আজ ১৯ জুলাই শনিবার। ২০২৪ সালের এই দিন শুক্রবার ছিল। সারাদেশে দ্বিতীয় দিনের মতো ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেন। এ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলী, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এদিন শুধু ঢাকায় অন্তত ৬২ জন নিহত হন। ঢাকার বাইরে রংপুরে দুইজন, সাভার, সিলেট ও নরসিংদীতে একজন করে মোট পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় দেশের শীর্ষস্থানীয় মিডিয়াগুলো থেকে।

আন্দোলন ছড়িয়ে পরবে এমন আশঙ্কায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে লেথেল ওয়পন মানে মারণরাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়ায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ-র‌্যাবের কতিপয় কর্মকর্তা। সাথে সাথেই তারা শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন শুরু করে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সন্বয়কদের একে অপরের সাথে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই সুযোগে আন্দোলন দমন করতে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করতে শুরু করে পুলিশ-র‌্যাব। ব্যবহার করে তাজা বুলেট, মারণাস্ত্র। হাসপাতালগুলো উপচে পড়ে হতাহতদের দিয়ে। রাতদিন চিকিৎসা দিয়েও শেষ করতে পারেনি ডাক্তাররা। অন্যদিকে গণহারে গ্রেফতার চালিয়ে যায় পুলিশ-র‌্যাব। এদিন ঢাকার অলিতে গলিতে থাকা মেসগুলোতে অভিযান চালায় আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের লোকজন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে যায় শিক্ষার্থীদের। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের লোকজনের এদিনের ভূমিকা ১৯৭১ সালকে মনে করিয়ে দেয়। সমন্বয়কদের ভাষায়, ১৯৭১ সালে ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধা খোঁজা হতো। ২০২৪ সালে এসে খোঁজা হয় শিক্ষার্থী তরুণদের, আন্দোলনকারীদের। এবছর আওয়ামী লীগের লোকজন শিক্ষার্থীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশকে নিয়ে যায় বাসায় বাসায়, ছাত্রাবাসে। ছাত্ররা থাকে এমন মেসগুলো তন্ন তন্ন করে অভিযান চালায় গ্রেফতারের জন্য। কোনভাবেই যাতে আন্দোলন না চালিয়ে যেতে পারে এজন্য তরুণদের গ্রেফতারে নামে পুলিশ-র‌্যাব। বুঝতে পেরে কেউ বাসাতে অবস্থান করেনি। তারা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী আত্মীয় স্বজনের বাসায় অবস্থান করে। এদিন আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা মাঠে নামে। তারা আন্দোলন মনিটরিং করার কাজটি করতে থাকে।

এদিন শুক্রবার জুমার নামাযের পরে ছাত্র-জনতার ওপর টার্গেট করে স্নাইপার থেকে গুলী চালিয়ে বহু লোককে শহীদ করা হয়। ১৯ জুলাই দিনের বেলায় আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামে। তারা বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলন বিক্ষোভ করতে থাকে। পুলিশ র‌্যাব আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। এতে শত শত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী গুলীবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালমুখী হতে থাকে। এদিন এতো সংখ্যক হতাহত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসে যে, ডাক্তাররা হতবাক হয়ে বলে ওঠেন যে, নরকের দরজা খুলে গেছে। এদিন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর গুলীতে ঝাঝড়া হয়ে হাসপাতালগুলো ভরে যায় রোগীতে। হাসপাতালের সমস্ত চিকিৎসক স্টাফ মিলেও রোগী সামাল দেওয়া হিমসিম খেতে হয়।

