*দেশে থাকা অর্থ-সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ৩১০ কোটি এবং বিদেশে থাকা অর্থ-সম্পদের পরিমাণ ১৬৫ কোটি।
২০২৪ সালের আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে জড়িত দুই শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি, উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি বিরোধী রাষ্ট্রীয় একমাত্র সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। এ সময়কালে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব প্রভাবশালীর দেশে-বিদেশে থাকা অবৈধ অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আইনী প্রক্রিয়ার পথে হাটে সংস্থাটি। তদন্তসহ অনুসন্ধানের স্বার্থেই দুদক আদালতের দ্বারস্থ হয়। আবেদনের ভিত্তিতে বিগত সরকারের আমলের প্রভাবশালীদের দেশে-বিদেশে থাকা অবৈধ অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ দেন বিচারিক আদালত। গত সাত মাসে এ ধরনের অন্তত ৮৫টি আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে প্রকাশ। সুত্র মতে, গত সাত মাসে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী গত ৭ মাসে দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেশে-বিদেশে থাকা মোট ১২ হাজার ১৯ কোটি ৪৮ লাখ ৬২ হাজার ৮২৯ টাকার অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ হয়েছে। এর মধ্যে গত এক মাসেই (মার্চ) ১ হাজার ৫৪৪ কোটি ৬০ লাখ ৭৯ হাজার ৫৬১ টাকার অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। বাকি ১০ হাজার ৪৭৫ কোটি ৮৭ লাখ ৮৩ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে গত বছর আগস্ট থেকে চলতি বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬ মাসে। এর মধ্যে দেশে থাকা অর্থ-সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ৩১০ কোটি ২৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৭১ টাকা এবং বিদেশে থাকা অর্থ-সম্পদের পরিমাণ ১৬৫ কোটি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯৭ টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে অবরুদ্ধ ও জব্দ হওয়া ১ হাজার ৫৪৪ কোটি ৬০ লাখ ৭৯ হাজার ৫৬১ টাকার অর্থ-সম্পদের মধ্যে নাসা গ্রুপের ৭৮১ কোটি ৩১ লাখ ২২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা এবং সাবেক মন্ত্রী সাদেক খান ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী খানের রয়েছে ৫৫২ কোটি ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮১ টাকা। এ ছাড়া নাবিল গ্রুপের ৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ১৭ হাজার ২৮০ টাকা, জেমকন গ্রুপের ৬০ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, সামিট গ্রুপের ৪১ কোটি ৭৪ লাখ ৭৬০ টাকা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৮ টাকা এবং সিআইডির সাবেক ডিআইজি মোস্তফা নজরুল ইসলামের ২ কোটি ১৯ লাখ ৭৭ হাজার ৮৪৬ টাকার অর্থ-সম্পদ।
এদিকে গত বছরের ১৭ অক্টোবর ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত আদেশে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে দেশ-বিদেশে থাকা ৫৮০টি বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, কয়েক শ একর জমিসহ বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ দেন। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ৯টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। গত ৩ ডিসেম্বর একই আদালত দেশের একটি শিল্প গ্রুপের পরিবারের ৮ সদস্যের নামে সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্লোভাকিয়া, সাইপ্রাস, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে থাকা অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ দেন। গত ২২ জানুয়ারি আরেক আদেশে পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফতের নামে দুবাইয়ে একাধিক ফ্ল্যাট ও ভিলা জব্দের আদেশ দেন একই আদালত। এভাবে গত ৪ মাসে অন্তত ১৫ জনের বিরুদ্ধে এ ধরনের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এসব সম্পদের প্রকৃত মূল্য জানা যায়নি। তবে বিদেশে থাকা অন্তত ২০০ কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ গত ৭ মাসে অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬ মাসে বিদেশে থাকা ১৬৫ কোটি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯৭ টাকার অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন জানান, দুদকের অনুসন্ধান বা তদন্ত কর্মকর্তারা প্রয়োজন মনে করলে দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করার আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করে থাকেন। আদালত আদেশ দিলে দেশে থাকা সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এ ক্ষেত্রে আদালতের আদেশে দেশে থাকা অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা সম্ভব হলেও বিদেশে থাকা অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ বাস্তবায়নে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিদেশে থাকা অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ দুদকে এলে দুদকের অনুসন্ধানকারী বা তদন্তকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট দেশে এমএলএআর পাঠান। এমএলএআর একটি রাষ্ট্রের কাছে আরেকটি রাষ্ট্রের আইনি সহায়তা চাওয়ার প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে এটি প্রথমে আমাদের দেশের এমএলএআরের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। এই কর্তৃপক্ষ বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আগে ছিল অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়। তবে বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমএলএআরটির বিষয়ে মতামত চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে পাঠায়। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এমএলএআরের যৌক্তিকতা বিবেচনার পক্ষে মতামত দিলে সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমএলএআরটি সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠায়। দূতাবাস সেটি সংশ্লিষ্ট দেশের এমএলএআরের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। পরে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন বিভাগের মাধ্যমে বিষয়টি সেই দেশের উপযুক্ত আদালতে উপস্থাপন করা হয়। সেই আদালত সে দেশের আইন ও বিধিবিধান অনুসারে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। সবকিছু ইতিবাচক থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতের মাধ্যমে বিদেশে থাকা বাংলাদেশের দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ হবে।