* যুদ্ধবিরতিতেও হামলার অভিযোগ পরস্পরের বিরুদ্ধে

* ইরানে সরকার পরিবর্তন চাই না, মাত্রা ছাড়াচ্ছে ইসরাইল : ট্রাম্প

টানা ১২ দিনের সংঘাতের পর ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে। ইরান ও ইসরাইলের সংবাদমাধ্যমগুলো যুদ্ধবিরতি শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে যুদ্ধবিরতির আগে উভয় দেশই রাতভর ব্যাপক গোলাবর্ষণ চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দেশ দু’টি। এছাড়া যুদ্ধবিরতির সুনির্দিষ্ট বিবরণ এবং সময় নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল আইআরআইএনএন জানিয়েছে, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ‘সফল’ হামলার পর এই যুদ্ধবিরতি ইসরাইলের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইরানের হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির জন্য ‘মিনতি’ করেছিলেন এবং এই বিবৃতিটি উপস্থাপক পড়ে শোনান। আঞ্চলিক শক্তিধর দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার ও আইআরজিসির (ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী) সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফের শীর্ষ উপদেষ্টা মেহদি মোহাম্মাদি একে ‘বৃহৎ ও ইতিহাস গড়া বিজয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।

এর আগে, সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিকমাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে জানান, ইরান ও ইসরাইল সম্পূর্ণ ও পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে। এটি ঘোষণার প্রায় ছয় ঘণ্টা পর কার্যকর হবে। তার হিসাবে, সোমবার রাত ১২টা (ইস্টার্ন টাইম) নাগাদ যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কথা। এরপর ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন পরিচালিত ইরানের প্রেস টিভি জানিয়েছে, ইসরাইল অধিকৃত এলাকায় ইরানের চার দফা হামলার পর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ইরানের আধা-সরকারি বার্তাসংস্থা তাসনিম তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি ‘বাস্তবায়নের পর্যায়ে’ প্রবেশ করেছে। তবে ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া একধাপ এগিয়ে দাবি করেছে, এই যুদ্ধবিরতি ‘শত্রুর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে’। যদিও সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করেনি তারা। ইসরাইলী সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল টুয়েলভ ও ওয়াইনেট জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। তবে ইসরাইল সরকার এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে ইসরাইল বলেছে, যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পর ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরাইলে। ইরান এমন কোনো হামলা চালানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তেহরানের দাবি, যুদ্ধবিরতির পর তারা কোনো মিসাইল ছোড়েনি এবং ইসরাইলের অভিযোগ ভিত্তিহীন। ইরান-ইসরাইল দ্ধবিরতি চুক্তিতে গাজাকেও অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে ফিলিস্তিন।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ার পর পরিস্থিতি জটিল থাকা সত্ত্বেও ইরানের কিছু কর্তৃপক্ষ এটিকে নিজেদের ‘বিজয়’ হিসেবে উদযাপন শুরু করেছে। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রেজা আরেফ বলেছেন, এ ‘বিজয়’ প্রমাণ করে, ইরান এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দম্ভ ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে এবং ইরানের শক্তি কতটা, তা তাদের দেখিয়েছে।’

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার পর ইরানে নতুন করে হামলা চালানো থেকে বিরত থাকার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয়। আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে ইসরাইল সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, ইরানের আগের কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে যুদ্ধবিরতির ‘লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করে ইসরাইল তেহরানের কাছের একটি রাডার স্থাপনা ধ্বংস করেছে। ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের পরপরই এ কথা জানিয়েছে ইসরাইল। ফোনালাপে ট্রাম্পের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান নেতানিয়াহু। বলেছেন, তার দেশ যুদ্ধের সকল লক্ষ্য পূরণ করেছে। তিনি যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়েও আত্মবিশ্বাসী।

এর আগে বাংলাদেশ সময় সোমবার মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, ইরান ও ইসরাইল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। সামাজিকমাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই দেশের সংঘাতকে ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ দাবি করে বলেন, ‘ইরান ও ইসরাইল সম্পূর্ণ ও পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে।’ এরপর ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ইসরাইল জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। সোমবার রাতে ইরান জানায়, ইসরাইল হামলা বন্ধ করলে তারাও হামলা বন্ধ করবে। ইরানের রাষ্ট্রাত্ত সংবাদ সংস্থা ইরনার তথ্য মতে, এ দিন ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের অভিজাত বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) দুই জেনারেলসহ বাহিনীটির মোট সাতজন নিহত হয়েছেন। বিবিসির সাংবাদিকরা বলছেন, তেহরান একটি ভয়াবহ রাত পার করেছে। ইসরাইল দাবি করেছে, ইরানের হামলায় দক্ষিণ ইসরাইলের বিরশেভা শহরে কমপক্ষে ৪ জন নিহত ও ২২ জন আহত হয়েছে।

এর আগে, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে আবারো হামলা শুরুর নির্দেশ দেন ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ। গতকাল মঙ্গলবার সকালে তিনি বলেন, তেহরানের কেন্দ্রবিন্দুতে বিভিন্ন নিশানায় তীব্র হামলা চালাতে সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে, ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় কাস্পিয়ান সাগরতীরবর্তী গিলান প্রদেশে ইসরাইলী হামলায় ৯ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। প্রদেশের এক উপ-গভর্নরের বরাতে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে। তবে হামলার নির্দিষ্ট সময় ও স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়নি দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। ইসরাইলী সশস্ত্র বাহিনী (আইডিএফ) অভিযোগ করে, ‘যুদ্ধবিরতির মারাত্মক লঙ্ঘন করেছে ইরান সরকার। আমরা তার জোরালো জবাব দেব।

যুদ্ধবিরতির পর ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কথা অস্বীকার করেছে ইরান। তারা বলেছে, ফের ইসরাইল আগ্রাসন চালালে, চূড়ান্ত, দৃঢ় ও যথাযথ জবাব দেয়া হবে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল।

এদিকে টানা ১২ দিনের ইসরাইলী হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা অন্তত ৬১০ জনে পৌঁছেছে। আহত হয়েছেন আরও ৪ হাজার ৭৪৬ জন। মঙ্গলবার এসব তথ্য জানিয়েছে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সংস্থাটির মুখপাত্র হোসেইন কেরমানপুর জানান, আহতদের মধ্যে ৯৭১ জন এখনো হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এবং ৬৮৭ জনের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ১৩ শিশু, যাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটজনের মাত্র দুই মাস। এছাড়া ৪৯ জন নারী নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুইজন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। কেরমানপুর আরও জানান, ইসরাইলী হামলায় পাঁচজন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত সাতটি হাসপাতাল, ছয়টি জরুরি সেবাকেন্দ্র, চারটি ক্লিনিক এবং নয়টি অ্যাম্বুলেন্স।

নেতানিয়াহুর ওপর ‘বিরক্ত’ ট্রাম্প: যুদ্ধবিরতির পরও ইরানের ওপর ইসরাইলের নতুন হামলার ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি ‘বিরক্ত’ হয়েছেন বলে জানিয়েছে আল-জাজিরার যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি ফিল লাভেল। লাভেল বলেন, ট্রাম্প স্পষ্টতই নেতানিয়াহুর প্রতি খুবই বিরক্ত। এমনকি বলা যায়, তিনি নিজেকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার মনে করছেন। ইউরোপে একটি ন্যাটো সম্মেলনে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি বলেন, ইসরাইল এবং ইরান-দু’পক্ষই যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভেঙেছে, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। তবে, ফিল লাভেল বলেন, যদিও ট্রাম্প দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন, তবুও তার বেশি রাগ ছিল ইসরাইলের ওপর, বিশেষ করে নেতানিয়াহুর আচরণের কারণে। ওয়াশিংটন সূত্র জানায়, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে নেতানিয়াহুর সমর্থন পাওয়ার পর ট্রাম্প কাতারের সহায়তায় ইরানের সাড়া আদায়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু, এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরাইল ইরানে হামলা চালায়। আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যেন তারা ইরানে আর কোনো বিমান হামলা না চালায়। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যখন ইরানের বিরুদ্ধে ‘নিয়মভঙ্গের জবাবে ব্যাপক হামলার পরিকল্পনা’ ঘোষণা করে, তখনই ট্রাম্প এ বার্তা দিলেন। ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ইসরাইল, আর বোমা ফেলো না। ফেললে তা বড় ধরনের চুক্তিভঙ্গ হবে। তোমাদের পাইলটদের এখনই ফিরিয়ে আনো!’ এর আগে ইসরাইল দাবি করছে, ইরান যুদ্ধবিরতি ভেঙেছে। এর জবাবে নতুন করে ‘তীব্র প্রতিশোধমূলক হামলা’ চালাতে চায় দেশটি। তবে ট্রাম্পের বার্তা স্পষ্ট-আর হামলা হলে তা যুদ্ধবিরতির মারাত্মক লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে প্রেস সেক্রেটারি ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘যুদ্ধ চাইছে না’ এবং ইরানের বিরুদ্ধে আর কোনো সামরিক পদক্ষেপকে ‘অপ্রয়োজনীয় উসকানি’ হিসেবে দেখবে।

ইরানে ‘সরকার উৎখাতে’ আগ্রহ নেই ট্রাম্পের: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ইরানে ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার উৎখাতে আগ্রহী নন। কারণ তা অস্থিরতা ডেকে আনবে বলে মনে করেন তিনি। এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে করা ট্রাম্পের এ মন্তব্য তার আগের সামাজিক মাধ্যমে করা এক পোস্টের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আলজাজিরার খবরে বলা হয়, গত রোববার ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছিলেন, ‘সরকার উৎখাত’ শব্দটি রাজনৈতিকভাবে ঠিক নয়। তবুও যদি বর্তমান ইরান সরকার ‘ইরানকে আবার মহান করে তুলতে না পারে’, তবে সরকার উৎখাত কেন নয়? সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে ‘সরকার পরিবর্তনে’র ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে তা নীতিগত কোনো ঘোষণা নয়। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট গত রাতে (রোববার) শুধু একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যদি ইরানি শাসকগোষ্ঠী কূটনৈতিক আলোচনায় অংশ না নেয়, তাহলে কেন ইরানি জনগণ এ নিষ্ঠুর শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না? তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমাদের সামরিক অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

যুদ্ধবিরতির জন্য যোগাযোগ করেছিল কারা: নাম প্রকাশ না করার শর্তে হোয়াইট হাউসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, সোমবার ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনালাপে যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গ তোলেন ডোনাল ট্রাম্প। আর তার প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে কথা বলেন বলেও ওই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ওই কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেছেন, ইসরাইল এই শর্তে যুদ্ধবিরতি মেনে চলতে রাজি হয়েছে যে ইরান নতুন আক্রমণ শুরু করবে না। তেহরান চুক্তিটি মেনে চলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে বলে ওই একই সূত্র জানিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে ইরানি পক্ষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগ হয়েছে এবং এতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের অংশগ্রহণ ছিল।

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে কে জিতল? ইরানে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ শুরু করেছিল ইসরাইল। প্রধান লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা। যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের ‘শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন’ করার দাবি তুলেছিল। কিন্তু এ দুই উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন তেহরানে অবস্থিত সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের গবেষক আব্বাস আসলানি। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে কিছুটা ক্ষতি সাধিত হলেও ইরান আগেভাগেই ইউরেনিয়াম ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান সুরক্ষিত স্থানে স্থানান্তর করেছিল। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাও ধ্বংস হয়নি, বরং সাম্প্রতিক হামলায় তারা ইসরাইলে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। আসলানি বলেন, ইরান যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে ইরান যুদ্ধবিরতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে বলে মনে হয়। ইরান এখনো যুদ্ধবিরতির চূড়ান্ত নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ইসরাইলের আগের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ইতিহাস — গাজা ও লেবাননে বারবার চুক্তি ভঙ্গ করেছে ইসরাইল।

বিজয় হিসেবে দেখছে ইরান: আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাহদি মোহাম্মাদি যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে ‘‘বিশাল, ইতিহাস গড়া বিজয়’’ বলে অভিহিত করে উদযাপন করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি লিখেছেন, এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার মুখপাত্র বেহরোজ কামালভান্দি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কেউই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ‘নির্মুল’ করতে পারবে না। এটা অন্য সবার বোঝা উচিত। তিনি বলেন, আমাদের যে সক্ষমতা ও সামর্থ্য রয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে বলতে পারি—পারমাণবিক শিল্প অব্যাহত থাকবে এবং এটিকে থামানো যাবে না।

চুক্তিতে গাজাকেও অন্তর্ভুক্ত করার দাবি: ইরান-ইসরাইল সংঘাতে যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে ফিলিস্তিনের রামাল্লাভিত্তিক কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে, গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরাইলী আগ্রাসন থামানোরও দাবি জানিয়েছে তারা। এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের দপ্তর জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এ পদক্ষেপ পূর্ণতা পাবে তখনই, যখন এর আওতায় গাজা উপত্যকাও চলে আসবে। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৯ জন ফিলিস্তিনীকে নিহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। এর ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলের হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৭৭ জনে। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৪৮ জন। গত মার্চে গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর থেকে ইসরাইল অন্তত ৫ হাজার ৭৫৯ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে। এ সময়ে আহত হয়েছে আরও ১৯ হাজার ৮০৭ জন।

ইরানে মোসাদের আরও ৬ গুপ্তচর গ্রেফতার: ইরানের হামাদানে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ৬ গুপ্তচরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা মেহের। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানে মোসাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টাকারী ছয়জন বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচরকে রাজান, নাহাভান্দ এবং হামাদান শহরে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, আটককৃতরা সাইবারস্পেসে লক্ষ্যবস্তু কার্যকলাপের মাধ্যমে এবং শাসক এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে, জনসাধারণের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করার ও ইরানের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল। তবে, সঠিক এবং সময়োপযোগী গোয়েন্দা তৎপরতা তাদের কর্মকা- ব্যর্থ করে দিয়েছে। এর আগে ২০ জুন তেহরান ও তেল আবিবের মধ্যে সংঘাত চলাকালীন সময়ে মোসাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ৫৪ জন গুপ্তচরকে গ্রেফতার করে ইরান। ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের প্রসিকিউটর অফিস জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ‘শত্রুর পক্ষ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা, মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার’ অভিযোগে অভিযুক্ত। ইসরাইলের সঙ্গে কয়েক দশক ধরে ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ইরান মোসাদের সঙ্গে যোগসূত্রের অভিযোগে অসংখ্য ব্যক্তিকে মৃত্যুদ- দিয়েছে, বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে দুর্বল করার লক্ষ্যে নাশকতা এবং হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে।