চলতি বছরের ৮ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পতিত স্বৈরাচার দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। তিনি বলেছেন, আমাদের এখন ততটাই সতর্ক থাকতে হবে, যেমনটা আমরা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে ছিলাম। এ বক্তব্যের তিন মাস যেতে না যেতেই প্রধান উপদেষ্টা গত বুধবার আবার বলেছেন, এক বছর যেতে না যেতেই পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

সূত্র গোপালগঞ্জে গত ১৬ জুলাই বুধবার এনসিপির ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি ঘিরে রক্তাক্ত ঘটনায় পতিত আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হয়। গোপালগঞ্জের ঘটনায় অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যেভাবে প্রকাশ্যে কোনো রকমের বিনা উস্কানীতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এনসিপি নেতাকর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে তা ছিল নজিরবিহীন। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপরও হামলা করেছে। একাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে। সেখানকার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের সামর্থ্য প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তদন্তে এসেছে, গোপালগঞ্জের ঘটনা পরিকল্পিত ছিল। শেখ মুজিবের জন্মভূমি গোপালগঞ্জ স্বভাবতই বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। প্রশাসন কেন সেখানে এনসিপির কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে বাড়তি সতর্কতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করল না? কেন পুলিশ প্রশাসন আগাম প্রস্তুতি রাখল না? গোয়েন্দা সংস্থা কেন আগাম সঠিক বার্তা দিতে ব্যর্থ হলো? এসব প্রশ্ন থাকছেই। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, দেশ যখন নির্বাচনী ট্রেনে চেপেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত মব সন্ত্রাস, মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যা, গোপালগঞ্জে অরাজকতা-কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সব জেনেশুনেই ঘটানো হচ্ছে। দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতেই, পূর্বপরিকল্পিতভাবে এসব ঘটানো হচ্ছে। আর কৌশলে বিগত ফ্যাসিস্টবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দলগুলোকে, বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের উদ্যোক্তাদের দল ও গ্রুপগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। গোটা দেশকে পরিকল্পিতভাবে অশান্ত করার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সবশেষ সচিবালয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারদের হামলার ঘটনায় দেশকে অশান্ত করার ভয়ঙ্কর ছক প্রকাশ পায়।

সূত্র মতে, গত কয়েক মাস ধরে সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে যা ঘটে চলেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। সাধারণ মানুষ রাস্তায় বের হলেই অবরোধের মুখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। স্কুলের ছাত্ররা পরীক্ষায় ফেল করে অটোপাশের দাবিতে রাস্তায়-সচিবালয়ে আন্দোলন করে, কলেজের ছাত্ররা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবেন নিজেরাই তা ঠিক করে এ নিয়ে আন্দোলন, পোশাক শ্রমিক, ব্যাটারিচালিত রিকশা শ্রমিকদের আন্দোলন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন। সবই যেন এই সরকারের দায়। রাস্তাঘাটে এসব অরাজকতা অব্যাহত থাকলে দেশ দুষ্কৃতকারীদের দখলে চলে যাবে। আবার এসব ঘটনার পাশাপাশি উগ্রবাদী শক্তি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তা দেখেও মানুষকে প্রমাদ গুনতে হচ্ছে। তদন্তে শেষে দেখা যায়, এসব আন্দোলনের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইন্ধন যোগাচ্ছে পতিত সরকারের লোকজনই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে আমাদের কোনোই সন্দেহ নেই কিন্তু বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ভেতর-বাইরে যেসব চক্রান্ত হচ্ছে এবং হবে, সেসব মোকাবিলা করে খুব বেশিদিন তারা সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। দেশের রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলো সেসব চক্রান্ত কতদূর মোকাবিলা করতে পারে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, বিভক্তি কখনোই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ভূমিকা রাখতে পারবে না।

প্রতিবেশি দেশের একটি পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফ্যাসিস্ট দলটির বর্তমান নেতৃত্ব বসে নেই। শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশের বিভিন্ন জেলায় ভার্চুয়াল বৈঠক করছেন শীর্ষ নেতারা। ইতোমধ্যে ২৩টি জেলায় ভার্চুয়াল বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে শেখ হাসিনা সরাসরি যুক্ত হয়ে কর্মীদের বলেছেন, আমি দেশ ছাড়তে চাইনি, ইস্তফাও দিইনি। আমাকে জোর করে দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছে। এই চক্রান্তের শেষ দেখে ছাড়ব। তিনি কর্মীদের আশ্বস্ত করে আরও বলেন, এরা বেশিদিন টিকবে না। জানা গেছে, নতুন কৌশলে এগুচ্ছে এরা। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ ঘোষিতদের কর্মকান্ডে ষড়যন্ত্রের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসরদের মূল লক্ষ্য পুলিশকে সঠিকভাবে কাজ করতে না দেওয়া। এর ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভঙ্গুর হবে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তারা কাজ করছে। এছাড়া ফ্যাসিস্টের দোসররা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে থেকে দেশকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরাও কূটকৌশলের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করছে। তাদের মূল লক্ষ্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে বিঘœ ঘটানো।

