*ধোঁয়ায় ঢাকা তেল আবিবে আতঙ্ক উদ্বেগ । বাড়ছে লাশের সারি
*ইরানি হামলা ঠেকাতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সহায়তা চেয়েছে ইসরাইল
* ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত তেল আবিবে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ
মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান ও ইসরাইলের মাঝে টানা চতুর্থ দিনের মতো হামলা-পাল্টা হামলা চলছে। এ পর্যন্ত যত হামলা চালিয়েছে তেহরান তারমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও ব্যাপক ছিল গতকাল সোমবার ভোরের হামলা। ইরান গত চার দিনে ইসরাইলে ৩৭০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে এবং শত শত বিস্ফোরকবাহী ড্রোন নিক্ষেপ করেছে ইরান। ইসরাইলের অন্তত বড় বড় ৩০টি সামরিক ও বেসামসরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতেই জ¦লছে ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিব। ইরানের ক্রমাগত হামলায় বিধ্বস্ত ইসরাইল সরকার ও জনগণ এখন দিশেহারা। এক মুহূর্তও থেমে নেই ইরানের হামলা। চলমান পরিস্থিতি ‘নিরাপদে’ থাকতে অভ্যস্ত তেল আবিবের বাসিন্দাদের এক নজিরবিহীন আতঙ্ক ও উদ্বেগে দিন কাটাতে বাধ্য করেছে। এতে করে গতকাল সোমবার ইরানের হামলায় ২৪ জন ইসরাইলের নাগরিক নিহত, ৩০০ জন আহত এবং কয়েক’শ নিখোঁজ রয়েছে। ধোঁয়ায় ঢাকা তেল আবিবের নাগরিকদের মধ্যে নজিরবিহীন আতঙ্ক, উদ্বেগ ও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ইসরাইলে বাড়ছে লাশের সারি, ইরানের হামলায় সোমবার সকালেও উদ্ধারকারী দলকে দেখা গেছে ইসরাইলের প্রাণকেন্দ্রে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়াদের খুঁজছেন। এ অবস্থায় ইরানি হামলা ঠেকাতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সহায়তা চেয়েছে ইসরাইল। অপরদিকে, ইরানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও এক হাজার ২০০ জন। এই অব্যাহত সহিংসতা আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ইরানে অব্যাহত হামলার মধ্যেই ইসরাইলকে ‘নরক দেখানোর’ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মাদ বাকের গালিবাফ। এছাড়াও ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর তেল আবিবে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ। খবর টাইমস অফ ইসরাইল, হিব্রু নিউজ, আল জাজিরা, সিএনএন, বিবিসি, ফক্সনিউজ, টিআরটি ওয়ার্ল্ড।
ইরানের হামলার তীব্রতার কারণে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ বলেছেন, তেহরানের বাসিন্দাদের ক্ষতি করার কোনও ইচ্ছা নেই ইসরাইলের। এছাড়াও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। এ পরিস্থিতিতে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। রাজধানী তেহরানসহ বড় শহরগুলো থেকে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এদিকে ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো ইরানের সঙ্গে থাকা সব সীমান্ত ক্রসিং অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান। বেলুচিস্তান প্রদেশের কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় শুক্রবার ইসরাইলের হামলার মাধ্যমে শুরু হওয়া এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে চরম উত্তেজনা তৈরি করেছে। আঞ্চলিক এই সংঘাতে বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোও জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। খবর আল জাজিরার।
ইরানি হামলা ঠেকাতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সহায়তা চেয়েছে ইসরাইল: ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা ঠেকাতে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের কাছে সাহায্য চেয়েছে ইসরাইল। রোববার (১৫ জুন) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ইসরাইলী রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম কান। ইসরাইলী সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলী অভিমুখে ছোড়া ইরানি ড্রোন এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার অনুরোধ করেছে। ইতোমধ্যেই ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের কাছে আনুষ্ঠানিক বার্তা পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য অনুরোধে সাড়া দিয়েছে এবং সহায়তা প্রদান করছে।
তেল আবিবে নজিরবিহীন আতঙ্ক, উদ্বেগ ও আশঙ্কা: টানা চার দিন ধরে চলছে ইসরাইল-ইরানের সংঘাত। হামলা ও পাল্টা হামলা যেন এক মুহূর্তও থেমে নেই। চলমান পরিস্থিতি ‘নিরাপদে’ থাকতে অভ্যস্ত তেল আবিবের বাসিন্দাদের এক নজিরবিহীন আতঙ্ক ও উদ্বেগে দিন কাটাতে বাধ্য করেছে। গতকাল সোমবার সিএনএনের প্রতিবেদনে ইসরাইলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর তেল আবিবের এই চিত্র ফুটে উঠেছে।
ইরানের সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর গতকাল সোমবার সকালে তেল আবিবের বাসিন্দারা ছিলেন উদ্বেগ-আতঙ্কে। সর্বত্র বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি লক্ষ্য করেন সিএনএনের জেরুজালেম সংবাদদাতা জেরেমি ডায়মন্ড। জেরেমি জানান, তিনি তেল আবিবের রাস্তাগুলোতে ভেঙে পড়া স্থাপনা ও অন্যান্য আবর্জনা দেখতে পেয়েছেন। একটি অবস্থানে চারটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার পর সেখানে উদ্ধারকারী দল ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ধ্বংসস্তূপের ভেতর আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় এক নারী জানান, ঘরের বেসমেন্টে লুকিয়ে থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি ও তার পরিবার। তবে মাটির নিচের বেসমেন্টে থেকেও ‘ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রভাব’ টের পাওয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন ওই নারী। ‘আমরা অনেক ভীত ছিলাম। এ কারণে খুব ধীরে ধীরে বের হয়ে আসি। আমরা হেঁটে হেঁটে আগানোর সময় টের পাই, আশেপাশে একের পর এক ভবন ভেঙে পড়ছে’, যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘পোড়া ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছিলা, আমি টি-শার্ট দিয়ে নিজের নাক ঢেকে রাখতে বাধ্য হই। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল রাখছিলাম যাতে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওই ধোঁয়া ফুসফুসে ঢুকে না যায়।’ ঘটনাস্থলের কাছে একটি আবাসিক ভবন আংশিকভাবে ধসে পড়ে। বেশ খানিকটা দূর থেকেও ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপ দেখা যাচ্ছিল বলে জানান সিএনএনের সংবাদদাতা। নজিরবিহীন হামলার মুখে তেল আবিবের বাসিন্দারা হতভম্ব।
ইসরাইলে বাড়ছে লাশের সারি: ইসরাইলের জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা মাগেন ডেভিড অ্যাডম (এমডিএ) জানিয়েছে, তেল আবিবের পূর্বাঞ্চল পেতাহ টিকভা শহরে চারজন এবং বনে ব্রাক শহরে একজন নিহত হন। হামলার পর ইসরাইলের বিভিন্ন উপকূলবর্তী ও কেন্দ্রীয় শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে আবাসিক ভবন ও যানবাহন। হামলার পরপরই এমডিএ চারটি স্থানে তাৎক্ষণিক উদ্ধার অভিযান শুরু করে এবং আহতদের স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করা হয়। এ নিয়ে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ইরান-ইসরাইল পাল্টাপাল্টি হামলায় ইসরাইলে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৮ জনে। তেল আবিবের রাস্তাগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভোররাতে ইরানের সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর শহরের বিভিন্ন সড়কে ছড়িয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্ক। উদ্ধারকারী দল ও সেনাবাহিনী এখনো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তল্লাশি চালাচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আশপাশের বেশ কয়েকটি ভবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনাস্থলে সেনা ও উদ্ধারকারী দল কাজ করছে। আতঙ্কিত বাসিন্দারা স্বজনদের খুঁজছেন ও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। সূত্র: সিএনএন
ইসরাইলী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করেছে ইরানি কৌশল: ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) জানিয়েছে, তারা ইসরাইলের বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করতে নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যার ফলে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো একে অপরকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। গতকাল সোমবার আইআরজিসি জানায়, “পূর্বের তুলনায় আরও শক্তিশালী ও বিধ্বংসী” হামলার সময় উন্নত গোয়েন্দা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করা হয়েছে।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, শত্রুর বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে ব্যাহত হয়েছিল যে, তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েই একে অপরকে আক্রমণ করে বসে। আইআরজিসি দাবি করে, তাদের উদ্ভাবনী কৌশলের কারণে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে মার্কিন ও পশ্চিমা সহায়তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। তারা এই হামলাকে শহীদ কমান্ডারদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং বলেছে, জায়োনিস্ট শত্রু এবং আমেরিকার ইসলামি ইরান সম্পর্কে যে সব হিসাব-নিকাশ ও মূল্যায়ন ছিল তা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আইআরজিসি হুঁশিয়ারি দিয়েছে বলেছে ইসরাইলের “সম্পূর্ণ ধ্বংস” না হওয়া পর্যন্ত “নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে, কার্যকর এবং আরও বিধ্বংসী” হামলা চলতে থাকবে।
ইসরাইলকে ‘নরক দেখানোর’ হুঁশিয়ারি: ইরানে অব্যাহত হামলার মধ্যেই ইসরাইলকে ‘নরক দেখানোর’ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মাদ বাকের গালিবাফ। বলেছেন, ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ‘বর্বর’ শত্রু ইসরাইলকে অসহায় করে ছাড়বে। কারণ এই শত্রু কোনো ‘রেড লাইনের প্রতি’ শ্রদ্ধাশীল নয়। গতকাল সোমবার পার্লামেন্টের এক উন্মুক্ত অধিবেশনে গালিবাফ এসব কথা বলেন। ইরানের পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফ ইসরাইলকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমরা তোমাদের নরক দেখাব’। ইরানের আইআরজিসি ইসরাইলে হামলার পরিসর আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
তেল-আবিবে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন দূতাবাস বন্ধ ঘোষণা: ইসরাইলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি জানিয়েছেন, ইরানের রাতভর হামলায় তেল-আবিবের মার্কিন দূতাবাস ‘সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে। মাইক হাকাবি এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে বলেছেন যে, তেল-আবিবে দূতাবাস ভবনটির আশেপাশে ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানায়’ ভীষণ কম্পনে কনস্যুলেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কোনো মার্কিন কর্মী হতাহত হননি। এ কারণে জেরুজালেমে অবস্থিত প্রধান মার্কিন দূতাবাসও বন্ধ থাকবে এবং এখনও সেখানে নিরাপদে অবস্থান করার নির্দেশনা বহাল আছে বলে জানান তিনি। গত রোববার রাতভর ইসরাইলে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইরান। এতে বহু ভবন ধ্বসে পড়ার পাশাপাশি অন্তত ৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক।