জুলাই ২৪ এ ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পতনের পর অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও বদলায়নি রাজধানীর মিরপুরস্থ কাফরুল, পল্লবী, ভাসানটেক এলাকার চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও সন্ত্রাসীদের অত্যাচার-নির্যাতন। এখানে নিজেদের জমিতে ঘর তুলতে হলে দিতে হচ্ছে মোটা অংকের চাঁদা। আওয়ামী লীগ আমলে এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায়নি স্থানীয়রা। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর স্থানীয়রা ভেবেছিলেন এবার বুঝি মুক্তি মিলবে। কিন্ত না, এসব সন্ত্রাসীরা এখন রং বদলেছে। আশ্রয় নিয়েছে বিএনপির ছায়াতলে। ফলে দখল, চাঁদাবাজি ও নির্যাতন থেকে রেহাই মিলছে না কাফরুল-ভাসানটেকবাসীর।
এমন অভিযোগ অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এস এম আনোয়ার হোসেনের। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার। ২৪ বছরের চাকরী জীবনে গিয়েছিলেন জাতিসংঘ মিশনেও। সেখান থেকে কষ্টার্জিত অর্থ এবং পেনশনের টাকা দিয়ে কিনেছিলেন এক খন্ড জমি। মিরপুরের ভাসানটেকে ক্রয়কৃত এ জমি টুকুই তার একমাত্র সম্পত্তি। কিন্তু তাতেও নজর পড়েছে সন্ত্রাসীদের।
দৈনিক সংগ্রামের এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি বলেন, জাতিসংঘ মিশন, পেনশনসহ তার চাকরীজীবনের সমুদয় টাকাসহ গ্রামের জমি বন্ধক দিয়ে ২০২২ সালে ভাসানটেকে এক টুকরো জমি কিনেছিলেন। এরপর সেই জমিতে মাটিভরাট ও বাউন্ডারি দিয়ে সম্প্রতি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তখন ৮/৯জন লোক নিজেদের বিএনপির লোক পরিচয় দিয়ে ৬ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। তখন আমি তাদের বলে দেই, আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত লোক। আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? তারা আমার কথা না শুনে বলেছে, টাকা না দিলে এলাকায় ঢুকতে দিবে না। এই এলাকায় আসলে তাকে মেরে ফেলবে। এসব বলে তাকে অস্ত্র দেখায়। কয়েকদিন পর এসব লোকজন তার জমিতে আল আকসা টাওয়ারের নামে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। এখানে জমির মালিক দেখানো হয় ৩৪ জনকে। আক্ষেপ করে আনোয়ার হোসেন বলেন, নিজের জমিতে নিজের নামফলকও ঝুলাতে দেয়নি তারা। প্রশাসনের লোক হয়েও যেন প্রশাসনের কাছেই অসহায় তিনি। বলেন, মিরপুর এলাকার সেনাবাহিনী বরাবর ব্যবস্থা নিতে একটা দরখাস্তও করেন। তারা পরবর্তীতে থানায় যাওযার পরামর্শ দেয়। কিন্তু থানায় গিয়েও তিনি কোনো সহযোগিতা পাননি। তিনি বলেন, আমি সেনাবাহিনীর সেকেন্ড ক্লাস অফিসার হয়েও কারো কাছে কোনো সহযোগিতা পাইনি। যারা তার কাছে টাকা চেয়েছে তাদের মধ্যে গিয়াস, সিরাজ, সায়েদুল, জনি দেওয়ানকে তিনি ছিনেন বলে জানান। এরা সবাই বিএনপির লোক বলে তিনি জানান।
আরেক ভুক্তভোগী ব্যাংক কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনিও নিজের জমিতে ভবন তুলতে পারছেন না সন্ত্রাসীদের ৩০ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ার কারণে। তিনি বলেন, চাঁদা না দেয়ায় তার টিনসেড এর ঘর ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। প্রশাসনের কাছে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে এসব সন্ত্রাসীরা পুলিশের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করতো। ২৪ এর গণ অভূত্থানের পর ভেবেছিলেন এইসব সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অবসান হবে। কিন্তু সেটি না হয়ে উল্টো দ্বিগুণ গতিতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়েছে। থানা পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। উল্টো বিএনপির ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে এসব চাঁদাবাজরা। ফলে বেলায়েত হোসেনদের আতঙ্ক যেন পিছুই ছাড়ছে না। বেলায়েত হোসেন জানান, বিদেশ থেকে কিলার ইবরাহিম পরিচয়ে একজন ফোন করে বলেন, এটি আমার এলাকা। আমার কিছু ছেলেকে পালতে হয়। ভবন তৈরী করতে হলে কিছু টাকা দিতে হবে। কত দিতে হবে এমনটি জানতে চাইলে বলা হয়, ভবন নির্মাণ করতে হলে ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। তিনি বলেন, সামাণ্য কিছু টাকা হলে হয়তবা দিয়ে মিটমাট করে ফেলতাম। কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবো। তিনি বলেন, টাকা দিতে গড়িমসি করায় সন্ত্রাসীরা আমার টিনসেড বাড়ি ভেঙে ফেলে। ঘর ভাঙার সময় থানায় লিখিত অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি বলে তিনি জানান। উল্টো টাকা দিয়ে মিটমাট করার কথা বলে থানার লোকজন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় মামলা করলে উল্টো তাকে হত্যা মামলার আসামী করা হয়। তিনি বলেন, এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছে কাফরুল থানা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক জনি দেওয়ান। এখানে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে। এরা এখানে দলের পরিচয়ে চাঁদাবাজি করছে। থানা পুলিশের নিরবতার পাশাপাশি দল হিসেবে বিএনপির প্রতি তাকিয়ে আছেন বেলায়েত হোসেন।
অভিযোগে প্রকাশ, এবার জনি দেওয়ানসহ স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নজর পড়েছে কাফরুল ধানাধীন মিরপুর ৪নং ওয়ার্ড মার্কেট ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এর সরল প্রাণ গরীব সদস্যদের কষ্টের টাকায় গড়ে উঠা মার্কেটের উপর। এই মার্কেটটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন জনি দেওয়ান। অভিযোগ করে সমিতির সদস্যরা জানান, আগস্ট ২৪ এ ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পতন হলেও নতুন করে কালো মেঘ দানা বাঁধায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। কাফরুল থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক জনি দেওয়ানের ভয়ে তটস্থ সবাই। তার কথার অবাধ্য হলে নেমে আসছে নির্যাতন ও হামলা-মামলার খড়গ। এলাকার গরীব মানুষের জায়গা-জমি, ঘর বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলে নেয়ার পর এবার গরীব সদস্যদের কষ্টের টাকায় গড়ে উঠা মার্কেট দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
জানা গেছে, দীর্ঘ তিন দশক আগে সমিতির নামে এলাকার গরীব মানুষ, দিনমজুর, রিক্সাওয়ালা, ফেরিয়ালা, তরকারি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, দোকানদার, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কাছ থেকে নেয়া টাকায় গড়ে উঠছে ‘ সোমারসেট স্কয়ার’। তবে বিনিময়ে এখন পর্যন্ত কিছুই পাননি তারা। এমনকি সদস্যরা জানেন না সমিতির সদস্য কতজন। আওয়ামী আমলে স্থানীয় কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগের নেতারা এসব অর্থ হাতিয়ে নিয়ে শুধু স্বপ্নই দেখিয়ে গেছে। বর্তমানে পট পরিবর্তনের পর কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। এখন নতুন করে ফের সদস্য বাড়ানো হচ্ছে। ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। যারাই প্রতিবাদ করছে, তাদের হুমকি-ধামকিসহ মামলার ভয় দেখানো হচ্ছে।
জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময়ের কথিত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি শওকত হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মাইকেল অস্ত্র আর বাহুবলের জোরে সমিতির কোটি কোটি টাকা আত্নসাৎ করছে। বছরের পর বছর একটিও সভা না করে ১৯৯৮ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরা দুজনই সমিতির কর্ণধারের আসনে আসীন ছিলেন। সমবায় আইন অনুযায়ী প্রতিবছর জুন মাস শেষ হবার পূর্বে প্রত্যেক নিবন্ধিত সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত করে এতে আয় ব্যায়ের হিসাব সদস্যদেরকে জানাতে হয়। জানা গেছে, এই সমিতিতে গত ২৭ বছরে একটি সাধারণ সভাও করা হয়নি। তিন বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের বিধান থাকলেও এই সমিতি অধ্যবধি কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সমিতির হিসেবেও বিশাল অর্থ তছরুফের প্রমাণ পাওয়া যায়। জানা গেছে, যারা সমিতির প্রাথমিক সদস্য, যাদের কষ্টার্জিত টাকায় সমিতি গঠিত এবং সরকার থেকে সমিতির নামে জমি বরাদ্দ এবং লীজ দলিলের মাধ্যমে ক্রয় করা হয়েছে, তাদের অনেকের সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে।
অভিযোগে প্রকাশ, জুলাই ২৪ এ স্বৈরাচার পতনের পর সমবায়ের অসৎ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় পূর্বের ন্যায় ভুয়া নির্বাচনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, সমিতির সদস্য যিনি কাফরুল থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সাব্বির আহম্মেদ জনি দেওয়ান, তিনি পতিত স্বৈরাচারের দোসর এবং সরকারের তালিকায় থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাথে আঁতাত করে সমিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি সমিতির মার্কেটে বিএনপির ব্যানারে নিয়মিত সভা করছে। এছাড়া সমিতির মার্কেটের জায়গা দখলে নিয়ে দলীয় ব্যানারে অবৈধভাবে অফিস পরিচালনা করছেন। একইসাথে সেই অফিসে বসে জনগণকে বোকা বানিয়ে নির্মিতব্য মার্কেটে দোকানের মালিক বানাবে বলে আাবরো লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় মাসুদ রানাকে ব্যবহার করে নতুন করে দোকান-ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, স্বৈরাচারপন্থী সাবেক কমিটির সাথে সাব্বির আহম্মদ জনি এবং তার বড় ভাই হাবিব দেওয়ান এর আঁতাত রয়েছে।
জানা গেছে, শুধু গরীব সদস্যদের মার্কেটই নয়, কাফরুল, ভাসানটেক এলাকার স্থানীয় মানুষের জমি, বাড়ি ঘরও দখলে নিচ্ছে এই জনি দেওয়ানসহ ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন। বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে তার এ অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলছে, তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। জানা গেছে, ৪ নং ওয়ার্ডের শ্যামল পল্লী, ইমাননগর, পূর্ববাইশটেকী এলাকার পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে এলাকার অসহায় গরীব সদস্যদের মিথ্যা মামলা ও হুমকি ধামকি দিয়ে গ্রেফতার করার হুমকি ধামকি দিচ্ছে। অনেকেই পুলিশের ভয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছেন।
মিরপুর-১ এর বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন অভিযোগ করে বলেছেন, জনি দেওয়ান তার শ্যামল পল্লীতে থাকা ৫ কাঠা জমি সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে দখলে নিয়ে ভাড়া দিয়েছে। প্রতিকার চাইতে গেলে তাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। তিনি প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে আবেদনও করেছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পানি নি। এছাড়া এই জনি দেওয়ান কাফরুল থানাধীন সেচপাড়া এলাকার রাজিয়া, মর্জিনা, হেনা বেগম, জোসনা ও আম্বিয়া বেগমের জমি জাল দলিলের মাধ্যমে দখলে নিয়েছেন। দখলে নিয়েছে ঈমাননগর এলাকার ১১৭ নং দাগের জমিও। সেটি দখলে নিয়ে ৪/৫ লাখ টাকা ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে সাবেক কমিশনার জামাল মোস্তফার জমি, বাড়িঘরও দখলে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, জনি দেওয়ানের এসব দখল ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়টি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির নেতৃবৃন্দকে একাধিকবার জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং অভিযোগ করার পর জনি দেওয়ানের অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে বলে জানান তারা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে জনি দেওয়ানের মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কাফরুল এলাকায় চাঁদাবাজির বিষেয় জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, চাঁদাবাজি যেই করুক, কোনো ছাড় নয়, যদি সে বিএনপির নাম ব্যবহার করে। তিনি বলেন, কেউ যদি বিএনপির পরিচয়ে চাঁদা দাবি করে তবে আমরা সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেব। কাফরুলের বিষয়ে তাকে জানালে তিনি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান। তিনি অভিযোগ করেন, পতিত আওয়ামী লীগ থেকে আসা কিছু নতুন চক্র বিএনপির নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করছে। এতে দলের সম্মানহানি হচ্ছে। বিএনপি এ ধরনের অপকর্ম বরদাশত করবে না বলে জানান।