সেদিন হাসপাতালগুলোর কি দৃশ্যপট ছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলার জবানীতে। ১৮ জুলাই থেকে শুরু হয় রোগী আসা। সেদিনের চেহারাটা ছিল অত্যন্ত বিভৎস। আমি তখন অপারেশন থিয়েটারে রেগুলার ওটি করছিলাম। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। তখন বর্তমান হাসপাতালের এডি রেজুয়ানুর রহমান সোহেল ভাই, ওটিতে গিয়ে নক করে বলেন নীলা তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসো। নিচেতো নরকের দরজা খুলে গেছে। আমি ওটি শেষ করে নিচে নেমে আসি। নিচের দৃশ্য দেখে আমি ধপাস করে পড়ে যাই। আমি দেখতে পাই, শত শত মানুষ। কেউ একহাতে চোখ ধরে আছে। কেউ দুই হাত দিয়ে দুই চোখ ধরে আছে। চোখগুলো ক্ষত বিক্ষত। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। বিভৎস চেহারা দেখতে পাই। এদের বয়স হচ্ছে ১৪ থেকে ২৫/২৬। ইয়াং জেনারেশন যাদের বলে। তারপর আমাদের দশ টেবিলে ওটি শুরু হয়ে গেলো। সেদিন ওটি রাত ১০টা পর্যন্ত চলেছে। আমরা হাসপাতালের জনশক্তি যারা ছিলাম সবাই ওটিতে অংশ নিয়েছি। আমি বাসায় এসে দেখি ওয়াই-ফাই কানেশন অফ হয়ে গেল। তারপর ১৯ তারিখ। সেদিনের চেহারাও একইরকম। ১৯ তারিখ সকালেই হাসপাতালে গেলাম। রাস্তায় যানবাহন ছিল না। বাসা থেকে রিকশায় ভ্যানে করে গেলাম। সেদিন আলাপ করে সকাল থেকেই ওটি শুরু করি। কারণ আমরা বুঝলাম সকাল থেকে ওটি শুরু না করলে শেষ হবে না। এরপরও শেষ করা যায়নি। কারণ সেদিন আরও বেশি রোগী আসে। সেদিন কারো বিশ্রাম ছিল না।

এদিন আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে গুলী ছোড়া হয়। তবে র‌্যাবের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘তারা আকাশ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। হেলিকপ্টার থেকে কোনো গুলী ছোড়া হয়নি, বরং উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়েছে।’ বিজিবির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পুঁজি করে যারা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের শক্ত হাতে দমন করা হবে। এদিন সরকারের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব ফের প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলন ৯ দফা দাবি পেশ করে। আন্দোলনের সমন্বয়করা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান তাদের অভিভাবকরাও। ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ শীর্ষক ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন করেন সর্বস্তরের অভিভাবক সমাজ।

১৯ জুলাই এই দিনে, শেখ হাসিনা সরকার মধ্যরাতে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে এবং দিনব্যাপী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৬ জন নিহত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সরকার। এদিন নরসিংদী জেলা কারাগার ভেঙে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এতে পালিয়ে যায় কয়েদিরা। মেট্রোরেল স্টেশন ও বিআরটিএ অফিসসহ আরও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হংয়। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বাধা দেয়ার প্রয়াসে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জনসমাগম ও মিছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস দেশব্যাপী বন্ধ রাখা হয়। তবে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন সহিংসতা, গুলী, অগ্নিসংযোগ ও মৃত্যুতে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকা। মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশনে ভাঙচুর চালানো হয়।

১৮ জুলাই কেবল ঢাকা মহানগরীতেই গুলী ও সংঘর্ষে অন্তত ৪৪ জন নিহত হওয়ার খবর আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ঢাকার বাইরে মোট ৫৯ জন নিহত হয় বলে জানায় দেশি-বিদেশী মিডিয়া। এতে ছাত্র, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারীসহ কয়েক শত শত মানুষ হতাহত হয়। প্রথম দিকে আন্দোলনে শুধু শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের পর সর্বস্থরের মানুষকে আন্দোলনে যোগ দিতে দেখা গেছে। সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ডাক ব্যাপকভাবে অব্যাহত থাকে।

১৮ জুলাইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাইতেও সারাদেশে সকল ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখা হয়। এইদিনেও সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ চলে। বেলা পৌনে ১টার দিকে আন্দোলনকারীরা কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানা ঘেরাও করলে থানার ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা ছররা গুলী ছোড়েন, এতে শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ঢাকার উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা পল্টনসহ কয়েকটি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সারাদিন দফায় দফায় সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। মিরপুরে জুমার নামাজের পর বেলা তিনটার দিকে কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া এবং মিরপুর - ১০-এর বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সাভারে বিকাল তিনটা থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে হাজারো শিক্ষার্থী জড়ো হয়। বিকেল চারটার দিকে শিক্ষার্থীরা ঢাকার রামপুরা থানা ঘেরাও করে।

১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রোধ করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে ঢাকার সাথে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। জাতীয় সংবাদপত্র অনুযায়ী ১৯ জুলাই শুক্রবার সারাদেশে কমপক্ষে ৫৬-৬৬ জনের মৃত্যু হয়।

একজন সমন্বয়কের ভাষায় ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে স্নাইপার অ্যাটাকে কারবালা নেমে এসেছিল। যাত্রাবাড়ীতে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধকে লেলিন গ্রাদের সঙ্গে তুলনা করেন কেউ কেউ । এদিন শুক্রবার জুমার নামাজের পরে ছাত্র-জনতার ওপর টার্গেট করে স্নাইপার গুলী চালিয়ে বহু লোককে শহীদ করা হয়। এদিন জুমার নামাজের পর পুলিশ তখন দল বেঁধে এসে গুলী করছিল এমনটা না। আবার থানা থেকে করছে এমনও না। তখনও পুলিশ থানার সামনে দল বেঁধেই ছিল। এদিকে ১৭ জুলাই থেকে যাত্রাবাড়ী থেকে বিশেষ করে শনির আখড়া, কাজলা হয়ে রায়েরবাগ ঢাকা-চিটাগাং মহাসড়কটা ছাত্রজনতার দখলে ছিল। যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ শনির আখড়া আসবে এমন সাহস তখনও করতে পারেনি।

ওইদিন কাজলা টোলপ্লাজা এলাকাতে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ফেলে রাস্তা ব্লকেড করা হয়। কেউ স্লোগান দিচ্ছে। কেউ গোল হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এমন সময় কোথা থেকে গুলীর শব্দ আসলো। এটা কোন দিক দিয়ে আসছে; ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। এক অটোড্রাইভার দাঁড়িয়েছিলেন। গুলী এসে তার মুখে লাগলো এবং মুখের গালের অংশ ছিঁড়ে নিয়ে চলে যায়। এই সময়টা গুলীর পর গুলী আসছে। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। কেউ কেউ পড়ে যাচ্ছে। আর উঠতে পারছে না। তখন ধারণা করা হলো স্নাইপার শ্যুট করা হচ্ছে। হাসপাতাল ভর্তি আহত লোকজনে। ১০ মিনিটের মধ্যে ঘটে গেছে এবং আশপাশের ভবনের ছাদ বা জানালা থেকে শ্যুট করা হচ্ছিল। শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শত শত মানুষ চোখের পলকে আহত হয়েছে।

এদিন বিকেল পাঁচটায় বিক্ষোভকারীরা মিরপুর ১৪ নম্বরে অবস্থিত বিআরটিএ ভবনে আগুন দেয়। নরসিংদীতে দুই হাজারের মতো উত্তেজিত জনতা নরসিংদী কারাগার ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ৩৩১ জন কয়েদী আত্মসমর্পণ করেন। সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করে সরকার।

এদিন মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়। এছাড়া গণঅধিকার পরিষেদের সভাপতি নুরুল হক নুরকেও আটক করা হয়। যেসময়ে নাহিদ ইসলামকে আটক করা তার কাছাকাছি সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন প্রতিনিধির সাথে সরকারের তিনজন প্রতিনিধির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

হাসপাতালগুলোতে ততক্ষণ ছাত্রলীগের লোকজন এসে চিকিৎসা না দেওয়া ও ভর্তি না করাতে হুমকি দিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালের মালিক ভালো মানুষ ছিলেন। তারা সব হুমকি উপেক্ষা করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে। কিøনিকগুলো বেশি টাকা নেয়নি। জাস্ট যে বিলটা না নিলে নয়, যা খরচ হচ্ছিল তাই নিয়েছে ব্যান্ডেজ আর ইনজেকশনের বিলই শুধু নিতো। অনেকে শহীদ হয়েছেন ওদিন। কোনো হাসপাতালাই মৃত্যুর সার্টিফিকেট দেয়নি। ১৮/১৯ তারিখ ঢাকার উত্তরা, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া কোনো বেসরকারি হাসপাতালই কারো কোনো ডাটা বা তথ্য রাখেনি। এদিন ছাত্র ছাড়াও শ্রমিক শ্রেণির মানুষই বেশি আন্দোলনে ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও পুরোদমে আন্দোলনমুখী হয়ে পড়ে। তারা হাসপাতালে আহত কর্মীদের দেখতে যান। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ততক্ষণে আন্দোলনে নেমে যায়।

১৯ জুলাই মিরপুরে কাফরুল থানার সামনের ঘটনা। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিল ঘরে। শিশুটি জানালা বন্ধ করতে গেলে একটা গুলী তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়! রাতে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ইন্টারনেটসেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিন ১৭ টি লাশের তথ্য পাওয়া যায়। তখনও বিভিন্ন জায়গা থেকে লাশ আসতে থাকে। শুক্রবার জুম্মার পর নাহিদ যে বক্তব্য দেয় কোনো নিউজ ছাপেনি। ৯ দফা ঘোষণার পরই ১৯ জুলাই রাত দেড়টার দিকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয় এবং একই দিনে নুরুল হক নুর, রুহুল কবির রিজভীকে তুলে নেওয়া হয়।

১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলী, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এদিন সারা দেশে ৮৪ জন নিহত হন। রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন। ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ।

সকাল ১০টার দিকে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষকরা মুখে কালো চাদর পরে বিক্ষোভ করেন। বেলা আনুমানিক ১২:৪৫ মিনিটে, কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানায় বিক্ষোভকারীরা থানা ঘেরাও করার পরে, পুলিশ স্টেশনের ভিতর থেকে জনতার উপর গুলী চালায়, এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। নরসিংদীতে, জনতা কারাগারে ঢুকে জেলা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রায় ৯০০ বন্দিকে মুক্ত করে দেয় এবং ৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১০০০ রাউন্ডের বেশি গুলী লুট করে। সারাদেশে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মোট ১০৩ জন নিহত হয়। রাতে কারফিউ জারি করা হয়; সেনা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। সারাদেশে ইন্টারনেট পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পর অভিনব কায়দায় যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা। জানা যাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদের বয়ানে। তিনি দৈনিক সংগ্রামের সাথে আলাপকালে জানান সেই কৌশলের কথা। নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেবে এটা আমাদের মধ্যে আগেই আশংকা ছিল। আমাদের জেলা শাখাগুলোতে অফলাইন মোবাইল থাকবে। আমরা নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়ার ১০/১৫দিন আগে, যেহেতু জানতাম নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিতে পারে, সেদিক থেকে আমি আমাদের খলিল ভাই নামে এক স্টাফ ছিল, তাকে বললাম আমাদের কিছু মোবাইল লাগবে এবং কিছু সিম লাগবে।তিনি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়ার ৩/৪দিন আগে তার আরেক কলিগ মামুন আব্দুল্লাহ নামের ভাইয়ের মাধ্যমে পাঠায়। এর মুরব্বির নামে নাকি সিমগুলো কিনছে। তখনতো ফিঙ্গার দিয়ে কিনতে হতো। আমরা আগেই কিনে রাখি অনেকগুলো সিম। যেদিন নেটওয়ার্ক বন্ধ করে আমি একটা নেই। সিবগাত ভাইকে একটা দেই। ম্াহাদি ভ্ইাকে একটা দেই। আসিফকে একটা দেই। সিবগাত ভাই সব জেলা শাখাকে একটা করে কেনার পরামর্শ দেন। সিবগাত ভাই কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করেন।

১৯ জুলাই রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল, পরিস্থিতি ছিল থমথমে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এদিন আহত হন শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারীসহ অনেকে। এদিন আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনকেও অংশ নিতে দেখা যায়। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালানোর পাশাপাশি হামলা চালানো হয় রাজধানীর মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশনে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের শতাধিক গাড়ি। এদিন নরসিংদীর জেলা কারাগারের গেট ভেঙে ৮২৬ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। লুট করা হয় অস্ত্র। পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের মধ্যে আনসরুল্লাহ বাংলা টিমের সাত সদস্য ও জেএমবি’র দুই নারী সদস্যও রয়েছে। এসময় ৮৫টি অস্ত্র ও ১ হাজার ৫০টি গুলী ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

এদিন ঢাকার বাইরে খুলনার শিববাড়ী, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, রংপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গোলযোগের মধ্যে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের জিম্মি করে সেখান থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

পরে ১৪ দলের নেতারা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ১৪ দলের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েন ও কারফিউ জারির পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়, পাশাপাশি করা হয় সেনাবাহিনী মোতায়েন। এদিন দিবাগত গভীর রাতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আট দফা দাবি তুলে ধরেন কোটা আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক। একইসঙ্গে তারা জানান, আন্দোলনের নামে সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। অবশ্য এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দাবি না মানা পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে বলে আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেন।

আব্দুল কাদের জানান, ‘কোটা সংস্কারকে উদ্দেশ্য করে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল; কিন্তু সরকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করলে আন্দোলন ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ৯ দফার অবতারণা হয়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলাম; কিন্তু ১৬ তারিখ মঙ্গলবার আবু সাঈদসহ ৬ জন যখন শহিদ হন, ওইদিন রাত ১২টায় সামনের সারির সমন্বয়করা মিলে আমরা একটা অনলাইন মিটিং করি। মিটিংয়ে প্রথম এজেন্ডাই ছিল আজকে যে ছয়জন শহিদ হলেন, এই ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার কিনা? তখন সবাই হই হই করে বলে উঠে, ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার হতে পারে না। পরবর্তীতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করা হয়’।

উল্লেখ করে এই সমন্বয়ক বলেন, ‘বলে রাখা ভালো, আমরা এতোদিন “বাংলা ব্লকেড” থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পেশসহ নানান সফট এবং হার্ড কর্মসূচি নিয়ে মাঠে অবস্থান করেছিলাম; কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে নির্বিকার-নির্লিপ্ত মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। আলাপ-আলোচনার ধার ধারেনি সরকার, কেবল হাইকোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে যায়, ছয়জন শহিদ হয়; ওইদিনই সরকার আলোচনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়, আমাদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিতে থাকে আলোচনায় বসার জন্য। ‘কিন্ত আমরা আলোচনার আহ্বানকে বরাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করি। যদিও ভেতর-বাইরে থেকে আলোচনায় বসার নানারকম চাপ আসছিল।

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার সংলাপের আহ্বান ফরমালি জানিয়েছিল কিন্ত সেটার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের অবস্থান ফরমালি ক্লিয়ার করিনি। ক্লিয়ার করার সুযোগও পাইনি। বুধবার গায়েবানা জানাযায় ঢাবি ক্যাম্পাসে পুলিশ আমাদের ওপর গুলী চালায়, আমিসহ কয়েকজন আহত হই। হান্নান মাসউদ গুলীবিদ্ধ হন। তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাবার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেফতার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। যদিও সরকারের সংলাপকে প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার রাতে আমরা কিছু দাবি দাওয়া ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করে যে সেই দাবিগুলো ফাইনাল করব সে সময় পাইনি। তবে আমরা বৃহস্পতিবার মাঠের কর্মসূচি (কমপ্লিট শাটডাউন) দিয়ে নিজেদের অবস্থান ক্লিয়ার করেছিলাম। বৃহস্পতিবার আমি আর আসিফ ভাই এক বাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে চলে যাই। ওইদিন ১৮ তারিখ রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। আমরাও কর্মসূচি চলমান রাখতে, গ্রেপ্তার এড়াতে বার বার জায়গা পরিবর্তন করে বেড়াচ্ছি। কারো সাথে তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।

‘আন্দোলনের শুরুতেই নাহিদ ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে এক লোকের সঙ্গে মিট করায় এবং পরবর্তীতে আন্দোলনের পারপাসে একাধিকবার ওই লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়; পরবর্তীতে জানতে পারি তিনি ঢাবি শিবিরের ছাত্র আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্ত তখনো শিবিরের সভাপতি এবং সেক্রেটারির সঙ্গে ওইভাবে যোগাযোগ হয়নি। শুক্রবার যাত্রাবাড়ী এলাকায় যখন আন্দোলন করছিলাম তখন শিবিরের ঢাবি সেক্রেটারি ফরহাদ ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, আন্দোলনরত কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে, এতো এতো শহিদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতেছে তারা। আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, মানুষের সঙ্গে বেইমানি করা যাবে না। আমি সম্মতি জানাই। আমাদের তো আগেই অবস্থান ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া মঙ্গলবার রাতের মিটিংয়ে ঠিক করা কিছু দাবি দাওয়া আমার মাথায় আছে।

আব্দুল কাদের বলেন, আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার মতো মাঠে কোনো সিনিয়র নেই। আসিফ-নাহিদ ভাইকে গুম করে রেখেছে। আমি সাত-পাঁচ না ভেবে রিস্ক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওইদিন জুমার নামাজের পর পরই যাত্রাবাড়ীতে কয়কজন শহিদ হন, সবগুলা আমার চোখের সামনেই ঘটতেছে। মানুষকে পাখির মতো গুলী করে মেরে ফেলছে, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাছাড়া দীর্ঘদিন জেল-জুলুম, হামলা-মামলার শিকার হয়ে হাসিনার এমন অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছি; মাথা নত করিনি। আমার পরিণতি কী হবে, সেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি। চোখের সামনে মানুষ মেরে ফেলছে, মানুষের কথা চিন্তা করে নিজের জীবনের কথা ভাবার সময় পাইনি। গত ৪/৫ বছর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই আমাদেরকে দৃঢ়তা ধরে রাখার শিক্ষাই দিয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরার সিদ্ধান্ত নিই। ‘যাইহোক, কিছুক্ষণ বাদে শিবিরের সেক্রেটারি আমাকে আবারো ফোন দিলেন। বললেন, কিছু দাবি দাওয়া খসড়া আকারে করছি, তোমার সঙ্গে আলোচনা করি। আমাদেরও যেহেতু আগেই আলোচনা হয়েছিল অনেকগুলো দাবির ব্যাপারে সেগুলো তখন উনার সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে তৈরি হয় ৯ দফা। তিনি একে একে কিছু দাবি বললেন। যেগুলা খুব কমন দাবি দাওয়া- যেমন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ প্রশাসনকে বরখাস্ত, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা, ভিসির পদত্যাগ। যেগুলা ৬ জন শহিদ হওয়ার পর মঙ্গলবার রাতের বৈঠকের আলোচনাতেই আমরা ভেবেছিলাম। এছাড়া মানুষজনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছিল। শেষের দিকে গিয়ে শিবিরের সেক্রেটারি একটা দাবি অ্যাড করলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। এটা আমি মানি নাই, দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা হলো। পরে আমি বললাম, ঢালাওভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা যাবে না, এক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলতে পারেন। পরে সেটাই ঠিক হল, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

‘এই হইলো ৯ দফা তৈরির পেছনের গল্প। তবে ৯ দফা প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শিবির। যেহেতু নেট নেই, গোলাগুলী-কারফিউয়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে হাউসে হাউসে পৌঁছে দিয়েছে, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তারাই করেছে। আমাকে নতুন একটা সিম এবং মোবাইল কালেক্ট করার পরামর্শ দিল তারা। আমি স্টুডেন্টের বাসা থেকে সিম নিয়ে ওই নম্বরটা ৯ দফা সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে দিয়ে দিলাম। ওইদিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে ৪-৫ কিলো দূরে হেঁটে গিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদেরকে ফোন দিয়ে ৯ দফার বিষয়টা জানালাম। টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তো ওই রাতে তাদের অনেককে একটা একটা করে দফা বাটন ফোন দিয়ে ম্যাসেজের মাধ্যমে দাবিগুলা লিখে পাঠাইছি। পুরো ৯টা দাবি একসঙ্গে ম্যাসেজে পাঠানো যায় না। কাউকে আবার মুখে বলে দিয়েছি, তিনি লিখে নিয়েছেন। কেউ আবার রেকর্ড করে নিয়েছেন। কনফার্ম হওয়ার জন্য অনেকেই ফোন দিয়েছেন, এটা আসলেই আমি দিয়েছি কিনা। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলাকেও ফোন দিয়ে কনফার্ম করতে হয়েছে, আমার পক্ষ থেকে এটা যাচ্ছে, আপনাকে একজন পেনড্রাইভের মাধ্যমে পৌঁছে দেবেন। এইভাবে চলল রাতের ১১টা পর্যন্ত।

এই সমন্বয়ক লিখেন, ‘প্রতিদিন রাতের বেলায় বাসা থেকে দূরে চলে যেতাম। ফোন অন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে ২-৩ ঘণ্টা কথাবার্তা বলে, তাদেরকে কনফার্ম করে, ফোন বন্ধ করে আবার বাসায় ফিরতাম। সিনিয়ররা গুম অবস্থায় ছিল, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না বাকিদের সঙ্গেও। এইভাবেই চলতে থাকল। আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী থানার পাশেই। গ্রেফতারের আতঙ্ক, তারপরও বাসায় থাকতে হতো। শুরুতেই যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। কোনো রাত মসজিদে কাটিয়েছি, কোনো রাত অর্ধেকটা বাইরে কিংবা বাসার ছাদে কাটিয়ে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছি। পরিশেষে আব্দুল কাদের লিখেন, এইতো ঐতিহাসিক ৯ দফা, আমাদের ৯ দফা, ফ্যাসিস্ট হাসিনা থেকে মুক্তি লাভের সনদ!