আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দেশের সকল ভোটকেন্দ্রে থাকবে বডি ওর্র্ন ক্যামেরা। সরকার প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে কমপক্ষে একটি করে এই ক্যামেরা ব্যবহারের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য চীনের হুয়াওয়েই কোম্পানীর সাথে প্রযুক্তিগত দিক নিয়েও চলছে আলাপ আলোচনা। এদিকে, আগামী নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলছে দফায় দফায় বৈঠক। আজ বুধবার সকালে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে হবে আরেকটি বৈঠক। এসব বৈঠকে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের।

জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে ৫০ হাজার বডি ওর্র্ন ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। সরকার প্রধানও এ ব্যাপারে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকাবস্থায়। এই ক্যামেরা ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ইউনিফর্মের (পোশাক) সঙ্গে ব্যবহার করবেন। ভোটকেন্দ্রের যেকোনো ঘটনার দৃশ্য এই ক্যামেরায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়ে যাবে। এছাড়া ভোটকেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যেকোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভোট গ্রহণকালে পুলিশ সদর দপ্তরের কমান্ড সেন্টার থেকে বডি অর্ন ক্যামেরা দিয়ে সরাসরি ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। প্রতিটি বডি ওর্র্ন ক্যামেরার ভেস্টের সঙ্গে জিপিএস ট্রাকিং ডিভাইস লাগানো থাকবে।

জানতে চাইলে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) বাহারুল আলম গতকাল দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ভোটকেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি আমরা বডি ওর্র্ন ক্যামেরা ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছি। বর্তমানে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে বডি ওর্র্ন ক্যামেরার সম্ভাবতা যাচাই চলছে। এটা শেষ হলেই আমরা প্রকিউরমেন্টে যাবো। বডি ওর্র্ন ক্যামেরার ব্যবহার নির্বাচন আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। নির্বাচনের পর আমরা এই ক্যামেরা অন্যান্য কাজেও লাগাবো।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটকেন্দ্রের যেকোন ঘটনার বিতর্ক সমাধানে সহায়ক হতে পারে

বডি ওর্র্ন ক্যামেরা। ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া সরাসরি রেকর্ড করার মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কাজটিও করা যাবে।

পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের পর বডি ওর্র্ন ক্যামেরা যেকোন গ্রেপ্তার ও তল্লাশি কাজে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে গ্রেপ্তার ও তল্লাশিকালে যেকোন ঘটনার দৃশ্য বডি ওর্র্ন ক্যামেরায় ধারন করা যায়। কোন বিতর্ক উঠলে ক্যামেরায় ধারনকৃত ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। রাস্তায় যানবাহন তল্লাশি, মামলা দায়ের, রেকার বিল চার্জ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারি ব্যবস্থা জোরদার করতে বডি ওর্র্ন ক্যামেরা ব্যবহার করতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ রয়েছে।

গত ২৩ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার মূখ্য সচিব এম সিরাজউদ্দিন মিয়া এর সভাপতিত্বে পুলিশ সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত সুপারিশ বাস্তবায়ন বিষয়ক প্রথম সভায় বডি ওর্র্ন ক্যামেরা ব্যবহারের দিকটিও আলোচনায় আসে। সেখানে মূখ্য সচিব বডি ওর্র্ন ক্যামেরার সম্ভাব্য ব্যয় সংক্রান্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দাখিল করতে বলেন।

এদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে নানা উদ্যোগ শুরু করেছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে আজ বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন বিষয়ক সভায় একগুচ্ছ সিদ্বান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব) সভায় সভাপতিত্ব করবেন। সভায় মন্ত্রিপরিষ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মূখ্য সচিব, জনপ্রশাসন, অর্থ বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগের সিনিয়র সচিব উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, পুলিশ প্রধান এবং বিজিবি, আনসার ও কোষ্টগার্ডের মহাপরিচালকগণ উপস্থিত থাকবেন।

সূত্র বলেছে, সভায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় কী কী ধরনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কী পরিমাণ সদস্য মোতায়েন করতে হবে এসব বিষয়ে আলোচনা হবে। সভায় এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতে পারে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, বডি অর্ণ ক্যামেরা ব্য¦হারের সুবিধা অসুবিধার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপ আলোচনার পরই অঅসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ব্যবহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকার প্রধান ড. মো: ইউনুস দেশের প্রতিটি নির্বাচনী ভোটকেন্দ্রে এই ক্যামেরা ব্যবহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। এরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এই ক্যামেরা ব্যবহারের ওপর জোর দেয়। যোগাযোগ করা হয়, চীনের হুয়াওয়েই কোম্পানীর সাথে। তাঁদের প্রযৃক্তিগত দিকগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাচাই বাছাই চলছে বডিঅর্ণ ক্যামেরা প্রস্তুতকারক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারিগরী পরামর্শ ও মতামত। চিন্তাভাবনা চলছে বাজেট নিয়েও। সুত্রমতে, বডিঅর্ণ ক্যামেরা ব্যবহার নিয়েই মূলত: বিভিন্ন কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে। সবকিছু নিয়ে সিদ্ধান্ত হলেই বডিঅর্ণ ক্যামেরা কেনার ব্যাপারে অগ্রসর হবে সরকার।

বডি ওর্ন ক্যামেরা (Body Worn Camera): এটি হল এক ধরনের ছোট ক্যামেরা যা সাধারণত অফিসার বা কর্মীদের পোশাকে যুক্ত করা হয় এবং যা তাদের কার্যকলাপ রেকর্ড করে। এটি সাধারণত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নিরাপত্তা কর্মী, বা অন্যান্য কর্মীরা ব্যবহার করে থাকে। বডি ওর্র্ন ক্যামেরা ব্যবহারের সুবিধাগুলো হলো: স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: ক্যামেরার মাধ্যমে ঘটনার লাইভ বা রেকর্ড করা ভিডিও প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বাড়াতে সাহায্য করে। অপরাধ হ্রাস: বডি ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহারের ফলে অপরাধীরা অন্যায় কাজ করার আগে দুবার চিন্তা করবে, কারণ তাদের কার্যকলাপ রেকর্ড করা হচ্ছে। কর্মচারীদের সুরক্ষা: ক্যামেরা কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করে, কারণ এটি তাদের কাজের সময় হওয়া কোনো ঘটনার প্রমাণ হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রশিক্ষণ ও পর্যালোচনা: বডি ওর্ন ক্যামেরার ফুটেজ ব্যবহার করে কর্মীরা তাদের কাজের পর্যালোচনা করতে পারে এবং নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে।

বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশ তাদের কর্মকর্তাদের পোশাকে বডি ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহার করে থাকে, যা মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম কন্ট্রোল রুম থেকে সরাসরি মনিটরিং করতে এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, বডি ওর্র্ন ক্যামেরা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন: আইন প্রয়োগকারী সংস্থা: পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ইত্যাদি তাদের দৈনন্দিন কাজের অংশ হিসেবে বডি ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহার করে।

বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা: নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের ডিউটির সময় বডি ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান: কলকারখানা, শপিংমল, ইত্যাদি স্থানে কর্মীরা তাদের কাজের সময় নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য বডি ওর্র্ন ক্যামেরা ব্যবহার করে। বডি ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।