# সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে মামলার ঘোষণা জামায়াতে ইসলামীর
# প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের মূল মঞ্চ হবে জাতীয় সংসদ -- বিএনপি
জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসন বিশিষ্ট। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এই সদস্যরা মনোনীত হবেন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর), অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে দলগুলো যে ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে দলগুলোর মধ্যে এসব আসন বণ্টন করা হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর কমিশন এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। তবে এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি ও তাদের সমমনা দল ও জোটগুলো। তারা বলেছে, উচ্চকক্ষে সদস্য মনোনীত হতে হবে জাতীয় নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। গতকালই আলোচনার সমাপ্তি টানতে চান বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন। আলোচনার শুরুতে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করব দ্রুত চূড়ান্ত সনদ প্রস্তুত করে আপনাদের হাতে তুলে দিতে। এর ভিত্তিতে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও করা হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে আজকের (বৃহস্পতিবার) মধ্যেই আলোচনা পর্বের সমাপ্তি টানা সম্ভব হবে। আলোচনা শেষে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা দ্রুত দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
আগের ধারাবাহিকতায় গতকালও সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য কীভাবে মনোনীত হবেন, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব করে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো এ প্রস্তাব সমর্থন করে। অপর দিকে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো বিরোধিতা করে। সে সময়ও তারা সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বরাদ্দের দাবি জানায়। আলোচনায় দলগুলোর ভিন্নমত থাকায় এক পর্যায়ে বিষয়টি কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এরপর ঐকমত্য কমিশন ভোটের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের সদস্য মনোনীত করার সিদ্ধান্ত জানায়।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উচ্চকক্ষের নিজস্ব কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। তবে অর্থবিল ব্যতীত অন্য সব বিল নি¤œকক্ষ ও উচ্চকক্ষ উভয় কক্ষে উপস্থাপন করতে হবে। উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারবে না। এক মাসের বেশি বিল আটকে রাখলে সেটিকে উচ্চকক্ষের অনুমোদিত বলে গণ্য করা হবে। নি¤œকক্ষের প্রস্তাবিত বিলগুলো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করবে উচ্চকক্ষ এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তা অনুমোদন অথবা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল অনুমোদন করে, তবে উভয় কক্ষে পাস হওয়া বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে। আর যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তা সংশোধনের সুপারিশসহ নি¤œকক্ষে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে। নি¤œকক্ষ সেই সব সংশোধন আংশিক বা পূর্ণভাবে গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।
কমিশনের এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি এবং তাদের মিত্র জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম ও এলডিপি। তারা সংসদের নি¤œকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিতা করেছে। যুক্তি হিসেবে এই সব দল বলছে, দেশের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উচ্চকক্ষের কোনো প্রয়োজন নেই।
গতকালের আলোচনায় বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, আইয়ুব মিয়া।
আলোচনার শুরুতে সংসদের উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সদস্য মনোনয়নের প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ আলোচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিনের উদ্দেশে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা কটাক্ষ করে বলেন, ২৩ সালে কোথায় ছিলেন?’ তার এ মন্তব্যে সংলাপে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে ক্ষমা চান এহসানুল হুদা। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের সংলাপের একপর্যায়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বেলা ১টা ৫০ মিনিটের পরে পিআর নিয়ে বিএনপির অবস্থান ব্যাখ্যা করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তারা সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা উচ্চকক্ষের হাতে দিতে চান না। উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা অনির্বাচিত হবেন উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা থাকে না। তিনি বক্তব্য শেষ করার পর এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ভোটের সংখ্যানুপাতিকের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সেটি তো জনগণের প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন হয়। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাসিন। তখন সালাহউদ্দিন আহমদ একটি ব্যাখ্যা দেন। তখনই জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা মাইক ছাড়াই জাবেদ রাসিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ২০২৩ সালে যখন আন্দোলন হচ্ছিল, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? তখনই জাবেদ রাসিন তার প্রতিবাদ করেন (মাইক ছাড়াই) এবং এ নিয়ে সংলাপে উত্তেজনা তৈরি হয়। তাদের দুজনই মাইক ছাড়া পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন।
তখন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, হুদা ভাই, এর আগেও আপনারা একজনের বক্তব্য নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। তখন আমরা থামিয়েছিলাম। এখানে আমরা কে কেন এসেছি, সে প্রশ্ন তুললে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ, আজকে যদি সে প্রশ্ন করেন, তাহলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আমাকেও সে প্রশ্ন করতে পারেন। আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছি না। তারপর এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, তিনি (এহসানুল হুদা) এই কথা বলতেই পারেন না। এ সময় সালাহউদ্দিন আহমদ তার পিঠ চাপড়ে থামতে অনুরোধ করেন। আখতার তখন বলতে থাকেন, আমরা বাচ্চাকাল থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি।
এ পর্যায়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কারও লোকাস স্ট্যান্ডি (অধিকার/ সামর্থ্য) নিয়ে প্রশ্ন করার দরকার নেই। প্রত্যেকের লোকাস স্ট্যান্ডি আছে বলেই আমরা এই জায়গায় আসতে পেরেছি। তখন আখতার বলেন, গায়ের জোরে এসব প্রশ্ন করলে তো আমরা মানব না। আলী রীয়াজ তখন বলেন, আমি তো হস্তক্ষেপ করলাম। আখতার তখনো বলতে থাকেন, সবাইক নিয়ে আমরা গণঅভ্যুত্থান করেছি। গোটা অভ্যুত্থানে ছাত্রজনতা মাঠে নেমে এল, সেটার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। এটার জন্য ওনার ক্ষমা চাওয়া উচিত।
এ সময় সালাহউদ্দিন আহমদকে বলতে শোনা যায়, আচ্ছা হুদা ভাই, আপনি সরি বলেন। এ সময় গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জেনায়েদ সাকি এ বিষয়ে কথা বলতে উঠে দাঁড়ালে আলী রীয়াজ তাকে অনুরোধ করে বসিয়ে দেন। তখন জোনায়েদ সাকি কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু মাইক না থাকায় তা শোনা যায়নি। এ সময় সালাহউদ্দিন আহমদ তখন এহসানুল হুদাকে উদ্দেশ করে বলেন, কেউ যদি মনে কষ্ট পেয়ে থাকে তার জন্য সরি বলেন। তখন এহসানুল হুদা মাইক নিয়ে বলেন, আমি বলতে চেয়েছিলাম, ২০২৩ সালে আমরা উচ্চকক্ষের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তখন সে প্রস্তাবটি (পিআর) কোথায় ছিল? তারপরও কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকে, আমি দুঃখিত।
এরপরই আলী রীয়াজ মধ্যাহ্নভোজের বিরতি ঘোষণা করেন। বিরতির সময়ে সম্মেলনকক্ষে এহসানুল হুদাকে আবার আখতারের কাছে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে তার সঙ্গে কোলাকুলি করতে দেখা যায়। তখন হুদাকে বলতে শোনা যায়, আমার অনুরোধ, আমরা এটা নিয়ে আর সিনক্রিয়েট না করি। আমার আপনাদেরকে নিয়ে প্রশ্ন করার ইনটেনশন (উদ্দেশ্য) ছিল না। তখন পাশ থেকে একজনকে বলতে শোনা যায়, আপনার এটা নিয়ে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। পরে আখতার এহসানুল হুদাকে জাবেদ রাসিনের সঙ্গে কোলাকুলি করিয়ে দেন।
গতকালকে সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগ বিধানসম্পর্কিত বিধান, উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণসম্পর্কিত প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রের মূলনীতির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আলোচনা শুরুর সময় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, আমরা চেষ্টা করব, দ্রুত চূড়ান্ত সনদ প্রস্তুত করে আপনাদের হাতে তুলে দিতে। এর ভিত্তিতে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও করা হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই আলোচনা পর্বের সমাপ্তি টানা সম্ভব হবে। আলোচনা শেষে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা দ্রুত দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
এদিকে তিন সশস্ত্র বাহিনীর (সেনা, নৌ ও বিমান) প্রধান এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) মহাপরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ প্রস্তাবের ওপর বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা হয়।
এর আগে গত বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে একটি ধারণাপত্র তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়েছেন। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে ঐকমত্য কমিশন আরও কিছু নিয়োগে রাষ্ট্রপতির স্বাধীন ক্ষমতার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে।
তিন বাহিনীর প্রধান ও দুই গোয়েন্দাপ্রধান নিয়োগের ক্ষমতার বিষয়টির পাশাপাশি আরও ৯টি নিয়োগের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। অ্যাটর্নি জেনারেল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও সদস্য, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস্ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ও সদস্য।
বুধবারের বৈঠক শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, এসব প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনার জন্য দেওয়া হয়েছে। যদি এসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়, তাহলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তা কার্যকর করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামী : আইনি ভিত্তি না দিলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমীর ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। তিনি আরও বলেন, সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে সময় অপচয় করায় সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করবেন। বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ২৩তম দিনের বিরতিতে সাংবাদিকদের এ কথাগুলো বলেন জামায়াতের এই নায়েবে আমীর।
গত ৫৪ বছরের নির্বাচনী পদ্ধতিতে বাংলাদেশে দলীয়করণ, দখল, ভুয়া নির্বাচন, রাতের নির্বাচনসহ নানা অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, এখন সারা বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে যেভাবে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি আছে, বাংলাদেশেও তা প্রয়োজন।
জামায়াতের এই নায়েবে আমীর বলেন, পিআর পদ্ধতি এখন আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া— প্রতিটি মহাদেশেই আছে। গরিব-ধনী বা কালো-সাদার ভেদে নয়, এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। এমনকি অনেক দেশ প্রতিবছর নতুনভাবে এই পদ্ধতি গ্রহণ করছে। আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের আরও বলেন, আমরা পরিষ্কার বলেছি, আমরা পিআর চাই এবং অধিকাংশ দলও পিআরের পক্ষে। কমিশন বিরতির পর সিদ্ধান্ত দেবে বলেছে। আমরা আশা করি, সেটি ইতিবাচক হবে।
সংলাপে সময় ব্যয় ও কঠোর পরিশ্রমের কথা উল্লেখ করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, আমরা এত কষ্ট করলাম, আপনারা (সাংবাদিকেরা) কাভার (খবর সংগ্রহ) করলেন, কিন্তু (সনদের) বাস্তবায়ন না হলে এসবের কোনো মূল্য থাকবে না। বাস্তবায়ন না হলে শপথ করারও কোনো মূল্য থাকে না। তাই বাস্তবায়নটাই মুখ্য। জামায়াতের এই নায়েবে আমীর বলেন, বিএনপি বলছে, এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কিন্তু আমরা মনে করি, কেবল প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করলে হবে না। আইনি ভিত্তি না থাকলে এই চার্টার (সনদ) মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সে জন্য আমরা কমিশন এবং সরকারের বিরুদ্ধে কমপেনসেইট (ক্ষতিপূরণ) মামলা করব।
ডা. আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, আইনি ভিত্তি ছাড়া এই চার্টার জিরো (অর্থহীন) হবে। আমরা পরিষ্কার বলেছি, আইনগত ভিত্তি ছাড়া সই করব না। এই সরকারের মেয়াদেই এটি কার্যকর করতে হবে। কাল থেকেই এটা সম্ভব। আইনি ভিত্তি না থাকলে এই চার্টারে স্বাক্ষর করার অর্থ নেই। এমন সনদে সই করার আর না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। জামায়াতের এই নায়েবে আমীর বলেন, গত ২৩ দিনে আমরা যে সংখ্যক “নোট অব ডিসেন্ট (দ্বিমত)” দেখেছি, তা আগের ২২ দিনে দেখিনি। তবু এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। একজন “না” বলতেই পারেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষে থাকলে সেটা গ্রহণযোগ্যতা পায়। তিনি বলেন, আইনি ভিত্তি দেওয়া এখনই সম্ভব। অলটারনেটিভ (বিকল্প) আছে, উদাহরণ আছে। যারা বলছেন এটা এখন দেওয়া যাবে না, তারা জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন।
সংসদের উচ্চকক্ষের বিষয়ে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বলেন, এটা শুধু আমাদের মত নয়, উচ্চকক্ষ হলো একটা “ব্যালান্স অব অথরিটি (ক্ষমতার ভারসাম্য)”। মূল আইন প্রণয়ন হবে নি¤œকক্ষে আর উচ্চকক্ষ হবে “গাইডিং ও কন্ট্রোলিং বডি”।
বিএনপি : রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বেশ কয়েকটি বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ছিল সরকার গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তা মেনে নিয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, এই সনদ আসলে একটি ঐতিহাসিক অঙ্গীকারনামা, যা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে জাতিকে একটি নতুন দিশা দেখাবে। এ সনদের মূল শক্তি হলো- এতে থাকা অঙ্গীকারনামা, যেখানে ঐকমত্যে পৌঁছানো বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে আইন, সংবিধান ও বিধির পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সংসদই হবে মূল মঞ্চ।
তিনি আরও বলেন, আমরা একমত হয়েছি যে, সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে সব অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হবে। আর এর আগেই অনেক সংস্কার প্রস্তাব ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকর হয়ে যাচ্ছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, এই সনদের চূড়ান্ত কপি প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরসহ কমিশনের সব সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতাদের স্বাক্ষরে প্রকাশিত হবে। এটি জাতির সামনে ওয়েবসাইট ও গণমাধ্যমে উন্মুক্ত থাকবে। এরপর কোনো রাজনৈতিক দল কি সাহস করবে একে ভাঙার? তাহলে কী বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে, সেই ঝুঁকি কি কোন দল নেবে?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, আমার তো মনে হয় না, এর চেয়ে বড় বেশি কোনো কনসেনসাস (ঐকমত্য) হতে পারে? এর চেয়ে বড় বেশি কোনো মেমো অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (সমঝোতা স্মারক) হতে পারে। এর চেয়ে বড় কোনো সোশ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট (সামাজিক চুক্তি) হতে পারে না। অর্থাৎ জাতীয় ঐকমত্যকে তিনি একটি ‘সামাজিক চুক্তি’ হিসাবে উল্লেখ করেন।
বিএনপি নেতা আরও বলেন, এই চুক্তি শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নয়। এটি পুরো জাতির সঙ্গে, জনগণের সঙ্গে, একটি ঐক্যমূলক প্রতিশ্রুতি। তার মতে, ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮২৬টি সংস্কারের সুপারিশের মধ্যে ৬৫৯টিতে একমত পোষণ করেছি। মাত্র ৫১টিতে বিএনপি একমত হয়নি। আর বাকি ১১৬টিতে দ্বিমত পোষণ করেছি। তারপরও বলবে, বিএনপি সংস্কার চায় না। সেটা জাতি দেখেছে।