আয়না ঘরে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। চোখ-হাত বেঁধে জম টুপি পরিয়ে পা উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হতো। রক্তাক্ত অবস্থায় এরপর ফেলে রাখা হতো। কারেন্ট শক দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ে চাপ প্রয়োগ করা হতো। প্রশ্ন করা হতো-ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্ট দেখেও। আর নির্যাতনের সময় আল্লাহর নাম নিলে আরো বেশি মারতো। হাসিনার আয়না ঘর থেকে একের পর এক ভয়াল অভিজ্ঞতা, শরীরে ক্ষতচিহ্ন, আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে এসেছেন শত শত মানুষ। এমন কয়েকজনের তথ্য উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত নথিতে।

গুম থেকে ফিরে আসা এমন একজন কমিশনকে জানিয়েছেন, ‘আমার পা বেঁধে উপর দিকে করে ঝুলাইছে। মাথা নিচের দিক, পা উপর দিক দিয়ে। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন, একেবারে উইদাউট ড্রেস। তারপরে এলোপাথাড়ি আমাকে দুইজনে একসঙ্গে পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরবর্তীতে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে, চোখের কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো। শুধু পিঠে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে গেছে.....।’ পরবর্তীতে যখন আমাকে একটা সেলের সংকীর্ণ একটা জায়গায় রাখে, তখন আমি পিছনে হাত দিয়ে দেখি যে রক্ত পড়তেছে। আর এটার দাগ প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত ছিল। মানে পেটানোর দাগ এরকম পুরো হয়ে গেছিল। যখন উপর হয়ে শুয়ে আছি, তখন ওইখানে সাইফুল নামক একটা লোক, সে বলে যে, “ভাই, আপনি উপর হয়ে শুয়ে আছেন কেন?” আমি বলছি, ভাই, আমি বসে থাকতে পারতেছি না।... আমাকে টর্চার করেছে ২৫ দিন। তিনি বলেন, ‘চোখে কখনো গামছা দিয়া, কখনো জম টুপি, এগুলা দিয়ে বাঁধা থাকতো। হাত কখনো সামনে, কখনো পিছনে। আর যখন বেশি মারবে, তখন হাত পিছনে দিয়ে রাখতো আর আমার কনুই গুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে খুব জোরে জোরে মারতো মোটা লাঠি দিয়ে’। আমি মনে করতাম যে, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু হাড় ভাঙছে এরকম বুঝি নাই। পর্যায়ে আমাকে বলল যে, তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলবো।

তিনি আরও জানান, তখন আমার এই কনুইয়ের এই গোশতগুলো এভাবে ঝুইলা রইছে। এই যে জামার মোটা হাতা, এটা টাইট হয়ে গেছিল, এই পরিমাণ ফুইলা ঝুইলা গেছে। এবং বলতেছে যে, ‘তোর হাত থেকে মাংস আলাদা করে ফেলবো। তো এরপরে দীর্ঘদিন বসে নামাজ পড়াও কষ্টকর ছিল। বলতেছে, ‘এভাবে হবে না। এরে লটকা। টানাইতে হবে।’ তো একজন এএসআই লোক হবে, ও আমাকে দুই হাতে রশি লাগায়া ওই যে ফ্যানের হুক থাকে ছাদের মধ্যে, এটার মধ্যে ওর রশি দিয়ে এরকম ঝুলাইলো। শুধু পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে আর পুরা শরীরটা ঝুলানো। হাত এখনও উঠাতে পারি না, আমার এটা দুইটা জোড়ার মধ্যে সমস্যা হয়ে গেছে। ‘হাত সম্ভবত গামছা বা কাপড় দিয়ে বেধেঁছে আর কি’। আমার হাঁটুর ভিতরে দিয়া হাত ঢুকাইয়া দুই হাঁটুর মাঝখান দিয়া লাঠি ঢুকিয়ে একটা উঁচু কোন স্ট্যান্ডের মধ্যে রাখছে। যে কারণে আমার পাগুলো উপরে ছিল। আর মাথা নিচু হয়ে গেছে। পায়ের তালুর মধ্যে এবার বাড়ি শুরু করছে। চিকন একটা লাঠি। আবার প্রথম থেকে একই প্রশ্ন, ‘নামগুলা বলো, তোমার সাথে কে কে আছে’।

‘এরপর চেয়ারে বসিয়ে গামছা খুলে চেয়ারের পিছনে দিয়া আবার হাতকড়া লাগাইছে। এবার হাঁটুর মধ্যে মারা শুরু করছে। আল্লাহর একটা কুদরত কি, যখন বাড়ি দিত, অনেক কষ্ট লাগতো, কিন্তু সাথে সাথে আবারই বাড়ি, অর্থাৎ ব্যথাটা দূর হয়ে যাইতো, সাথে সাথে ব্যথা দূর হয়ে যাইতো। মাগরিবের পরেই মনে হয়, কারেন্টে শক দিছিল আমার এই জায়গাটাতে। মাগরিবের নামাজ যখন পড়তে পাঠাইছে, ওই সময় দেখলাম যে, আমার হাঁটু কালো হয়ে গেছে আর কি। এমন মারা মারছে হাঁটুর ভিতরে। হাঁটুর কালো দাগ নিয়ে খুব কষ্ট হইতেছিল, এরপরও নামাজ পড়ছি। যেহেতু মুসিবতে পড়ছি, কি করার, নামাজ পড়ি’।

তার অফিস রুমের ভেতরে বাম সাইডে জানালা ছিল। একদিন আমার হাত জানালার সাথে বেঁধে, তারা আমার রান, তারপর পা, তারপর মেরুদন্ডের নিচ পর্যন্ত আমাকে পিটায়’। তারপর তারা আমাকে বলে যে, “তুই তো সন্ত্রাসী, তুই জঙ্গি।” তখন তারা আমাকে মেঝেতে ফেলে টর্চার করে। পায়ের গিড়া কিংবা পায়ের পাতায় তারা টর্চার করে। একবার না, কয়েকবারই তারা করছে।

ইলিক্ট্রক শকে শরীরের গোস্ত পুড়ে যেতো: আমার শরীরে হাফ হাতা গেঞ্জি ছিল, কলারওয়ালা। সেটা মাথার উপর দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দেয়। দিয়ে মুখের উপর অনবরত হাত দিয়ে ঘুষি মারছিল, দাঁত দিয়ে ওপরের ঠোঁটটা আমার কেটে গেছিল। তাৎক্ষণিক পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগায় দিল ... ফার্স্ট সেবার শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা। মনে হচ্ছে যখন শক দেয়, টোটাল শরীরটা আমার ফুটবলের মত গোল হয়ে যায়। এরকম আট দশবার আমাকে শক দিছে। শকটা হয়তো তিন-চার সেকেন্ড সর্বোচ্চ থাকে। তাৎক্ষণিক শরীরটা গোল হয়ে যায়, সমস্ত রগগুলো চেপে ধরে। তো ওই প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়, প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়। ..... খুবই বেপরোয়াভাবে চার-পাঁচ জন পিটানি শুরু করল, দুই হাত ধরে হুকের উপর লাগিয়ে দেয়। মনে হচ্ছে হয়তো কিছুতে সুইচ টিপছে, অটোমেটিক আমার শরীরটা উপরে উঠে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার কাপড় খুলে, আবার ওই একই ক্লিপ লাগায় দেয় আমার গোপন অঙ্গে। এবং ওই জিজ্ঞাসাবাদ সেম চলতে থাকে। যখনই সুইচ দেয়, আমার মনে হয়েছে যে, আমার সে অঙ্গগুলো পুড়ে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে আমি গোস্ত পুড়লে যেরকম একটা গন্ধ লাগে, সেই গন্ধটা পাইতাম আর কি। চার থেকে পাঁচ জন টোটাল বডিতে, আমার পা থেকে একেবারে গলা পর্যন্ত পিটাত। গরু পিটানের মত, সবদিক দিয়ে। মানে, কোন জায়গাতে আমার ফাঁকা ছিল না। আমি জেলখানাতে যাওয়ার পরে শরীরটা যখন দেখি, মানে এমন কোন জায়গা ছিল না, সব কালো হয়ে গেছিল।

