চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সত্য গোপন না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সঠিক রিপোর্ট করেছেন বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জানিয়েছেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সরকারের ‘ইচ্ছামতো’ দেয়ার বিনিময়ে সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ড যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় আমাকে।

গতকাল রোববার বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সরকারের ইচ্ছামতো প্রতিবেদন না দিলে মামলা ও নানা হয়রানির হুমকি দেয়া হয়েছিল। এমনকি প্রলোভন হিসেবে বিদেশ ভ্রমণ ও পরিবারের সঙ্গে কক্সবাজার ভ্রমণের অফারও পান তিনি।

ডা. রাজিবুল ইসলাম সাক্ষ্যে বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জলাই তিনি আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন। যথানিয়মে ময়নাতদন্ত শেষে তিনি প্রতিবেদনে আবু সাঈদের শরীরে ‘পিলেট’ পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। অনেকগুলো পিলেট বিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্ষক্ষরণে তার মৃত্যু হয় বলে প্রতিবেদনে লেখেন।

আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলাতে একপর্যায়ে নানা প্রলোভন দেয়া হয় উল্লেখ করে চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম জবানবন্দীতে বলেন, তারা আমাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেন। আমি বলি আমার পাসপোর্ট নেই। তখন তারা আমাকে স্ত্রী সন্তানের নিয়ে দুই সপ্তাহ কক্সবাজারে ঘুরে আসার অফার দেয়। সবকিছুর ব্যবস্থা তারা করবেন বলে জানান। তবে আমি তাদের কথায় রাজি হইনি। আমি ভাইস প্রিন্সিপাল স্যারকে বলি, স্যার আবু সাঈদকে গুলী করে হত্যার দৃশ্য টিভিতে লাইভ সম্প্রচার হয়েছে এবং তা সারা বিশ্ব দেখেছে। আমি যদি এই হত্যাকে হেড ইনজুরি বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেই তাহলে সারা বিশ্বের মানুষ ড. সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে।

ডা. রাজিবুল বলেন, ‘আমি মতামত দেই এই মৃত্যু হোমিসাইডাল ইন নেচার। এই ঘটনায় রংপুরের তাজহাট থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে এই রিপোর্ট জমা দিতে গেলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর আমার রিপোর্ট গ্রহণ না করে পুনরায় রিপোর্ট তৈরি করতে বলেন। একই রিপোর্ট সামান্য এদিক-ওদিক করে তিনি আবার জমা দেন। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তার রিপোর্ট জমা নেয়া হয়নি।

এরপর রংপুর মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষের কক্ষে ডেকে নেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে ছিলেন প্রিন্সিপাল ডা. মাহফুজুর রহমান, সিটি এসবি এসপি সিদ্দিক, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মারুফ এবং স্বাচিপের রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি ডা. চন্দন। তারা আমাকে চাপ দিচ্ছিলেন। ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা বাহিরে অবস্থান করছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, এসময় তারা তাদের কথামতো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে চাপ দিচ্ছিলেন এবং ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন।

সাক্ষ্যে ডা. রাজিবুলকে বলেন, ‘তারা বারবার বলছিলেন যেন মাথায় আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়। তখন আমি ভাইস প্রিন্সিপালকে বলি, স্যার আবু সাঈদের মৃত্যু যে গুলীতে হয়েছে তা পৃথিবীর সব মানুষ দেখেছে, মিডিয়াতে সম্প্রচারিত হয়েছে। আমি যদি এখন লিখি যে মাথায় আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে, তাহলে সারাবিশ্বের লোক ডাক্তার সমাজকে ঘৃণা করবে। তখন স্বাচিবের রংপুর মেডিকেলের সভাপতি চন্দন স্যার বলেন, আবু সাঈদের লাশ নিয়ে ব্যবসা চলছে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) এ ব্যাপারে কনসার্ন আছেন। পুলিশ যেভাবে চায়, সেভাবে রিপোর্ট দাও। তোমার বিষয়টা আমরা দেখব।’

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেন, চতুর্থবারের প্রতিবেদনে ইনজুরির কথা ঠিক রাখলেও বন্দুকের কথা উল্লেখ করেননি এবং মতামতেও মাথায় আঘাতের কথা রাখেননি।

তিনি বলেন, ‘ফাইনালি দেয়া রিপোর্টে ইনজুরির বর্ণনা ঠিক রাখলেও এগুলো যে গান বুলেট সে কথা রাখিনি। পিলেটের কথা উল্লেখ ছিল। রিপোর্টের নিচে মতামতে লিখি- Death was due to shock and haemorrhage as a result of above mentioned injuries which was antimortem and homicidal in nature, and please consider the circumstantial evidence. ’

রাজিবুল বলেন, এরপর প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়, এটি ছিল পঞ্চম প্রতিবেদন। মাঝে একটি প্রতিবেদন পুলিশ ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তিনি সরিয়ে রাখায় পুলিশ তা করতে পারেনি। এসময় আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের সেই সময়ের কথা বলতে বলতে রাজিবুল একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন।

ময়নাতদন্তকারী এ চিকিৎসক কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্লিপের পেনড্রাইভ জমা দেন, যা ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়।

এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম। অন্যদিকে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে কাঠগড়ায় হাজির করা হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এখন পর্যন্ত ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।

এ মামলার বাইরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে। একটি গুম-খুনের ঘটনায়, আরেকটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হত্যাকা-ের অভিযোগে।

আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামী পুলিশ কর্মকর্তা ভারতে গ্রেপ্তার : অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে আটক হয়েছেন বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামান। তিনি রংপুরের আবু সাঈদ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামী। আরিফুজ্জামান ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলায় অবস্থিত এপিবিএন-২-এর সহকারী পুলিশ সুপার পদে কর্মরত ছিলেন। গত ১৪ অক্টোবর থেকে তিনি বিনা অনুমতিতে তার কর্মস্থলে হাজির হননি। এ কারণে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল এবং সেই থেকে তিনি পলাতক ছিলেন।

রংপুর মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (হেডকোয়ার্টার্স) হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, আরিফুজ্জামান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী। ওই মামলায় ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এর মধ্যে ৬ জন গ্রেফতার আছেন। আরিফুজ্জামান রংপুর মহানগর তাজহাট থানায় শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার (নং-০৩, তারিখ-১৯-০৮-২৪) ৪ নম্বর আসামী; কোতোয়ালি থানায় কলা ব্যবসায়ী শহীদ মেরাজুল ইসলাম হত্যা মামলার (নং-১২, তারিখ-১৯-০৮-২৪) ২১ নম্বর আসামী; একই থানায় সবজি ব্যবসায়ী শহীদ সাজ্জাদ হোসেন হত্যা মামলার (নং-১৪, তারিখ-২১-০৮-২৪) ১৬ নম্বর আসামী। এছাড়াও কোতোয়ালি থানায় কলেজ শিক্ষার্থী জিম হত্যা চেষ্টা মামলার (নং-২৯, তারিখ-৩১-০৮-২৪) ৫ নম্বর ও পল্লী চিকিৎসক জাহাঙ্গীর আলম সিদ্দিকী হত্যা চেষ্টা মামলার (নং-২৪, তারিখ-২০-১১-২৪) ২ নম্বর আসামী তিনি। হাবিবুর রহমান আরও বলেন, গত বছর ৫ আগস্টের পর তাকে (আরিফুজ্জামান) রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এপিবিএনে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয়। এরপর থেকে তিনি পলাতক হন।

রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। গত বছর ১৬ জুলাই জিলা স্কুল মোড় থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন ব্যাকোলজি মোড়ে শিক্ষার্থীদের মিছিল আটকে দিয়ে বেধড়ক লাঠিচার্জে নেতৃত্ব দেন তখনকার এসি আরিফুজ্জামান। এ ছাড়াও শহীদ আবু সাঈদকে গুলী করার আগে এবং পরে খুব কাছে থেকে নির্দেশ দেন আরিফ এবং নিজেও গুলী করেন।

এদিকে সাতক্ষীরার কাকডাঙ্গা বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার কামরুজ্জামান জানান, শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাকডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার হাকিমপুর চেকপোস্ট পার হচ্ছিলেন তিনি। সেখান থেকে তাকে আটক করে বিএসএফ। তার পরিচয়পত্র দেখে সনাক্ত করা হয় যে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান। বিএসএফ-এর হাতে আটকের পর তাকে এখন ভারতের স্বরূপনগর থানায় রাখা হয়েছে।