ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নববর্ষের শোভাযাত্রার জন্য এগুলো প্রস্তুত করা হয়েছিল। গতকাল শনিবার ভোরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনা তদন্তে একটি কমিট গঠন করা হয়েছে। সাধারণ ডায়েররি (জিডি) করা হয়েছে রাজধানীর শাহবাগ থানায়। এছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত সিসি ক্যামেরর ফুটেজ যাচাই বাছাই করে দেখছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে তারা এ বিষয়ে কিছু তথ্য পেয়েছে পুলিশ। মুখোসধারী একজন ব্যক্তি আগুন লাগিয়েছে বলে পুলিশ ফুটেজে দেখতে পেয়েছে। তাদের ধরতে এরই মধ্যে অভিযান শুরু করেছে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই মোটিফটি পুড়ে যায়, যদিও দ্রুতই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ঘটনার খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্ষবরণের মতো সাংস্কৃতিক আয়োজনে এমন ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আশ্বস্ত করেছে, তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং উৎসব যেন সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হয় তা নিশ্চিত করা হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, যারা ফ্যাসিবাদের সমর্থক তাদের দ্বরাই এসব কাজ সম্ভব। দ্রুত এদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যা আছে ফুটেজে: চারুকলার সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানিয়েছে, দুটি মোটিফে একজন ব্যক্তিকে আগুন দিতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ জানান, ওই ব্যক্তি কালো টি-শার্ট, বাদামি প্যান্ট ও কালো স্যান্ডেল পরেছিলেন। তার চুল পেছনে ঝুঁটি বাঁধা ছিল। চারুকলার মাঝখানের গেট টপকে ওই ব্যক্তি ভোর ৪টা ৪৪ মিনিটের ভেতরে ঢোকেন। একই পথে তিনি ৪টা ৪৬ মিনিটে পালিয়ে যান। তার নাম-পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে তিনি পুলিশকে জানান। প্রক্টর আরও বলেন, ওই ব্যক্তি প্রথমে তরল দাহ্য পদার্থ দিয়েছেন। তারপর পর্দার আড়ালে চলে গেছেন। তারপর ফুটেজে সেখানে অগ্নিশিখা দেখা গেছে। ওই ব্যক্তি যে গেট দিয়ে ঢুকেছে, সেই গেট দিয়েই বেরিয়ে ছবির হাটের দিকে গেছেন বলে জানান প্রক্টর। পুলিশ তখন কী করছিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ওই ব্যক্তি পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশকে পানি দিয়ে আগুন নেভাতে দেখা গেছে। তবে তদন্ত কমিটি সব সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে পরে জানাবে।
জানা গেছে, গতকাল ভোরে আগুনে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি মোটিফটি পুরোপুরি পুড়ে যায়। আর শান্তির পায়রা মোটিফটি আংশিক পুড়ে যায়। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর বলেন, ফুটেজে দেখা ব্যক্তি কে, তার পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। এ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলেন তিনি। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে নির্দেশনা প্রদান করেন ডিএমপি কমিশনার।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ বলছে, তারা ভোর ৫টা বেজে ৪ মিনিটে আগুন লাগার খবর পান। পুরান ঢাকার সদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ৫টা ২২ মিনিটে আগুন নিভিয়ে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এ সময় সেখানে পুলিশও ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষ উপলক্ষে তৈরি করা দুটি মোটিফে আগুন লাগার ঘটনাকে ‘রহস্যজনক’ বলে উল্লেখ করেছে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি: অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনুসন্ধানে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান। সদস্য হিসেবে রয়েছেন আইন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক মোসাদ্দেক হোসেন কামাল তুষার, চারুকলা অনুষদের সহকারী প্রক্টর মো. ইসরাফিল প্রাং ও বিজ্ঞান অনুষদের সহকারী প্রক্টর এ কে এম নূর আলম সিদ্দিকী।
হাসিনার দোসররা ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে, ফারুকী: সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুক পোস্টে বলেন, হাসিনার দোসররা গতকাল ভোর রাতে চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে- সফট আওয়ামী লীগ হোক বা আওয়ামী বি টিম হোক- তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে, দ্রুত। আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এই শোভাযাত্রা থামানোর চেষ্টায় আওয়ামী লীগের হয়ে যারা কাজ করছে, আমরা শুধু তাদেরকে আইনের আওতায় আনবো তা না, আমরা নিশ্চিত করতে চাই এবারের শোভাযাত্রা যেন আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়। কালকে রাতের ঘটনার পর হাসিনার দোসররা জানিয়ে দিয়ে গেলো বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে উৎসব করুক তারা এটা চায় না। আমরা এখন আরও বেশি ডিটারমাইনড, এবং আরো বেশি সংখ্যায় অংশ নিবো। জুলাই আন্দোলনের বিষয়ে ফারুকী আরও বলেন, গত কিছুদিন জুলাই আন্দোলনের পক্ষের অনেকেই বলেছিলেন, এবারের শোভাযাত্রা সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভিন্ন রকমের হচ্ছে। এখানে ফ্যাসিবাদের ঐ বিকট মুখ না রাখাই ভালো। আমরাও সব রকম মত নিয়েই ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মত জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কালকের ঘটনার পর এই দানবের উপস্থিতি আরো অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। জুলাই চলমান।
ফ্যাসিবাদের মুখোশে আগুন পরিকল্পিত, ঢাবি সাদা দল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ -এর জন্য তৈরি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি ও শান্তির পায়রা মোটিফে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা পরিকল্পিত বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি পন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে অগ্নিকান্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদেরকে আইনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায় সংগঠনটি। গতকাল শনিবার ঢাবি সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. মোর্শেদ হাসান খান, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম ও অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়। বিবৃতিতে শিক্ষকনেতৃবৃন্দ বলেন, বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের স্মারক পয়লা বৈশাখ। এ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা উদযাপনের আর মাত্র দুইদিন বাকি। আনন্দ শোভাযাত্রা উদযাপনের জন্য ফ্যাসিস্টদের প্রতিকৃতি তৈরিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি যখন প্রায় শেষ দিকে তখন শনিবার ভোররাতে চারুকলা অনুষদের চার দেওয়ালের ভেতরে তৈরি করা এসব প্রতিকৃতিতে আগুন দেওয়া নিছক কোনো রহস্যজনক ঘটনা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত অগ্নিকান্ড। এ ঘটনায় ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার সরকারের দোসর কিংবা ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের হাত থাকার সম্ভাবনা বেশি। নেতৃবৃন্দ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ঢাবি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করে বলেন, পয়লা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রা পালনের লক্ষ্যে তৈরিকৃত প্রতিকৃতিসহ অন্যান্য জিনিসের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর চারুকলার শোভাযাত্রা নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক থাকা অত্যাবশ্যক ছিল।