দুই জনের নাম জানতে চেয়ে মেরে অজ্ঞান করা হয়: দুইজনের নাম জিজ্ঞেস করে বলছে এরা কোথায়? ‘আমি বলছি জানি না, স্যার, আমি জানি না।” যখন আমি কোন আওয়াজ করতে পারতেছি না, তখন আমি এতটুকু শুনতেছি, “মরে গেল কিনা, দেখ মরে গেছে কিনা।” একজন লাথি দিয়ে দেখতেছে, এর মধ্যে আবার চোখ খুলে আমি দেখতেছি, এমনে তাকায় রইছি। এর মধ্যে আমাকে কি করলো? গামছা দিয়ে পানি ঢাললো মুখে। “ কোথায় আছে, কোথায় আছে, বল, কোথায় আছে বল?” মানে আমাকে একটা সেকেন্ডও সময় দিতাছে না। ওরা কয়, “না, তোর বলতে হইব। এখন কোথায় আছে, কোথায় গেলে পাবো”?..... এরপর কারেন্টের শক দিয়ে আমাকে দাঁড় করাই রাখলো। গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখতো। আমি যাতে বসতে না পারি। দাঁড় করিয়ে রাখতো। পা এমন ফুলে গেছে আমার। আমার হাতে দাগ পড়ছে। ওয়াশরুমে যেতে চাইলে, ওয়াশরুমে যেতে দিত না। অত্যাচার শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যে একদিন এনে আঙ্গুলটাকে এভাবে প্লাস দিয়ে ধরছে। ধরার পরে টেবিলের উপরে হাত রেখে, প্লাস ধরে, আরেকজন সুঁচ ঢুকাইছে। এই যে সুইয়ের দাগ। কয়, “তুই আব্দুল মুমিন না?” “স্যার, আমি আব্দুল মুমিন না”। এরপর আমারে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির ভিতরে বসাইয়া চোখ বেঁধে ফেললো। হ্যান্ডকাফ পরাইয়া গালের মধ্যে জোরে একটা থাপ্পড় মারলো। মাইরা সিটের মধ্যে এরকম ফালাইয়া এনে রিভালভারে ধরে বলে, “একটা কথা কবি তো তোরে মাইরা বুড়িগঙ্গা নদীতে ফালাইয়া দিমু।” হাতের এখানে একটা ক্লিপের মত লাগাইয়া কোথায় জানি একটা সুইচ টিপে দিল। তারপরে আমি আর জানি না। যখন জ্ঞান ফিরছে, রাত্রি বাজে প্রায় একটার মতো।

আল্লাহর নাম নিলে আরও বেশি মারতো: আমাকে ওই হাঁটুতে, তারপর পায়ের তালুতে খুব পিটাইলো। আমি খুব কান্নাকাটি করতেছি। আল্লাহর নাম নিলে আরো বেশি মারতো। আমাকে মারার পরে জিজ্ঞেস করতেছে, “কি জন্য নিয়ে আসছি? তুই কি বলতে পারোস?” আমি বলতেছি যে, না। কি জন্য নিয়ে আসছেন, এগুলো তো কিছু বললেন না। কোনো ধরনের কথাবার্তা ছাড়া আমাকে শাস্তি দিতেছেন। আপনারা কে বা কারা?” তখন তাদের আর পরিচয় দিল না, বলল যে, “তুই অমুককে চিনিস, তমুককে চিনিস?” এই ধরনের কথা বলছে, যাদের সাথে আমার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নাই। যখনই তারা আসতো, তখনই আমি খুব ভয়ে কাঁপতে থাকতাম। আরেকদিন রিমান্ডে নিয়ে গেল, রাত্রে ১২টা বাজে। ওই সময় ইলেকট্রিক শক দিল। কানের মধ্যে দুইটা ক্লিপ দিয়ে ইলেকট্রিক শক দিতে থাকলো। তারপর আমাকে বলল যে, “তোকে তো অনেক পিটাইলাম, মারলাম। কিন্তু তুই তো কিছু বললি না। অমুকরে তো তুই ভালো করেই চিনিস। তাহলে অমুকে তোকে এই সমস্ত কাজে আনছে।” আর মুখে ভিজা কাপড় দিয়ে প্রায় দুই তিন মিনিটের মত পানি ঢালতো। ওই সময় দেখা যায়, আমি প্রায় সময়ই অজ্ঞান হয়ে যেতাম। তারা বলতেছিল যে, “তুই তো অনেক মেধাবী, তোর মেধাটা কিছু কমাই দিই। কানের মধ্যে ক্লিপ লাগায়া অনেকবার শক দিতো। এইভাবে মেধা কমানোর জন্য আমাকে কয়েকবার শক দিত, আর যখন শক দিত, পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যেত। সাথে সাথেই মনে হইতো যেন আমি শেষ। আমি চোখে ঝাপসা দেখতাম। এইভাবে দিনের পর দিন শাস্তি দিত।

ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্ট দেখে প্রশ্ন করা হতো: আমাকে ফ্রেন্ড লিস্টের কিছু নাম জিজ্ঞেস করে জানতে চায় এদের কাউকে চিনি না। তারপর আমাকে একটা নাম জিজ্ঞেস করে যে, “মেজর জিয়ার সাথে পরিচয় কত দিনের?” আমি বলি, “আমি তো আসলে নামটাই শুনছি প্রথম।” সত্যি কথা বলতে, আমি নামটাই শুনছি প্রথম। তো এই কথা বলার সাথে সাথেই আমাকে মাইর শুরু করে। মাইরের কারণে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। ওরা চারিদিক থেকে মারে আমাকে। আমার হাত পিছন থেকে হ্যান্ডকাফ পড়ানো ছিল, চোখ বাঁধা ছিল। আর চোখটা এমনভাবে বাঁধা যে, আমার মাথা ব্যথা হয়ে গেছে। ওই অবস্থায় মারার পরে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমাকে চেয়ারের সাথে বাধতো। বাঁধার পরে ওরা চার-পাঁচ জনের মত সাইডে থাকত। এটা বুঝতে পারতাম যে, চারদিক দিয়ে আমাকে পিটাচ্ছে। আর ইলেকট্রিক শক দিছে। ইলেকট্রিক শক দিলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম।

একদিন শোয়ানোর পরে আমার এই দুহাতের উপরে দিয়া আর ঘাড়ের নিচে দিয়া একটা বাঁশ দিছে। পরবর্তীতে পায়ের নিচে, রানের নিচে দিয়ে একটা দিল, আবার রানের উপরে দিয়েও একটা দিছে। দেওয়ার পরে এরা ওইভাবে আমাকে কিছুক্ষণ রাখছে, “বড় স্যার আসতেছে না দেখে।”পরে কিছুক্ষণ পরে সে আসছে। আসার পরে হঠাৎ করেই বললো, “এই উঠো।” বলার সাথে সাথে আমি মনে করলাম যে, আমি আর দুনিয়ায় নেই। এরকমের যন্ত্রণা আমার এই দুই হাতের বাহুতে শুরু হইছে, আর দুই পায়ের মধ্যে শুরু হইছে। আমার মনে হইতেছে কেউ আমার এই দুই হাতের আর পায়ের গোস্তগুলো ছিঁড়া ফেলতেছে। এত ভয়ংকর লোক জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার সাথে ছিল। আমি চিৎকার করতেছি জোরে। আমার যে হাতটা সাথে আছে, এটা আমি বলতে পারতাম না। এই হাত দিয়ে আমি খেতে পারতাম না। আমি শুধু তিন আঙ্গুল দিয়া যতটুক ভাত নিয়া খেতে পারতাম, ওটা খাইতাম। . . ‘মুখের উপরে গামছা দিয়া উপরে দিয়া পানি মারা শুরু করে দিছে। ভরতি পানি দেয়ায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাইতেছে’। তারপর ওরা ওই গামছা সরাইয়া বলে, “বল কি করছিস?” “স্যার, কি কমু? আপনি আমারে বলেন, আমার কি জানতে চান? আপনি আমারে কেন ধইরা আনছেন?” এরপর আবার আমার নাক-মুখ গামছা দিয়ে পেচিয়ে পানি ঢালা শুরু করে দেয়।