকে, বিএইচ ১০, বিএইচ ২০ এবি, ২০ সি ও ২০ ডি কূপগুলোর মজুতের প্রায় ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ গ্যাস উত্তোলিত হয়েছে, অর্থাৎ এই কূপগুলোতে তুলনামূলক কিছুটা বেশি গ্যাস অবশিষ্ট রয়েছে, ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ। বাকি কূপগুলোর মধ্যে, বিএইচ ২৫-এ ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশ, বিএইচ ৫০ এ-এ ৮৪ দশমিক ৪ শতাংশ, বিএইচ ৫০ বি-তে ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বিএইচ ৬০ কূপে ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ গ্যাস উত্তোলিত হয়েছে। সব মিলিয়ে অধিকাংশ কূপ থেকে ৮০ শতাংশ বা তার বেশি গ্যাস উত্তোলন শেষ। কিছু কূপে তুলনামূলক সামান্য বেশি গ্যাস অবশিষ্ট থাকলেও সামগ্রিকভাবে বিবিয়ানা ক্ষেত্র দ্রুত শেষ প্রান্তে পৌঁছাচ্ছে।
পেট্রোবাংলার সূত্র বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত গ্যাস ক্ষেত্রটি থেকে উত্তোলন হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৪ মিলিয়ন ঘনমিটার বা প্রায় ১৬৬ বিসিএফ (প্রতি মিলিয়ন ঘনমিটার হলো দশমিক শূন্য ৩৫ বিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি)। এ অনুযায়ী বিবিয়ানা থেকে প্রতি মাসে গড়ে গ্যাস উত্তোলন হয় ১৫ বিসিএফের কিছু বেশি। প্রতি অর্থবছরে গড়ে এখান থেকে গ্যাস তোলা হয় গড়ে ১৮১ বিসিএফ। সেক্ষেত্রে চলতি অক্টোবর পর্যন্ত গ্যাস ক্ষেত্রটি থেকে আরো অন্তত ৬০ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুদের হিসাব বিবেচনায় বিবিয়ানায় প্রায় ১ হাজার ২৫০ বিসিএফের বেশি গ্যাস মজুদ রয়েছে।
জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড। দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প, বাণিজ্যি, সারে গ্যাসের চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ হচ্ছে সেখান থেকে। মজুদসংক্রান্ত পেট্রোবাংলার আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিবিয়ানার গ্যাস এতদিনে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। যদিও বিদেশী কোম্পানির হাতে থাকা গ্যাসক্ষেত্রটি থেকেই সরবরাহ আসছে সর্বোচ্চ পরিমাণে। তবে মজুদসংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশিত গ্যাস ক্ষেত্রটিতে উত্তোলনযোগ্য মজুদের তথ্য অনুযায়ী, বিবিয়ানা থেকে অন্তত ২০৩০ সাল পর্যন্ত সরবরাহ অব্যাহত রাখা যাবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বিবিয়ানার মজুত দ্রুতই কমে যাচ্ছে। দু-এক বছরের মধ্যে আরও বড় পরিসরে উৎপাদন হ্রাস পাবে। এলএনজি আমদানি করেও চাহিদা মেটানো কঠিন হবে। কারণ আমাদের আমদানি সক্ষমতা এখনও ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে। বাপেক্সের সক্ষমতা সীমিত, তাই হয়তো তৃতীয় পক্ষকে কাজে লাগাতে হবে। তার মতে, ‘আগাম পদক্ষেপ না নিলে যদি হঠাৎ করে বিবিয়ানা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বড় রকমের বিপর্যয় নেমে আসবে। এখনই বিকল্প উৎসের সন্ধান ও অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে।’
ক্যাবের জ্বালানি উপদেস্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিবিয়ানা নিয়ে বহু আগে থেকেই শঙ্কা ছিল, এখন সেটা বাস্তব হুমকিতে পরিণত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও বাস্তবে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। গ্যাস আমদানি করে সাময়িক ঘাটতি মেটানো গেলেও দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। তাই দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধিই একমাত্র টেকসই সমাধান।