দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে চলমান শীতল সম্পর্ক অনেকটা উষ্ণতা পেয়েছে। প্রায় ডিপ ফ্রিজে থাকা এই সম্পর্ক এখন ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে। শুধু সচলই নয়-প্রকাশ পাচ্ছে সম্পর্ক জোরদারের ইঙ্গিতও। নতুন করে নয়া কূটনৈতিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরির মোক্ষম সময় এখন। দেড় দশক পর আজ বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ। ফরেন অফিস কনসাল্টেশন বা পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এই বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা হবে বলে আশাবাদী সরকার। এতে আলোচনার মূল বিষয় হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো। ধারণা করা হচ্ছেÑ আলোচনায় যৌথ কমিশন পুনরায় চালুর বিষয়টি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আকারে আসতে পারে। এদিকে ঢাকায় পৌঁছেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ। গতকাল বুধবার দুপুর ১২টায় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি।
জানা গেছে, থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে পাকিস্তান থেকে ব্যাংকক হয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন আমনা বালুচ। রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে তার উঠার কথা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছেÑ চলতি এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকা সফরে আসছেন। এর আগে জাতিসংঘ সম্মেলনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মো: ইউনূস। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তাকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান। ২০১২ সালের পর এটাই হতে যাচ্ছে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। যদিও তার সফরের নির্দিষ্ট তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। একই মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই দেশের মধ্যে ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)। সর্বশেষ এ ধরনের সংলাপ হয়েছিল ২০১০ সালে, ইসলামাবাদে। প্রায় ১৪ বছর পর এই বৈঠক হতে যাচ্ছে ঢাকায়, যা সম্পর্ক উন্নয়নে বড় পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, দীর্ঘ ১৫ বছর পর আজ বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান। পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ (এফওসি) শীর্ষক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। দুই দেশের মধ্যকার বৈঠকটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব বৃহস্পতিবার এফওসি বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
আওয়ামী লীগের পতনের পর ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে গতি আসে। আগস্টে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার। ২০১০ সালের পর এবারই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকে বসছেন দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব। ঢাকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অমীমাংসিত সব বিষয়ই আলোচনায় তোলা হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে আমরা কূটনৈতিকভাবে যা সম্ভব, সেটাই করছি।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক অগ্রগতি এই সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস দিচ্ছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে করাচি থেকে সরাসরি একটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায়। এর আগে, এমন ঘটনা ঘটেনি। পাশাপাশি, সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করেছে। এর বিপরীতে পাকিস্তানও বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা ফি বাতিল করেছে।
বিশ্লেষকদের মতেÑ এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা। ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। এরপর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে তাদের মধ্যে একটি বৈঠকও হয়। যা অনেকের কাছে একটি কূটনৈতিক বার্তা হিসেবে ধরা পড়ে।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পরপর একাধিক প্রতিনিধি দলও ঢাকা সফর করেছে। এর মধ্যে ছিল উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিক ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী, যিনি এক সময় ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সফরে তিনি পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। বৈঠকে যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের সভা পুনরায় আয়োজনের ওপর জোর দেওয়া হয়।
সবশেষ, বাংলাদেশের একজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল এসএম কামরুল হাসান সম্প্রতি ইসলামাবাদ সফর করেন এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। এটিও ছিল দুই দেশের সামরিক কূটনীতিতে এক নতুন দৃষ্টান্ত। যদিও, অতীতে বিভিন্ন সময়, বাংলাদেশ-পাকিস্তান উভয়ই দেশইÑ জাতীয় সংকটে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. এম শহীদুজ্জামান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে অতীতের দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে এপিয়ে যেতে হবে। কিভাবে দু’দেশের সম্পর্ক আরও উন্নত ও উষ্ণ করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। দুদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা, দ্বিপাক্ষিক নিরাপপত্তা, সরাসরি বিমান ফ্লাইট চালু এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করতে হবে। ভারত যদি বাংলাদেশকে হুমকি দেয় তবে পাকিস্তান থেকে সামরিক সহযোগিতা পাওয়া যায় তার জন্য কাজ করতে হবে। এখন ক্ষমা চাওয়ার বিষয় ভারত, আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকরা বলে যাতে করে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক উন্নয়ন না হয়।
বাংলাদেশ সম্প্রতি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) অংশগ্রহণে আগ্রহ দেখিয়েছে, যা পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে একটি ত্রিপাক্ষিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারে। বাণিজ্যিক দিক থেকেও বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বর্তমানে দুই দেশের বছরে মাত্র ৭০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। কিন্তু নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক বাধা কমানো গেলে এই অঙ্ক দ্রুত ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ জন্য সরাসরি বিমান চলাচল, চট্টগ্রাম-করাচি সমুদ্রপথ খুলে দেওয়া, এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়গুলো আলোচনায় আসতে পারে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতেÑ দীর্ঘদিনের জটিলতা ও ইতিহাসের ভার পেছনে রেখে, ঢাকা-ইসলামাবাদ নতুন বাস্তবতায় একে অপরের দিকে এগিয়ে আসছে। তবে এই সম্পর্ক কতদূর গড়াবে, তা নির্ভর করবে উভয় দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পারস্পরিক আস্থা এবং আন্তরিকতার ওপর।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, ১৫ বছর ধরে যেখানে কোনো আলাপই হয়নি, সেখানে একেবারে শুরুতেই এসব বিষয় তুললে আলোচনা বেশি দূর এগোবে না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে উপযুক্ত মুহূর্তের।