অবৈধ সুবিধা নিয়ে ঢাকার গুলশানে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের ফ্ল্যাট নেওয়ার সত্যতা মিলেছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি ও যুক্তরাজ্যের সাবেক সিটি মিনিস্টার শেখ রেহানা কণ্যা টিউলিপ সিদ্দিকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ। স্বাক্ষ্য প্রমানসহ তদন্ত প্রতিবেদনও কমিশনের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। তদন্তে টিউলিপের বিরুদ্ধে প্রতারনা, মিথ্যা তথ্য প্রদানসহ ঘুষ নেয়ার একাধিক বিষয় সাক্ষ্য প্রমাণে পাওয়া গেছে। এখন কমিশন তদন্ত প্রতিবেদনটি অনুমোদন দিলেই দেয়া হবে আদালতে চার্জশীট। খবর একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এর আগে গত ১৫ এপ্রিল টিউলিপ সিদ্দিকীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিকী, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ মো. খসরুজ্জামান এবং সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা-১ সরদার মোশারফ হোসেনকে আসামী করা হয়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো টাকা পরিশোধ না করেই অবৈধভাবে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের গুলশান-২ এর ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নং বি/২০১, বাড়ি নং ৫এ ও ৫বি (পুরোনো), বর্তমানে- ১১৩, ১১বি (নতুন), রোড নং ৭১) দখল নেন ও পরে রেজিস্ট্রি করেন।
দুদকের ভাষ্য, সরকার থেকে ইজারা নেওয়া জমিতে জালজালিয়াতির মাধ্যমে এই ভবন তৈরি করা হয়। সেই ভবন থেকে অবৈধভাবে ফ্ল্যাট দখল করেন টিউলিপ সিদ্দিক। এ ঘটনা অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলামের নেতৃত্ব ৭ সদস্যদের একটি দল গঠন করা হয়েছিল। দলের অপর সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, মুবাশ্বিরা আতিয়া তমা, এস এম রাশেদুল হাসান, এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর, মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ও উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এর আগে গত ১০ মার্চ পূর্বাচলে অনিয়মের মাধ্যমে ৬০ কাঠার সমপরিমাণ প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার পরিবারের সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন এবং জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক ৮টি অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার একটি আদালত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শেখ হাসিনার শাসন আমলের নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ বড় পরিসরে তদন্ত শুরু করে দুদক। তার অংশ হিসেবে টিউলিপ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত করছে সংস্থাটি।
যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড হাইগেট আসনের এমপি টিউলিপ সিদ্দিক। বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গত জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিটি মিনিস্টার’-এর পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি।
যা আছে টিউলিপের মামলার এজাহারে
ঢাকা ও যুক্তরাজ্যে ফ্ল্যাট ও প্লটে অনিয়ম এবং প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের খাতায় নাম আসা টিউলিপের বিরুদ্ধে ঢাকার গুলশান ২ নম্বরের এ ফ্ল্যাটের অভিযোগের অনুসন্ধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ওই প্লটের হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে। একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, দায়িত্বে অসদাচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কোনও অর্থ প্রদান না করেই ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট দখল এবং পরে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে মালিকানা গ্রহণ করেন টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন রাজউকের সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ মো. খসরুজ্জামান ও সরদার মোশারফ হোসেন। তাদের (টিউলিপ ও রাজউকের দুই কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০(বি), ৪০৯, ১৬১-১৬৫(ক), ১০৯ ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
সাত পৃষ্ঠার এজাহারে বলা হয়েছে, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী গুলশানে ১ বিঘা ১৯ কাঠা ১৩ ছটাক আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ পান। সরকারি ইজারা চুক্তি অনুযায়ী, ৯৯ বছরের মধ্যে ওই প্লট হস্তান্তর বা ভাগ করে বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। তবে ১৯৭৩ সালে তিনি মো. মজিবুর রহমান ভূঁইয়াকে আমমোক্তার মাধ্যমে প্লটটি হস্তান্তর করেন। এরপর প্লটটি ভাগ হয়ে বিক্রি হয় এবং ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ শুরু হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, জহুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার সন্তানদের মধ্যে বিরোধ শুরু হলে মামলা হয়। মামলার চলমান অবস্থায় এবং হস্তান্তর নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় রাজউকের সংশ্লিষ্ট আইন উপদেষ্টারা ইস্টার্ন হাউজিংকে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অনুমোদন দেন-যা অবৈধ ছিল। কারণ কোম্পানিটি লিজ হোল্ডার বা বৈধ প্রতিনিধি ছিল না।
