এডভোকেট শাহ মাহফুজ হক, বাংলদেশ জামায়াতে ইসলামীর শাহবাগ থানার আমীর এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি। এই শাহবাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই জুলাই আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। এই থানার অধীনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ জুলাই আন্দোলনের নীতি নির্ধারণী কর্মসূচী পালনের গুরুত্বপূর্ণ স্পট। পুরো জুলাই আন্দোলনজুড়ে এই থানাকে পালন করতে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এর কিছু অংশ দৈনিক সংগ্রামের পাঠকের জন্য তুলে ধরেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : শাহবাগ হচ্ছে জুলাই আন্দোলনের ফোকাল পয়েন্ট। এছাড়া শাহবাগ থানার অধীনে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আন্দোলনের পুরো সময়ে রয়েছে শাহবাগ থানার গুরুত্বপূর্ণ কিভাবে দায়িত্বপালন করেছেন ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : দৈনিক সংগ্রামের পাঠক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ছাত্ররা যখন এই আন্দোলন শুরু করে তখন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি হিসেবে এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শাহবাগ থানা আমীর হিসেবে আমি এবং থানার সকল জনশক্তি নিয়ে আমরা আন্দোলনের সাাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। এবং আন্দোলনের পুরো প্রক্রিয়ার সাথে আমরা জড়িত ছিলাম।
আসলে ২০২৪ সালের গণ অভ্যূত্থান গুণ বিপ্লব যে নামেই ডাকি না কেন, ছাত্র-জনতার স্বর্তস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই হয়েছে। আমি বলতে চাই যে এটা কোন একদিনের আন্দোলন না। এটা মূলত স্বৈরাচার হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন তথা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিরোধী দলের ওপর দমন নির্যাতন অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছে তার ধারাবাহিকতা। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে দিচ্ছিল না। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনের কোন উপায় যেগুলো ছিল তত্ত্ববাধায়ক সরকার বা জনগণের ভোট সবগুলোকে তারা বন্ধ করে দিয়েছিল। নির্বাচনের আগে ১৫৪জন নির্বাচিত করে ফেলা কিংবা আমি-ডামির নির্বাচনের প্রক্রিয়া এবং বিরোধীদলকে রাজপথে দাঁড়াতে না দেওয়ার অবস্থা তৈরি করা বা তাদের জঙ্গি. রাজাকার. স্বাধীনতা বিরোধী ট্যাগ দিয়ে ভিন্নমত দমন। একারণেই ছাত্র-জনতার এই অভ্যূত্থান। এটা মূলত দীর্ঘ সময়ে নির্যাতনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এবং জনঅনাস্থার বিস্ফোরণ। সরকারকে যে জনগণ চায় না তার একটা বহি:প্রকাশ ছিল এই আন্দোলন।
দৈনিক সংগ্রাম : শুরুর দিক থেকে যদি একটু বলেন।
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : আন্দোলন যখন ডাক দিয়েছে তখন আব্দুল হান্নান মাসউদ, আমার বাসায় আসে। আমরা কথা বলি। কিভাবে আমরা ২০০৬-৭ সালে আন্দোলন করেছি। সেটা কিভাবে হয়েছে, কিভাবে আমরা আন্দোলনটা গড়ে তুলেছিলাম। এরপর অনলাইনে আড্ডা হয়েছে। কিভাবে সে আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়েও কথা হয়েছে। আন্দোলন শুরুর পর সাদিক কায়িম এস এম ফরহাদ-সিবগাতুল্লাহ, ঢাবির সাবেক সভাপতিদের মাহবুব ভাই, জুনায়েদ, শরফুদ্দিন, আতিকুর রহমান। আমরা সবাই প্রায় সময় বসতাম আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করা এবং পলিসি নির্ধারণের জন্য।
