দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীতে। সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় একটি ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের যে দাবি ছিল বাহিনীর সদস্যদের, তা এখন চূড়ান্ত। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে পুলিশের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তার আগেই পুলিশকে পেশাদারিত্ব, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও প্রভাবমুক্ত করতে এই কমিশন চূড়ান্ত করে গোটা বাহিনীকে উজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগকে পুলিশ বাহিনীর জন্য বিশেষ প্রণোদনা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগেও আরও দু’দফায় একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সর্বশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০০৭ সালে। তৃতীয় দফায় অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’। খবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও পুলিশ সদর দফতর সুত্রের।

সূত্র জানায়, সরকার দেশে একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ প্রশাসন গড়তে ‘পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে একটি অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চ পর্যায়ের সভায় এই অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এখন এটি আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে অধ্যাদেশ আকারে জারি করতে পরবর্তী প্রশাসনিক উদ্যোগ নেবে। রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করার পরই সরকার কাঙ্খিত পুলিশ কমিশন গঠন করবে। এরপর থেকেই পুলিশ কমিশনের আওতায় আসবে।

এদিকে, রোববার বিকেলে পুলিশ সদর দফতরের হল অব প্রাইডে আগামী দিনের পুলিশ প্রশাসনকে আরও দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক করার লক্ষ্যে প্রণীত ‘বাংলাদেশ পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ-২০২৫ (খসড়া)’ নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ পুলিশের নীতিনির্ধারণে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা যুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) বাহারুল আলম। সভায় বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পুলিশ পরিদর্শক মনিরুল হক ডাবলু সংগঠনের পক্ষে অংশ নেন।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন গতকাল সোমবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগকে বাংলাদেশ পুলিশ ইতিবাচকভাবে দেখছে এবং আশাবাদী। কারণ আমরা সবসময়ই জনবান্ধব, নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক ও আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থার পক্ষে।

প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী, স্বাধীন পুলিশ কমিশনের মূল লক্ষ্য হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ প্রতিরোধ, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং পুলিশ সদস্যদের পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। খসড়া অনুযায়ী, নতুন কমিশনের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি, অভিযোগ তদন্ত এবং প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই কমিশন গঠনের মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসন সরাসরি রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পারবে। মানবাধিকার সংস্থা, নাগরিক সমাজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করায় এটি হবে একটি বহুমাত্রিক, ভারসাম্যপূর্ণ ও জবাবদিহিমূলক তদারকি সংস্থা।

অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ; নাগরিক অভিযোগ ও পুলিশ সদস্যদের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ; নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও পরামর্শ প্রদান; আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর পুলিশ গঠনে সুপারিশ প্রদান; জনআস্থা বৃদ্ধির জন্য গণশুনানি ও পরামর্শ সভা আয়োজন; পুলিশের কার্যক্রম ও জননিরাপত্তা সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ। এছাড়া কমিশন প্রতি বছর তার বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবে, যা পরে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে।

অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, ‘পুলিশ কমিশন’ নামে এই সংস্থাটি হবে একটি সংবিধিবদ্ধ, স্বাধীন ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। কমিশনের নিজস্ব দপ্তর, বাজেট ও জনবল থাকবে এবং এটি সরকারের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কমিশনের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হবে ঢাকায়।

কমিশনের গঠন ও কাঠামো : কমিশনে মোট ৯ জন সদস্য থাকবেন। এর মধ্যে একজন চেয়ারম্যান, একজন সদস্য-সচিব এবং আরও সাতজন স্থায়ী সদস্য। চেয়ারম্যান হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আর সদস্য-সচিব হবেন অবসরপ্রাপ্ত একজন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা। সদস্যদের মধ্যে থাকবেন, জাতীয় সংসদের সংসদ নেতার প্রতিনিধি (অস্থায়ী সদস্য), বিরোধী দলীয় নেতার প্রতিনিধি (অস্থায়ী সদস্য), সচিব পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, জেলা জজ বা খ্যাতনামা আইনজীবী (যিনি অন্তত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন), বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও ক্রিমিনাল জাস্টিস বিষয়ের একজন অধ্যাপক, একজন খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী (যার অন্তত ১৫ বছরের বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে)।