এজাহারের বিবরণে বলা হয়, রাজউকের রেকর্ড অনুযায়ী, ৯৯ বছরের ইজারার শর্তে নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে প্লট হস্তান্তর করার সুযোগ নেই। তবুও ইস্টার্ন হাউজিংকে আমমোক্তার করে ওই প্লট ভাগ করে ৩৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণ ও হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এজহারে অভিযোগ করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হয় এবং এর বিনিময়ে টিউলিপ সিদ্দিকী অবৈধ পারিতোষিক হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং থেকে বিনামূল্যে একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ করেন। ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড কর্তৃক প্রদত্ত এক চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, টিউলিপ বিনামূল্যে ফ্ল্যাট গ্রহণ করেছেন। রাজউকে প্রেরিত ফ্ল্যাট মালিকদের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এজাহারে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১ সালের ১৯ মে থেকে টিউলিপ ফ্ল্যাটের দখলে রয়েছেন বলে ইস্টার্ন হাউজিং সিটি কর্পোরেশনে একটি চিঠিতে জানিয়েছে। তিনি ওই তারিখ থেকে হোল্ডিং ট্যাক্সও দিয়ে আসছেন। মামলার এজাহারে ঘটনার সময়কাল ১১ জুলাই ১৯৬৩ থেকে ৩০ অক্টোবর ২০০২ পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান দলের তথ্য তুলে ধরে এজাহারে অভিযোগ করা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতার শেষ লগ্নে (ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ ১৫/০৭/২০০১) তড়িঘড়ি করে তার নিয়োগকৃত নিজ দলীয় লোক (আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ নাসিমের বড় ভাই ডঃ মোঃ সেলিম) এবং শাহ্ খসরুজ্জামানকে দিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং এর নামে লিগ্যাল পার্সন হিসেবে আম-মোক্তার অনুমোদন করিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং এর প্রস্তাবিত তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের নামে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। যার মধ্যে অবৈধভাবে লাভবান হওয়া টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক এর নাম প্লট নং ১১বি এর ৫নং ক্রমিকে অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং রিজওয়ানা সিদ্দিক ওরফে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক বিগত ১৯/০৫/২০০১ খ্রি. তারিখ থেকে অবৈধ সুবিধা করিয়ে দেয়ার নিমিত্তে বিনামূল্যে উক্ত ফ্ল্যাটটি দখলে রাখেন। এসময় টিউলিপ সিদ্দিকীর আপন খালা শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন ছিলেন এবং সেই সুযোগে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করে কাজে লাগিয়েছেন।
এজাহারে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে ইস্টার্ন হাউজিংকে আমমোক্তার অনুমোদনপূর্বক ও ফ্ল্যাট বিক্রয়ের অনুমোদন করিয়ে অবৈধ সুবিধা দিয়ে ও নিজে অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিনামূল্যে একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ করার এ কাজে পাঁচজন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে তুলে ধরা হয়।
আসামি তিনজন ছাড়া বাকি দুইজন হলেন ইস্টার্ন হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম ও রাজউকের সাবেক আইন উপদেষ্টা মোঃ সেলিম (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের ভাই)। এ দুজন মারা যাওয়ায় তাদের আসামি করা হয়নি।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিউলিফের ঘুষ হিসেবে ফ্ল্যাট নেয়ার বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে তার আয়কর নথি জব্দ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে , টিউলিফের আয়কর নথিও জব্দ করা হয়। নথি পরখ করে দেখা যায়, তাতে অনেক অসঙ্গতি, জালিয়াতির আশ্রয় নেয়াসহ মিথ্যা তথ্য দেয়া। এছাড়া, ছয় বছর ধরে আয়কর রিটার্ন না দেয়ার বিষয়টি পাওয়া যায় নথি মোতাবেক। দায়ের করা মামলায় যে সকল ধারা সন্নিবেশিত হয়েছে, তাতে এসব বিষয় নিয়ে সমস্যা হবেনা। ওইসব ধারাতেই অপরাপর ঘটনাগুলো কাভার করবে। মিথ্যা তথ্য প্রদান, জালিয়াতির ঘটনায় পৃথক কোন মামলা করার দরকার নেই। সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর আওতায় এসব এসে যাবে বলে সুত্র জানায়। আদালত চার্জ গঠন করতে পারবে।
মামলা হাইকোর্টে স্থগিত, আপিল করবে দুদক
এদিকে, ফ্ল্যাট জালিয়াতির মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। সুত্র মতে, মামলার তদন্ত যখন শেষ পর্যায়ে, তখনই আইনজীবীর এক চিঠিতে হতবাক হয়ে যায় দুদক। চিঠিতে বলা হয়, হাইকোর্টে এই মামলার আসামি শাহ খসরুজ্জামানের রিটের প্রেক্ষিতে গত ৮ জুলাই বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ মামলাটি তিন মাসের জন্য স্থগিত করে রুল জারি করেছে। উচ্চ আদালতের এ আদেশের কারণে টিউলিপের মামলার পুরো তদন্ত কাজ সাময়িকভাবে থমকে দাঁড়ালেও কমিটি তাদের তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন কমিশনের কাছে জমা দেয়।
যোগাযোগ করা হলে দুদকের আইনজীবী এম এ আজিজ খান বৃহস্পতিবার রাতে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, তদন্ত চলাকালে স্থগিতাদেশ অপ্রত্যাশিত। এ কারণে শিগগিরই আপিল করা হবে, যাতে তদন্ত শেষে চার্জশিট হলে আদালত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। লিখিত আদেশে পুরো মামলা নয়, শুধুমাত্র পিটিশনার হিসেবে খসরুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধে নির্দেশনা দেয়া হতে পারে বলে জানান এই আইনজীবী।
আইনজীবী এম এ আজিজ খান বলেন, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের সত্যায়িত অনুলিপি (সার্টিফাইড কপি) পাওয়ার পর দুদকের পক্ষ থেকে আপীল করা হবে। আপীলের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে কমিশন থেকে দেয়া হয়েছে। মামলার বর্তমান অবস্থায় তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশীট দিতে কোন আইনগত সমস্যা নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।