দৈনিক সংগ্রাম : সাধারণত কোন দিকে বসতেন ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : একেক দিন একেক দিকে বসতাম। প্রতিদিন এক জায়াগাতে বসার সুযোগ ছিল না নিরাপত্তার কারণে। বিভিন্ন জনের অফিসে। কোন হাসপাতাল কিংবা রেস্টুরেন্টে বা আমার বাসায়। পরিস্থিতি অবজার্ভ করে ঠিক করতাম পরবর্তী পলিসি কি হওয়া উচিত। শুরুর দিকে যখন আন্দোলন শুরু হলো--- তখন মাইক লাগবে, রিকশা লাগবে খাবার এবং পানি লাগবে। যা যা লাগবে সাপ্ল্ইা চেইন বলতে যা বোঝায়, আন্দোলনটাতো শুরু হয় শাহবাগ কেন্দ্রীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক। এগুলো সরবরাহটা আমার মাধ্যম দিয়ে হয়েছে বা আমরা করেছি। বিশেষ করে মহানগরী ছাত্র সংগঠনের সাথে ছাত্রদের সমন্বয় বা কো-অর্ডিনেশনটা আমি একজন সাবেক ঢাবি শিবিরের সভাপতি হিসেবে করেছি। এবং আন্দোলনের যেকোন মিছিল মিটিংয়ে আমরা ছিলাম। গার্ডিয়ানদের ব্যানারে আমরা কাঁটবনে মানববন্ধন করেছি, অবস্থান ধর্মঘট করেছি।
দৈনিক সংগ্রাম : গার্ডিয়ানের ব্যানারে কোনদিন অবস্থান ধর্মঘট শুরু করলেন?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : এটা ১৪ জুলাই করেছি। এরপর আন্দোলন যখন বেগবান হলো, ১৬ তারিখ যখন আবু সাঈদসহ ৬ জন শাহাদাত বরণ করলো, তখন ঢাবি শিবিরের সভাপতি সাকিক কায়িম এবং ফরহাদ ফোন করে বললো যে আমরা কফিন মিছিল করতে চাই। গায়েবানা জানাজা এবং কফিন মিছিল, আমাদের কফিন লাগবে। তখন আমি বললাম --- ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করতেছি। তখন আমরা কাঁটাবনে দুইটা কফিন বানানোর জন্য বলি। এছাড়া আমি জামায়াতের মহানগরীর সাথে যোগাযোগ করে বলি যে ঢাবি শিবির ৬টা কফিন চেয়েছে। মহানগরী সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি। বলি যে তাদের দিতে হবে। তিনি বলেন যে দেলোয়ার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেন। পল্টন থানার আমীর শাহিন ভাইয়ের সাথে সমন্বয় করে মগবাজার থেকে দুইটা কফিন এম্বুলেন্সে করে ৪টা করে ৮টা কফিন পাঠাই। পুলিশ যেহেতু ঢাবির রাজু ভাষ্কর্যের কাছে ব্যারিকেট দিয়ে রেখেছিল। তাই কফিনগুলো ভেতরে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এদিক দিয়ে জানাজা শুরু হয়ে যাবে ভিসির বাসভবনের সামনে। তখন এসএম ফরহাদ বললো তখনকার ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক জাহিদ আপনার সাথে সমন্বয় করবে। জাহিদ ফোন করে বলে ভাই কফিন লাগবে। আমি বলি কফিনতো এসেছে। কিন্তু পুলিশতো আটকে দিয়েছে। তোমরা এক কাজ করো--- মুজিব হলের পেছনের গেইট দিয়ে যে পকেট গেইট আছে, এখান দিয়ে আমরা সাদা কাপড় দিচ্ছি, তোমরা সেগুলো নিয়ে কোনভাবে কাঠ দিয়ে অন্তত প্রতিকী কফিন বানানোর চেষ্টা করো। আমরা ওয়ালের ওপর দিয়ে কাপড়ের পুটলা দিয়ে দিলাম। তারা এসে নিয়ে গেল। তখন তারা জানালো কফিন বানানোর মতো কাঠ তারা পাচ্ছে না। তখন আমি বললাম যে এক কাজ করো। তোমরা মিছিল নিয়ে নীলক্ষেতের দিকে আসো। পুলিশ তখন তোমাদের বাধা দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে। আমরা পেছন থেকে তোমাদের হাতে একটা কফিন দিয়ে দেবো। তোমরা