চাকরিতে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য জঙ্গি নাটক সাজিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বা ভিন্ন মতের নিরপরাধ অনেক মানুষকে ধরে এনে আটক করে রাখা হতো। তাদেরকে বড় জঙ্গি বলে দিনের পর দিন গুম করে রাখা হতো। আর এ কারণে পুরস্কার হিসেবে বড় পদোন্নতি দেয়া হতো। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের শাসনের ১৫ বছরে দেশে সংঘঠিত গুম নিয়ে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এমন লোমহর্ষক তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে গুমের শিকার এক ব্যক্তি বলেছেন, তার কক্ষে পাহারার দায়িত্বে থাকা প্রহরীকে একদিন প্রশ্ন করেন এভাবে ‘আচ্ছা ভাই, যেহেতু আপনি আন্তিরকতা দেখাইেছন, তাহেল একটা কথা বলেন আপনি নিজেও তো দেখছেন তারা নাটক সাজাইতছে। এই যে মিথ্যা অস্ত্র মামলা দিল তাতে লাভ কি? উনারা তো দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক করবে, তা না করে ওনারা এসব কী করতেছে। আমাদেরকে যে এখানে দিনের পর দিন রাখতেছে, আমাদের পেছনে অনেক টাকা খরচ করতেছে- কারণ কি’? নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি বললেন, ‘যদি একটা বড় জঙ্গি ধরা যায়, স্যারদের খুব দ্রুত প্রমোশন হয়। আপনারা চলে যাবেন-এরপর স্যারের প্রমোশন হবে, এটাই লাভ’। গুম হওয়া ব্যক্তির বক্তব্য ছিল এরকম, ‘একটা প্রমোশনের জন্য আমার জীবনটা এভাবে ধ্বংস করে দিল?’ এ সময় প্রহরীকে অনেকেটা বিমর্ষ মনে হলো। তার চোহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললেন।

গুম হওয়া কেউ কেউ কমিশনে সাক্ষ্য দেয়ার সময় তাদের কক্ষের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কিছু প্রহরীকে ভালো বলে উল্লেখ করেছেন। কিছু প্রহরী কখনো কখনো ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের অগোচরে হাতের বাধন বা হ্যান্ডকাফ খুলে দিতেন। কর্মকর্তাদের আদেশ অনুযায়ী শাস্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতেন। র‌্যাব ১১-এ গুম থাকা একজন নারী বন্দি একজন প্রহরীর কথা উল্লেখ করে বলেন যে , তিনি তার হাতের বাধন আলগা করে দিয়েছিলেন। অন্যথায় বাধনের কারণে তার দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে হতো। প্রহরী তাকে বলেছিলেন, ‘আপা আপনার অনেক কষ্ট হইতেছে, আমি আপনার বাধন একটু খুলে দেই আপনি একটু রেস্ট নেন। স্যার আসার শব্দ শুনলে আপনি দাঁড়িয়ে যাবেন আপনাকে আমি আবার হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দিব’। ওই নারী বন্দি বলেন, ক্ষনিকের এই মানবিক আচারণগুলো দেখা যায় বিপদের ঝুঁকি সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নতজানু না হয়ে বিরোধীতা করা সম্ভব ছিল।

ক্ষমতায় থাকাকালীন, আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি অন্যদিকে একটি রাজনৈতিক বয়ান গড়ে তোলে, যেখানে দলটি নিজেকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি চরমপন্থার উত্থানের বিরুদ্ধে একমাত্র কার্যকর প্রতিরক্ষাকবচ হিসেবে উপস্থাপন করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও আওয়ামী লীগের দেশীয় সন্ত্রাসবিরোধী বয়ানটি ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে। এই সম্পর্ক কেবল মৌখিক কথায় সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি যৌথ অভিযানে, আন্তঃসীমান্ত সমন্বয়ে এবং আইনবহির্ভূত কার্যক্রমেও রূপ নেয়। একাধিক সাক্ষ্যে ভুক্তভোগীরা বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তাদের ভারতের হেফাজত থেকে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে কিংবা বাংলাদেশের হেফাজত থেকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কের পাশাপাশি, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই’-এর নামে পশ্চিমা সহযোগিতা থেকেও লাভবান হয়েছে।

কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে যে ঊর্ধথন কর্মকর্তাদের আদেশ না মেনেও অনেকে নিজ অস্থানে অটল থেকে চাকরি করতে পেরেছেন। সে প্রসঙ্গে র‌্যাবের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার উদৃতি দিয়ে বলা হয়, একজন বন্দিকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ওই বন্দি তা জানতে পারেন। কারণ তারই এক সহকর্মীর অসতর্কতার কারণে বন্দির অবস্থান ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তিনি সেই আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, যদি ওনাকে মারতে হয় তা হলে আমাকে এখান থেকে বদলি করে দেন। আমি ওনাকে মারতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত ওই বন্দিকে হত্যা করা হয়নি এবং গত বছর ৫ আগস্টের পরও তিনি তার চাকরিতে বহাল ছিলেন। এর দ্বারা এটাই বোঝা যায় যে, অন্যায় আদেশ না মানলেই যে তাৎক্ষকি খারাপ পরিণতি হতো এম নয়। কেউ কেউ সাহসিকতারও পরিচয় দিয়েছেন।

কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গুমের পর শুধু ক্রাসফায়ার নয়, গুলী করে নদীতেও ফেলা হয়েছে লাশ। হত্যা করা হয়েছে ইনজেকশন পুশ করে। ইটের ভাটা, ট্রেন বা যানবাহনের নিচে ফেলেও হত্যা করা হয়েছে। গুম করতে অস্বীকৃতি জানানো কিংবা ভুক্তভোগীকে সহায়তা করেছেন এমন কর্মকর্তাদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, প্রতিবাদ জানানোয় রোষালনে পড়েছিলেন তারা। উল্টো প্রমোশনসহ নানা সুবিধার জন্য জঙ্গির নাটক সাজিয়েছেন অনেকে।

এ বিষয়ে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের এক সদস্য জানান, তারা এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু নিরূপায় ছিলেন। তাদেরকে বাধ্য করা হত। তারা বাধ্য হয়েছেন, কারণ তাদের চাকরির ব্যাপার, জীবনের নিরাপত্তা এবং পারিবারিক নিরাপত্তার ব্যাপার ছিল। এছাড়া তিনি জানান, তদন্তে কমিশন জানতে পারে যে ইনজেকশন পুশ করেও হত্যা করা হয়েছে গুমের শিকারদের। পরে লাশ গায়েব করতে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ইট ভাটায়। ট্রেন ও বাসের নিচেও ফেলে সাজানো হয়েছে দুর্ঘটনার নাটক। তিনি আরও জানান, গুম নিয়ে বাহিনীর অনেকের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও কেউ কথা বলার সাহস করতে পারেনি। কারণ, তিন স্তরে গুম বাস্তবায়নের শীর্ষে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দ্বিতীয় স্তরে গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধানরা। আর তৃতীয় স্তরে বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্বরতরা। কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এখনও আগের মতোই দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং পূর্ববর্তী কাঠামো বহাল রয়েছে, যা তদন্তে বাধা তৈরি করছে।

কমিশন সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুমসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে। আর এই গুমের ঘটনাগুলো স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, এগুলো একক ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন কাজ ছিল না। বরং প্রতিটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ইউনিটের একাধিক সদস্যের অংশগ্রহণ ছিল, যা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অজান্তে হওয়া প্রায় অসম্ভব। এসব ইউনিটে গোয়েন্দা সংস্থার নিজস্ব সদস্যরা নিয়মিতভাবে নিযুক্ত থাকতেন, যাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল সহকর্মীদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে ঊর্ধ্বতনদের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া। তাসত্ত্বেও, সংশ্লিষ্ট সময়কালে অপরাধের মাত্রা ছিল ব্যাপক ও বহুলচর্চিত। অথচ, পর্যালোচনা করা কোনো ফাইলেই ‘গুম’ শব্দটি উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি। মনে হয় যেন এই সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা কখনও এমন কোনো অপরাধে জড়িতই হননি।

এতে আরও বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য অনেকের সঙ্গে আলোচনায় দেখা গেছে তারা গভীরভাবে ভীত। তবে তাদের ভয় কমিশন বা এর জবাবদিহিতার ম্যান্ডেটের প্রতি না। বরং, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেকেই স্পষ্টভাবে বলেছেন, তাদের ভয় নিজেদের প্রতিষ্ঠান থেকেই। অনেকে প্রতিশোধের ভয় পাচ্ছেন, এমনকি প্রাণনাশের আশঙ্কাও করছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার আশঙ্কা রয়েছে এমন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে রাখা বা রক্ষা করার ফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির সৃষ্টি হয়, যা সব বাহিনীর জন্য বিবেচ্য। যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তারা ভবিষ্যতে নিজের অপরাধ আড়াল করতে গিয়ে অনুমোদনহীন ও ক্ষতিকর পদক্ষেপ নিতে পারেন। এর ফলে তাদের অবস্থান, গোপনীয়তা বা উদ্বেগের সুযোগ নিয়ে তাদের অজান্তেই শত্রুপক্ষের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এতে শুধু ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ও সততার প্রশ্ন ওঠে না, স্পষ্টতই জাতীয় নিরাপত্তাও বিপন্ন হতে পারে।