আজ ৩২ জুলাই (১ আগস্ট) শুক্রবার। ২০২৪ সালের এই দিন ছিল বৃহস্পতিবার। আন্দোলন দমনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট সরকার। ফ্যাসিজমের অংশ হিসেবে কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকা-ের’ অভিযোগ এনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার। আইনি প্রক্রিয়া শেষে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারার ক্ষমতা বলে সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে এই ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী, ‘সত্তা’ বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারি কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যেকোনো সংগঠনকে বোঝায়।
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে এবার নিয়ে দলটি চারবার নিষিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য তিনটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের বিষয়ে আইনি মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই মতামত পাঠানোর পর দুপুরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আর এই দলের অধীনে ও এসব নামে রাজনীতি করতে পারবে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেই বৈঠক হয়। জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্তের পর এখন সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হলো।
জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। আপিল বিভাগ ওই রায়কে বহাল রেখেছেন।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল বলে সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। সরকার বিশ্বাস করে যে জামায়াতে ইসলামী, শিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
তাই জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।আদালতের রায়ে নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নবেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিল খারিজ করে দেন। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু কয়েক বছর আগে সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হলেও পরে সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনেও সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছেন।
জামায়াতে ইসলামী ও শিবির নিষিদ্ধ হওয়ার পর এসব সংগঠনের সদস্যদের এখন কি বিচারের আওতায় আনা হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আইন আছে। তাঁরা যদি বাংলাদেশের আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করেন, তাহলে অবশ্যই বিচার হবে। তবে জামায়াতে ইসলামীর নতুন কর্মী, যাঁরা ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নিয়েছেন, তাঁদের গণহারে বিচার করা হবে না।নিষিদ্ধ হও য়ার পর জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যেতে পারেন কি না, একজন সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেই ইতিহাস জানেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে পারে। সেটাকে মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি আছে।
এদিকে এদিন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যেও কুমিল্লা, নারায়াণগঞ্জ ও বরিশালে সংঘাত আর রক্তপাত হয়। আন্দোলনে হতাহতের জের ধরে জাতিসংঘ সহিংসতা তদন্তে একটি স্বাধীন ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং দল পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। আন্দোলনের ছয় সংগঠককে পুলিশ হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা নিহতদের জন্য গণ মিছিল ও প্রার্থনা করে। পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
ডিবি অফিস থেকে মুক্তি পাওয়া ৬ জনের একজনের উপলব্দি থেকে পাওয়া বযানে বলা হয় ১ আগস্ট ডিবি অফিস থেকে বের হই। তখন আমি অসুস্থ। ২ আগস্ট আমি বুঝতে পারলাম আন্দোলনটা যে মাত্রায় চলে গেছে এখন স্পষ্ট করে আমাদের অবস্থান জানাতে হবে। এতোদিন কৌশলগতভাবে ৯ দফার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টা ছিল এ সরকারকে আমরা মানি না। যখন আন্দোলনটা এই পর্যায়ে চলে গেছে আমরাও বুঝতে পারছিলাম আমাদেরকে একটা শেষ পরিণতির ঘোষণা দিতে হবে। তখন আমরা আবারও যোগাযোগ তৈরি করি যারা বাইরে আন্দোলনটা পরিচালনা করছিল তাদের সাথে।
এদিকে সারাদেশে শিক্ষার্থী হত্যা, নিপীড়ন ও শিক্ষকদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ১ আগস্ট কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন শিক্ষক প্রসাশনিক ভবনের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। ২ আগস্ট নগরীর রেসকোর্সে এলাকায় গণমিছিল করে ছাত্র-জনতা। মিছিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। একই দিনে দাউদকান্দিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে ছাত্ররা।
২০২৪ সালের ১ আগস্ট (৩২ জুলাই) বৃহস্পতিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচিতেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আবার কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। কয়েকটি স্থানে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। ৩২ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে এসব কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কোথাও কোথাও শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ গ্রহণ করেন।
এইদিন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কে মুক্তি দেওয়া হয়। ১ আগস্ট দুপুর দেড়টার দিকে তারা ডিবি কার্যালয় থেকে গাড়িতে করে বের হয়ে যান। ওই সময় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বাবা বদরুল ইসলাম জানান, ভোর ৬টায় সবার বাসায় ফোন দিয়ে ডিবি অফিসে আসতে বলা হয়। পরে দুপুর দেড়টার দিকে ডিবি কার্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় তাদেরকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। তারা দুই দিন ডিবি অফিসে অনশন করেছে। তারা এখন শারীরিকভাবে বিপর্যস্থ বলেও জানান তিনি।
এইদিন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়।
এদিকে দেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী নীলদল। লিখিত বক্তব্যে তারা শিক্ষার্থীদের দাবির কাক্সিক্ষত সমাধান হওয়ায় তাদের আন্দোলনের পথ পরিহারের আহ্বান জানান। কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদসহ সব হত্যাকা-ের বিচার, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের দাবি জানায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের প্রাণহানি, হামলা, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকানরা। তারা শিক্ষার্থী হত্যার বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে প্রবাসীদেরকে রেমিট্যান্স না পাঠানোর আহ্বান জানান।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের বৈধতা নেই এমন দাবি করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার যে অন্যায় করছে, এই সরকারের আর কোনো অধিকার নেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার।