আইনি দুর্বলতার কারণে জন্ম ও মৃত্যু সনদ নিয়ে ভোগান্তি কমছে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ দ্রুত সংশোধন করে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে আইনগতভাবে নিবন্ধনের দায়িত্ব দেওয়া হলে ভোগান্তি কমার পাশাপাশি নাগরিক সেবা ত্বরান্বিত হবে। একইসঙ্গে, জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন সনদের ভুল সংশোধনের আবেদনের ফি মওকুফ এবং নিবন্ধন তথ্য ব্যবহার করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে ‘ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস’ প্রস্তুত বাধ্যতামূলক করলে এর সুফল পাওয়া যাবে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর বিএমএ অডিটরিয়ামে প্রজ্ঞা আয়োজিত সাংবাদিকদের নিয়ে ওয়ার্কশপে এসব কথা উঠে আসে। এতে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে জন্ম নিবন্ধনের হার মাত্র ৫০ শতাংশ এবং মৃত্যু নিবন্ধনের হার ৪৭ শতাংশ, যেখানে বৈশ্বিক গড় যথাক্রমে ৭৭ ও ৭৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন- মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যেই প্রায় সর্বজনীন নিবন্ধন নিশ্চিত করেছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে।
বর্তমানে সিটি মেয়র, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী, বিদেশে রাষ্ট্রদূত এবং তাদের অনুপস্থিতিতে ক্ষেত্র মতে প্রশাসক জন্ম ও মৃত্যু সনদ দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে স্থান কাল সময় ভেদে নানা হয়রানির শিকার হন সেবাপ্রার্থীরা। এসব সমস্যা নিরসনে এক গুচ্ছ পরামর্শ উঠে আসে কর্মশালায়।
বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সকল জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন নিশ্চিতকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে বিদ্যমান জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এর আইনি ও বাস্তবায়নের দুর্বলতা এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। এর প্রেক্ষিতে সংশোধনের মাধ্যমে আইন শক্তিশালী করণ এবং কার্যকর নিশ্চিত করা গেলে বৈশি^ক লক্ষ্যমাত্রা ত্বরাণি¦ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক অথবা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রসমুহে সংঘঠিত জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্ব আইনগতভাবে দেওয়া, জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে সনদের ভুল সংশোধনের আবেদন করা হলে ফি মওকুফ করা, জন্ম মৃত্যুর নিবন্ধনের তথ্য ব্যবহার করে পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস প্রস্তুত বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করাসহ প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন। এজন্য দক্ষ জনবল তৈরি ও আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন।
তারা বলছেন, এতে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় জন্ম নেওয়া প্রায় ৬৭ শতাংশ শিশু স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধনের আওতায় আসবে। জনপ্রতিনিধিদের এই সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানো গেলে মৃত্যু নিবন্ধন নিশ্চিত করার মাধ্যমে উত্তরাধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা ও নারীর অধিকার সুরক্ষা করাসহ অনেক সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ২০০১ সালে ইউনিসেফের সহায়তায় জন্মনিবন্ধন শুরু হয়। সরকার ২০০৪ সালে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন করে ও ২০০৬ সলে থেকে তা কার্যকর হয়। এ আইনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-লিঙ্গ নির্বিশেষে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি মৃত্যুরও ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যুসনদ সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়। ১৬টি কাজের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। এগুলো হলো- পাসপোর্ট ইস্যু, বিয়ে নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, আমদানি বা রপ্তানি বা উভয় লাইসেন্স, গ্যাস-পানি-টেলিফোন-বিদ্যুৎ সংযোগ, ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (টিআইএন), ঠিকাদারি লাইসেন্স, বাড়ির নকশা অনুমোদন, গাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি।
ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ১২ কোটির বেশি মানুষ নানা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। আমরা আইন সংশোধনের পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের কার্যকর বাস্তবায়নে নিবন্ধন বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, জনবল ঘাটতি দূরীকরণ, প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান, প্রক্রিয়াগত জটিলতা হ্রাস এবং সংশ্লিষ্ট সকল খাতকে সমন্বিতভাবে কাজ করার পরামর্শ দেন। কর্মশালায় রিসোর্স পারসন হিসেবে অংশ নেন জিএইচএআই বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মাদ রূহুল কুদ্দুস, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জোবায়ের প্রমুখ। বিভিন্ন প্রেজেন্টেশন দেন প্রজ্ঞার হেড অব প্রোগ্রাম মুহাম্মদ হাসান শাহরিয়ার ও কো-অর্ডিনেটর মাসিয়াত আবেদিন।
আলোচকরা বলেন, আইন সংস্কারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের দায়িত্ব দিলে ২০৩০ সালের মধ্যে সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এটি এসডিজি’র ১৬.৯ লক্ষ্যমাত্রা-জন্ম নিবন্ধনসহ সবার জন্য বৈধ পরিচয়পত্র প্রদান অর্জনে সহায়ক হবে।