কফিন নিয়ে চলে যাবে। আমরা কাঁটাবন থেকে কফিন নিয়ে আমাদের থানার অর্থ সম্পাদক তানভীর আহমদ ভাই এবং কাঁটাবন ওয়ার্ডের সেক্রেটারি তারেকভাইকে দিয়ে পাঠাইলাম। তারা নীলক্ষেতের মোড় দিয়ে কফিন নিয়ে গেলেন নীলক্ষেত হাইস্কুলের সামনে দিয়ে। ওদিক দিয়ে তারা মিছিল নিয়ে গেলো আর পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলো। এদিক দিয়ে আমরা কফিন তাদের কাছে নাস্ত করে দিয়ে দিলাম। তখন কফিন চলে গেছে। কিন্তু কফিনতো একটা। লাগবে ৬টা। ততক্ষণে এম্বুলেন্স ব্যারিকেট ভেঙ্গে চলে এসেছে। আমি বললাম তোমাদের সামনে এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। এম্বুলেন্স খোলো। ভেতরে কফিন আছে। যখন সেখানে কফিন পৌছে গেল তখন একটা আবেগ ঘন পরিবেশ তৈরি হলো। সবাই আবেগে আপ্লুত হলো। অনেকেই মনে করছিল যে লাশ চলে এসেছে। এম্বুলেন্সে যেহেতু এসেছে। গায়েবানা জানাজা শেষ করে কর্মসূচি অনুযায়ী কফিন কাঁধে নিয়ে যখন মিছিল শাহবাগের দিকে রওয়ানা দিলো তখন পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ করলো।
দৈনিক সংগ্রাম : এরপর কিভাবে আন্দোলন চললো ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : এরপর যখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলো। ছাত্ররা যাতে আন্দোলন করতে না পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় খালি করার চিন্তা করলো। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে না- যারা আন্দোলন করে অর্থাৎ ছাত্ররা যদি চলে যায়, তাহলে কি হবে। তাদের চলে যেতে দেওয়া যাবে না। তখন আমরা অনলাইনে বৈঠক ডাকলাম। সাবেক সভাপতি এবং দায়িত্বশীল যারা আছে তারা কথাবার্তা বলে জনশক্তিকে কোথায় কোথায় রাখা যায় সে ব্যবস্থা করি।
দৈনিক সংগ্রাম : কোনদিন আপনারা এই সিদ্ধান্ত নেন। কোথায় কোথায় রাখা হলো তাদের ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৭ জুলাই। আমাদের বাসায়. বিশ্ববিদ্যালয়ের মেস সুধীদের বাসায়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেকদের বাসায় জায়গা দেওয়া হলো। একারণে মূলত সরকারের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সরকার মনে করেছিল যে হল বন্ধ থাকলে ছাত্ররা বাড়ি চলে যাবে। এমনকি ছাত্রীরাও আমাদের এসব বাসায় ছিল। আমরা শাহবাগ কাঁটাবন এসব এলাকাতে এই ব্যব্সথা করলাম। ফলে ছাত্রলীগের সমস্ত কর্মসূচি ট্যাকেল দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করতে পারলাম। লোক দিয়ে সহযোগিতা করলাম। এভাবে চঃলতে থাকলো। এই সময়টাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে স্থানীয় গার্ডিয়ান নিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করলাম। সেখানে বামদের একটা কর্মসূচি ছিল মোমবাতি প্রজ্জ¦লন। তাদের মধ্যে ঢুকে আমরাও মিছিল শুরু করলাম। সেখানে আমরা যখন সরকার পতনের স্লোগান দিচ্ছি বা বক্তব্য দিচ্ছি; তখন ছাত্র ইউনিয়নের যারা ছিল তারা আমাদের মুখ চেপে ধরলো। বললো- এসব কথা বলা যাবে না। আমরা বললাম আমরা সরকারের পতন ছাড়া আমাদের আন্দোলন বন্ধ হবে না।
দৈনিক সংগ্রাম : যখন ইন্টরনেট বন্ধ হলো. তখনকার আন্দোলনের কৌশল নিয়ে যদি কিছু বলেন।
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : তখন আমাদের যারা ছাত্র আন্দোলনের দায়িত্বে ছিলেন. বিশেষ করে ছিবগাত উল্লাহ ভাই আমার কাছে এলেন। আমিতো বিগত ১৩/১৪ সালে সরকার পতনের আন্দোলনে জড়িত ছিলাম। আমি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করতে পারিনি। সরকার পরিবর্তনের পর ক্যাম্পাসে যাই। এর আগে দুইদিন গিয়েছিলাম। এরমধ্যে একদিন লাইব্রেরীতে আক্রমণ করে। আমাকে নিয়ে মেরে ফেলার জন্য চেষ্টা করে। তারপর সেখানকার স্টাফরা আমাকে নিয়ে তিনতলায় এক আলমারির ভেতর রেখে দরজা বন্ধ করে রাখে। সেদিন ভিসি প্রক্টর এবং পুলিশের সহায়তায় বেরিয়ে আসি। এটা ২০০৯ সালের কথা। ১২/১৩ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন তুঙ্গে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি। এসব সময় পার করে এসেছি। এসব কঠিন পরি্িস্থতিতে আমরা কিভাবে কাজ করেছি তা নিয়ে সিবগাতুল্লাহ ভাইকে নিয়ে আমরা স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে রাতের বেলা হে^ঁটে হেঁটে কথা বলতাম।
দৈনিক সংগ্রাম : তখন আপনাকে কি প্রশাসনের লোকজন চিনতো ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : প্রশাসনতো চিনতো। তবে আমি ছদ্মবেশে ছিলাম্। দেখা গেছে মাস্ক পরে হাঁটছি। আর সাদিক আর ফরহাদ যেহেতু চট্টগ্রামের মানুষ তারা যেন তাদের লোকাল ভাষায় কথা বলে। তাহলে আর কেউ সন্দেহ করবে না। আবার মোবাইলে কথাবার্তা না বলে সরাসরি দেখা সাক্ষাত করার ব্যবস্থা করা। বলা হতে অমুকদিন অমুক জায়গাতে আসেন। কৌশলটা ছিল কেউ যাতে চিন্তা না করতে পারে। এখানে এমন কিছু হতো পারে।
দৈনিক সংগ্রাম : এরপর ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : পহেলা আগস্ট প্রশাসন বুঝতে পারে যে, আন্দোলনে আমার ভূমিকা আছে। তখন তারা আমার বাসায় যৌথবাহিনী অভিযান চালায়। আপনার ভাবি তখন পেটে বাচ্চা। আমি সাধারণত বাসায় থাকতাম না। ওই দিন বাসায় এসেছিলাম। রাতে তখনই অভিযান শুরু হয়। তো সব সময় সতর্ক থাকতাম। আমার ওয়াইফ টের পেয়ে আমাকে বলে বাসায় পুলিশ এসেছে। আমি দেখলাম যে পুলিশের দুইটা গাড়ি। কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে। দেখলাম মোবাইল ট্রাকিং করছে। বুঝলাম যে তারা কনফার্ম লোকেশনটা পায়নি। তখন আমি ছাদে ওঠার চেষ্টা করলাম। সেখানে গিয়ে মনে হলো পুলিশ সেখানে যেতে পারে। তো আমি আবার নিচে আসলাম। নিচের দিকেও যাওয়ার চেষ্টা করলাম। দেখলাম যাওয়ার কোন সুযোগ নাই। এরপর আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনতলায় গিয়ে জানালা দিয়ে মোবাইলটা বাইরে ফেলে দিলাম। এমনভাবে দূরে ফেললাম যে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ছাদের ওপর গিয়ে পরলো। এরপর দেখলাম যে বাসার সামনে আরও কযেকটা গাড়ি এসেছে। তখন আমি ছাদের একতলা নিচে পানির টাংকির নিচে শুয়ে ভেতরে গেলাম। যাতে দেখা না যায়। সেখানে অন্ধকার এতো বেশি ছিল যে অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ঃেলাকেশন ঠিক করতে না পেরে চলে যায়। এরপর আরও সতর্ক হয়ে যাই।
দৈনিক সংগ্রাম : পরের দিনগুলো কিভাবে আন্দোলন করলেন ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : ৩রা আগস্ট ছাত্রদের সাথে শহীদ মিনারে মিছিলে ছিলাম। ৪ঠা আগস্ট শাহবাগ মোড়ে ছিলাম। সেখানেতো যুবলীগ ছাত্রলীগ কোনভাবেই অবস্থান করতে দিবে না। সেদিন ফার্ম গেটের দিক থেকে গুলি করে। আমরা আবার তাদের ধাওয়া দিয়ে ফার্মগেইট কাওরান বাজার পার করে দেই। সাইন্সল্যাবে ঝামেলা করার চেষ্টা করলে আমরা তাদের জিসপজিশন করি। সন্ধ্যায় কর্মসূচি শেষ করে যখন বাসায় ফিরি তখন বাসরা সামনে প্রচন্ড গোলাগুলি হয়। তখন আমি আর বাসায় যেতে পারিনি। তখন একটা দোকানে রাত কাটাই। পরদিন সকালে বাসায় যাই এবং মার সাথে দেখা করি। তখন আমার মা বাসায় ছিলো।