জানা যায়, মাঠ পুলিশে দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে বিরাজ করছে ‘মব’ আতঙ্ক। আসামি ধরে থানায় আনার পর থানাতেও হামলার ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে বেশি মব আতঙ্কে আছেন রাজধানীতে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। তা না হলে এ ধরনের হামলা চলতেই থাকবে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশের কাজটাই অপ্রীতিকর। এসব ঘটনা (পুলিশের ওপর হামলা) ঘটতেই পারে। অপরাধী সুযোগ নেবেই। তবে এটা প্রতিরোধ করতে হবে।

সূত্র জানায়, দেশকে অস্থিতিশীল করতে পতিত আওয়ামী লীগ ভয়ঙ্কর ছক এঁকেছে। সেই ছক অনুযায়ী একের পর এক তারা নানা অঘটন ঘটিয়ে চলছে। অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর পেছনেও তাদের হাত রয়েছে। দেশকে বিদেশীদের কাছে হেয় করতে ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তারা ব্যবহার করছে। একটি সূত্র বলেছে, আগামী দুই একমাসের মধ্যে তারা দেশকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।একটি সূত্র বলেছে, নানা ইস্যু নিয়ে কাজ করছে পতিত আওয়ামী লীগ। গত ৫ আগস্ট হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী রাতারাতি ভোল পাল্টে সাধু সেজেছে। এরা বিভিন্ন গ্রুপের সাথে মিশে গিয়ে এখন মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য। এর সাথে জড়িত রয়েছে আওয়ামী সমর্থিত ঢাকার সাবেক কাউন্সিলরদের সহযোগীরা। এছাড়া আওয়ামী বিরোধী সেসব রাজনৈতিক ও সামাজিক দল রয়েছে, তাদের অভ্যন্তরে কোন্দল বাধানোর বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। সেক্ষেত্রে পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি পর্যায়ে এখনো আওয়ামী লীগের যেসব দোসর আছে তাদেরকে কাজে লাগাতে চায় আওয়ামী লীগ। একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার কাজটি করবে তারা। ফলে আওয়ামী বিরোধী শক্তি নিজেরাই নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়বে। বর্তমানে দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক শক্তি যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারে সেজন্য যা যা করার আওয়ামী লীগ করবে বলে জানা গেছে।

উত্তেজনা সৃষ্টি ও সহিংসতা উসকে দেওয়ার উদ্বেগজনক খবর পাওয়া যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, বিভেদমূলক সংঘাত বা মব উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করার লক্ষ্যে সহনশীলতা ও আত্মসংযমের উপর ভিত্তি করে আমাদের একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মঙ্গলবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন। ওই পোস্টে তিনি আরও বলেন, জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং সহানুভূতি ও একতা প্রদর্শনের দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং প্রতিটি সংকটকে সংহতি নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই-আগস্টে আবার ফ্যাসিস্ট শক্তি উত্থানের শঙ্কা দেখা গেছে, এনসিপির ওপর হামলা কিংবা সচিবালয়ে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত হতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

জুলাই-আগস্টের ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে জাতীয় স্বার্থের জায়গায় যেকোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। গত বুধবার দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ আহ্বান জানান তিনি। জামায়াত আমীর বলেন, আমাদের মধ্যে দল ও মতের ভিন্নতা থাকবে। এই ভিন্নতা নিয়েই আমাদের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব কর্মকা-ের বিরুদ্ধে, সমাজের শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। তাই দলমত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমাদেরকে নিবিড় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, যেখানে ফ্যাসিবাদ, সেখানেই মোকাবিলা করা হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকে যেকোন মূল্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তাহের বলেন, দেশে পরিকল্পিতভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা চলছে এবং গোয়েন্দা ও প্রশাসনিক কিছু দুর্বলতা রয়েছে। সরকারের উচিত প্রশাসনকে আরো কঠোর এবং সমন্বিত করা যাতে যেকোনো ঘটনা ঘটার আগেই সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের কোনো স্থান থাকবে না, পুরনো ফ্যাসিবাদ নির্মূল হয়েছে এবং নতুন ফ্যাসিবাদ গজাতে দেওয়া যাবে না। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য অটুট থাকবে এবং দেশের প্রতিটি স্থানে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।

ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, বিভিন্নভাবে পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে ফ্যাসিবাদী শক্তি। তারা গুজব ছড়াচ্ছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো ব্কিল্প নেই।