প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে, কমিশনে অন্তত একজন নারী সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক। স্থায়ী সদস্যরা বেতনভুক্ত হবেন, তবে অস্থায়ী সদস্যরা অবৈতনিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

নিয়োগ ও মেয়াদ : কমিশনের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত বাছাই কমিটির সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। তাঁদের মেয়াদ ৫ বছর। বাছাই কমিটি হবে ৫ সদস্যের, যার সভাপতি হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা। অন্য সদস্যরা হচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি (প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত), জাতীয় সংসদের স্বরাষ্ট্র সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি,জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একজন সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত একজন অধ্যাপক। কমিশনের চেয়ারম্যানের মর্যাদা হবে আপিল বিভাগের বিচারপতির সমান, এবং সদস্যদের মর্যাদা হবে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমান। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতি বা পদ শূন্য থাকলে, কমিশনের জ্যেষ্ঠ সদস্য কার্যভার পালন করবেন।

অযোগ্যতা ও অপসারণের বিধান : দেউলিয়া, ঋণখেলাপি, দ্বৈত নাগরিক, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত, দুর্নীতি বা অসদাচরণের কারণে বরখাস্ত এমন কেউ কমিশনের সদস্য হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা, স্বার্থগোপন বা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে সদস্যকে অপসারণ করতে পারবেন।

অভিযোগ অনুসন্ধান ও নিস্পত্তি: পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নাগরিক অভিযোগের ন্যায়সংগত তদন্ত ও সমাধান নিশ্চিত করবে কমিশন। নাগরিকদের অভিযোগের তদন্ত, বিভাগীয় কমিটি গঠন, অভিযোগকারীর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অভিযোগ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও প্রদান করবে কমিশন।

পুলিশ সদস্যদের সংক্ষোভ নিরসন : পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, বৈষম্য, পদোন্নতি বা পদায়ন সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য কমিশন সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে। প্রয়োজনে বিভাগীয় বা রেঞ্জ পর্যায়ে কমিটি গঠন করবে।

নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা : কমিশন পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন ও মানদণ্ড নির্ধারণে সরকারের কাছে দিকনির্দেশনা দেবে। কমিশন সুপারিশ করবে যে, সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটিতে অতিরিক্ত আইজিপি অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।

পুলিশপ্রধান (আইজিপি) নিয়োগে সুপারিশ : অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ পদে নিয়োগের জন্য সততা, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা ও সন্তোষজনক চাকরির ভিত্তিতে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপির নিম্নপদস্থ নন এমন ৩ তিন কর্মকর্তার একটি প্যানেল সরকারের কাছে সুপারিশ করবে কমিশন। নিয়োগপ্রাপ্ত আইজিপির মেয়াদ হবে কমপক্ষে ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩ বছর।

প্রশিক্ষণ, কল্যাণ ও সক্ষমতা উন্নয়ন: আধুনিক পুলিশিং, সাইবার নিরাপত্তা, ফরেনসিক, আইটি, ও মানবিক আচরণভিত্তিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে সুপারিশ; নারী-বান্ধব কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রমে দিকনির্দেশনা দেবে প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন। এছাড়া পুলিশ আইন, ফৌজদারি আইন, রেগুলেশন, প্রবিধান ইত্যাদির পর্যালোচনা ও সংস্কারের প্রস্তাব করবে। জনগণ-পুলিশ আস্থা বৃদ্ধিতে প্রস্তাবিত কমিশনে গণশুনানি, পরামর্শসভা ও সচেূনতামূলক কার্যক্রম আয়োজন করে পারস্পরিক বিশ্বাস পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে অধ্যাদেশের খসড়ায়।

বার্ষিক প্রতিবেদন ও জবাবদিহিতা : প্রতি বছর কমিশন একটি বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করবে, যেখানে তাদের কর্মকাণ্ড, সুপারিশ ও সাফল্যের বিবরণ থাকবে। এই প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হবে এবং তিনি তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের জন্য স্পিকারের কাছে পাঠাবেন।

বিশেষ দায়িত্বে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা : অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে গেলে বা কার্যকর না থাকলে রাষ্ট্রপতি, সরকার প্রধানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ৪ জন অস্থায়ী সদস্য নিয়োগ করতে পারবেন। তদুপরি, চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে কমিশনের জ্যেষ্ঠ সদস্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

সদর দফতরে বৈঠক : পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, রোববার বিকেলে ‘বাংলাদেশ পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ-২০২৫ (খসড়া)’ নিয়ে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ সভায় আলোচনাকালে মনিরুল হক ডাবলু বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশ কমিশনে মাঠ পর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অন্তত একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যাবশ্যক। এতে কমিশনের নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটবে। এছাড়া অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পুলিশের সার্বিক উন্নয়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ছিল, পুলিশ সদস্যদের ন্যায্য পদোন্নতি নিশ্চিত করা, কমিশনে পুলিশের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা দায়েরের পরিবর্তে কমিশনের মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণের বিধান সংযোজন, পুলিশের গ্রেড ও বেতন কাঠামোর উন্নয়ন এবং সরাসরি এএসআই নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা নিরসন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক : গত ৯ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গণি, পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম প্রমুখ।

বৈঠক সূত্র জানায়, কমিশন তৈরির চূড়ান্ত প্রস্তাবনা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সভায় যেসব পরামর্শ এসেছে, তা কমিশন গঠনের প্রস্তাবে যুক্ত করা হচ্ছে। বৈঠকে পুলিশ কমিশনের গঠন ও কর্মপরিধি চূড়ান্ত করা হয়। পুলিশ কমিশনের পাশাপাশি জবাবদিহিতা কমিশন নামে আলাদা কমিশন করার চিন্তাভাবনা প্রথমে ছিল। পরে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক হয়, পুলিশ কমিশনের আওতায় দুটি কমিটি কাজ করবে। এর মধ্যে জবাবদিহির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কোনো নাগরিক পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে ভয় পেলে, কমিশন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অভিযোগের তদন্ত করতে পারবে। পুলিশের জবাবদিহি আরও স্বচ্ছ করতে বিভাগীয় পর্যায়ে কমিশনের অধীনে আলাদা টিম কাজ করবে

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বহু দেশে পুলিশ কমিশন রয়েছে। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের অন্যতম উদ্দেশ্য, পুলিশকে আরও সেবামুখী করা; মানবাধিকার, মূল্যবোধ নিশ্চিতকরণ ও কাজের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বাড়ানো। এ কমিশন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে পুলিশের শক্তি প্রয়োগ, আটক, জিজ্ঞাসাবাদ এবং মামলার তদন্তের মান বাড়ানোর সুপারিশ করতে পারবে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পুলিশের ভেতর থেকে এ ধরনের কমিশন গঠনের দাবি জোরালো হয়। আওয়ামী আমলে পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সে জায়গা থেকে বের হওয়ার জন্যই পুলিশ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন কর্মকর্তারা। গত ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের ১১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে পুলিশের ১৩ বিষয়ে ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তার করে। বাহিনীর সংস্কারে ২২টি আইন সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে কমিশন। এসব সংস্কার বাস্তবায়নে চারটি ধাপের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু বিষয় দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নের সুপারিশ রেখেছ কমিশন।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং তাদের কার্যক্রমে জবাবদিহি বৃদ্ধি করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। এ উদ্যোগে পুলিশের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো তৈরি করা দরকার। পাশাপাশি পুলিশের মধ্যে সুষ্ঠু তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে কোনো ধরনের অপব্যবহার বা দুর্নীতির সুযোগ না থাকে। নাগরিকদের প্রতি পুলিশের দায়িত্বশীলতা বজায় রেখে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত আইনগত ও প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করা হবে। একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে এবং পুলিশের কার্যক্রম যাতে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করে কমিশন। এছাড়া বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহি নিশ্চিতে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে উপস্থাপন করলে, তারা ঐকমত্য হয়।