দৈনিক সংগ্রাম : তারাপর ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : ৫ আগস্ট সকাল দশটার দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার উদ্যোগ নেই। ততক্ষণে চানখারপুল আর শহীদ মিনারে প্রচন্ড গোলাগুলি চলতে থাকে। কাউকে নামতে দিচ্ছে না। দেখামাত্র গুলি করছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে কেউ নার্স হিসেবে কেউ রোগী হিসেবে আসতে থাকলো পিজির দিকে। কেউ প্রেসক্রিপশন নিয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য এসেছিলো। আমিতো তখন বাসা থেকে দশটার দিকে বের হবো। মা তখন আমরা সামনে এসে দাঁড়ালেন। বউ বাধা দিতে পারলেন না। কারণ বিয়ের সময় তার সাথে কথা হয় যে আমি শিবির করি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছি। যেকোন সময ক্রসফায়ার দিতে পারে। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেও ধরে নিযে যেতে পারে। এরকম জীবন বেছে নিবেন কি-না। তখন অবশ্য তিনি খুব চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি একজন ভাল মানুষ বিযে করলাম। তিনিতো গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারে কিংবা রোগ হয়ে মারা যেতে পারে। সুতরাং আমার ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু সেদিন মা সামনে এসে দাঁড়িযে বলেন যে আজ তোকে বাসা থেকে বের হতে দেবো না। আমি বলি মা সারাদেশ থেকে মানুষ আসছে। শেখ হাসিনা মানুষ মারছে তার প্রতিবাদ করতে। তখন মা বলেন যে আমার দিকে না তাকাস। তিনটা মেয়ের দিকে তাকা। তাদের জন্য কি তোর দয়ামায়া হয় না ? আমি বলি ১৭ বছর কিছু হয়নি। আপনি দোয়া করেন মক্কা বিজয়ের মতো একটা বিজয় যেন হয়। যখন বের হচ্ছিলাম তখন দুচোখ দিয়ে পানি পরছিল। মনে মনে ভাবছিলাম আর কি দেখা হবে মার সাথে ? সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর সাথে ? সাড়ে এগারটার দিকে আমি পিজিতে পৌঁছাই। ১ নস্বর এবং ২ নম্বর গেইটের মাঝখানে। বেলা ১২টার দিকে আমরা প্রথম মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে যাই। অবশ্য সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছিল। তখন কেন যেন আমাদের বাদা দেয়নি। আমরা একত্রিত হচ্ছি সেটা সেনাবাহিনী দেখছিল। তখন আমরা অবজার্ভ করছিলাম যে, আমাদের পিছন থেকে আক্রমণ করে কি-না।
দৈনিক সংগ্রাম : সেনাবাহিনীর কাছে ম্যাসেজ ছিল না যে শেখ হাসিনা পালাবে ?
এডভোকেট শাহ মাহফুজ : হয়তো ছিল। কিন্তু তারাতো আমাদের সেটা বুঝতে দেয়নি। তখন আমরা নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার স্লোগান দেই। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ছাত্ররা আসতে শুরু করে। তখন আমরা সেনাবহিনীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাই। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার জনতা একত্রিত হয়ে যায় চারদিক থেকে। জোয়ারের মতো মিছিল চলে আসে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে।