একদিকে গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলো পুরো সক্ষমতা নিয়ে চালু করা যাচ্ছে না অন্যদিকে বিদ্যুতের সরবরাহ তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক রাখতে হলে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে এতে উৎপাদন খরচ বেশি । এমতবস্থায় ভতুর্কির পরিমান বেড়ে যাওয়ার শংকায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ নিয়ে আপতত সুখবর কম। লোডশেডিং যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে সরকার যেমন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তেমনি লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ কম বেশি মেনে নিয়েই জীবন যাত্রা চালাতে হবে মানুষকে।

বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের ভিত্তিতে দেশে কিছু লোডশেডিং চালু রাখার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, কিছু লোডশেডিং না দিলে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাবে। তবে লোডশেডিং যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সে চেষ্টা করা হবে। তিনি জানান, শহর ও গ্রামে সমানভাবে লোডশেডিং কার্যকর করা হবে।

উপদেষ্টা বলেন, বিদ্যুতের সরবরাহ তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক রাখতে হলে আমাদের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে, যদিও এগুলোর উৎপাদন খরচ বেশি।

সূত্র জানায়, ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির আওতায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে মোট ৭১টি। এ ধরনের কেন্দ্রের বর্তমান স্থাপিত সক্ষমতা ১২ হাজার ৩৩৩ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে হলে দৈনিক ২ হাজার ৪২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর সুযোগ আপাতত নেই।

জানা গেছে, বিপিডিবির দৈনিক জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে গ্যাসের প্রয়োজন অন্তত ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু পেট্রোবাংলা থেকে বিদ্যুতে গ্যাসের বরাদ্দ রয়েছে গড়ে সাড়ে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। তা দিয়েই গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোকে রেশনিং করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে বিপিডিবিকে। এতে কোনো না কোনো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে মোট সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি কেন্দ্র অলস পড়ে থাকছে। এ ছাড়া গরমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন দেড় লাখ টন ফার্নেস অয়েল ও ১৫-১৬ হাজার টন ডিজেল। দৈনিক কয়লার চাহিদা ৪০ হাজার টন।

এদিকে চলতি বছর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হলেও সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঈদের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহে স্বস্তি থাকলেও নানা ইস্যুর কারণে সামনে লোডশেডিং বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করেছে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) জানিয়েছে, ঈদের সময় লোডশেডিং প্রায় শূন্যে নেমে এসেছিল। তবে কিছু এলাকায় কারিগরি ত্রুটির কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে। নানা আশঙ্কা আর জটিলতার মধ্যও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

দেশের বিভিন্ন জেলায় খবর নিয়ে জানা যায়, গরম বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। ফলে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

রংপুর বিভাগে সম্প্রতি বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তীব্র লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। যা জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের বিদ্যুতের চাহিদা দিনে ১,০৫০ থেকে ১,১০০ মেগাওয়াট হলেও জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৭০০ মেগাওয়াটের মতো।

এই ঘাটতির ফলে প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর এক থেকে দেড় ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। রংপুর নগরীসহ আশপাশের এলাকায় দিনে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টার লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে।শুধু রংপুরই নয় ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল বিভাগেও একই চিত্র।

চলতি বছর গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট হতে পারে বলে ধারণা করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। সে অনুযায়ী ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনেরই চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তবে পিডিবি সূত্রে জানা যায়, এপ্রিলে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ফলে সেই হিসেবে তা ভরা গ্রীষ্ম মৌসুমে একই বা কিছু বেশি বা কম হতে পারে। এ হিসেবে লোডশেডিং হতে পারে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াটের।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। এতে ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের লোডশেডিং হতে পারে। গরম যত বাড়বে, এসির ব্যবহার তত বাড়বে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে বিদ্যুতের সংকট।

পিজিসিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত সপ্তাহে প্রতিদিনই লোডশেডিং করতে হয়েছে। সর্বোচ্চ ৪২৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। এ সময় চাহিদা ১৪ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। এই চাহিদা মেটাতে ২ হাজার ৫০০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ জ্বালানি তেল দিয়ে উৎপাদন করা হয়। তবে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হওয়ার পর ঘাটতি কমেছে। তবে চলতি গ্রীষ্মে দৈনিক ১১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা করতে পারছে না পেট্রোবাংলা।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম জানান, আমাদের বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদনের কাঁচামালের বড় অংশই আমদানি নির্ভর। গ্যাস, কয়লা বা ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত জ্বালানি না পেলে উৎপাদন কমে যায়। বিশ্ব জ্বালানি বাজারে দাম বাড়লে আমদানি কমে যেতে পারে। আর দেশের রিজার্ভের উপর নির্ভর করছে আমদানি।

এদিকে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়া, গ্রীষ্মকালে এয়ার কন্ডিশনার, ফ্যান ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। শিল্পকারখানা ও শহুরে এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার অনেক বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ত্রুটির জন্যও উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়।

এছাড়া, মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। এপ্রিলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়লেও স্থিতিশীল না হওয়া। সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন নির্ভর করে আবহাওয়ার উপর, যা সবসময় সাপোর্ট কারিগরি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পাশাপাশহ বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।

আগের সরকার লুণ্ঠনমূলক অনেক নীতি করে রেখেছেন। তবে ডলারের বিনিময়ে আমাদের আদানির বিদ্যুৎ না কিনে কয়লা কিনা দরকার। এতে একই খরচে আমরা দ্বিগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি।