স্টাফ রিপোর্টার : ৩১ জুলাই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, আজকের দিনসহ আর মাত্র তিন দিন সময় হাতে আছে। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে সনদের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। আর প্রাথমিক পর্যায়ে ঐকমত্যের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের আলোচনার শুরুতে এ কথা বলেন আলী রীয়াজ। এদিনের আলোচনার বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান। এ ছাড়া অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়েও আজ আলোচনা হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন নিয়ে কমিশন নতুন করে প্রস্তাব হাজির করবে বলে জানিয়েছেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরায় আলোচনায় আসার পর কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নতুন করে কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেগুলোকে সমন্বিত করে তাঁরা একটা প্রস্তাব সবার সামনে হাজির করতে চাচ্ছেন।
আলী রীয়াজ বলেন, ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর মন্তব্যের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করবেন। তিনি আশা করেন, বিভিন্ন মন্তব্য সমন্বয় করে একটি চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করতে পারবেন। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেসব বিষয় ও মন্তব্যগুলো নিয়ে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সনদের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছাতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি।
আজকের আলোচনায় অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া।
আলোচনা শেষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে চায় বিএনপি। এ ছাড়া, সাংবিধানিক সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ হতে হবে নির্বাহী আইনে। আর জুলাই সনদের খসড়াকেও দেখছে ইতিবাচকভাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নীতিগতভাবে আমরা সবাই একমত। তবে গঠন পদ্ধতি নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। কমিশনসহ বিভিন্ন দলের পক্ষে একটি বাছাই কমিটির কথা হয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার থাকবেন। তাতেও সিদ্ধান্ত না হলেও ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল ৫ জন করে ১০ জন ও অন্যান্য দল ২ জনের নাম প্রস্তাব করবেন। এর মধ্যে চারজন প্রস্তাব করলে হবে। আর এখানেও সমাধান না হলে র্যাংকিং পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। আমরা এ জায়গায় একমত হতে পারিনি। আমরা চাই, এটি সর্বশেষ অপশন হিসেবে সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। সংসদে আলোচনা হবে। এ নিয়ে নাগরিকরা মতামত দিতে পারবেন। সভা-সেমিনার হবে। সেখানেও সমাধান না হলে আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনীর পক্ষে। তবে এক্ষেত্রে সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ থাকবে না। সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না বিএনপি। তিনি বলেন, সংবিধানকে আমরা আর ভারী করতে চাই না। আমরা মনে করি, আইনিভাবে হলে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদের খসড়ায় যে অঙ্গীকারের বিষয়ে বলা হয়েছে, আমরা একমত সেখানে। কোনও ভাষা বা শব্দগত সংশোধনী থাকলে আমরা দেবো। আর দুই বছরের বাস্তবায়নের বিষয়েও বিএনপি একমত। তিনি বলেন, দশ বছরের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকতে পারবেন না। সে প্রস্তাব প্রথম আমরা দিয়েছি। এত কিছুর পর স্বৈরাচারী শাসন কায়েম হবে তা মনে হয় না। এটি সবাই মেনে নিয়েছি। তাই আমরা সব বিষয়ে দ্বিমত সেটা বলা ঠিক নয়।
জুলাই সনদের খসড়াকে অসম্পূর্ণ এবং একইসাথে নির্বাচিত সরকারকে দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রস্তাবে বিপজ্জনক বলেও মনে করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এটি ‘অসম্পূর্ণ’ এবং কিছু অংশ ‘বিপজ্জনক’। আজকে তারা বলছে এটা একটা নমুনা মাত্র, ভুল হয়েছে। যদি সেটাই হয়, তাহলে মন্তব্যের দরকার নেই। তবে যদি সেটাই মূল কথা হয়, তাহলে একে গ্রহণ করা যাবে না। জামায়াত নিজস্ব একটি খসড়া সনদ তৈরি করছে এবং কমিশনে জমা দেবে বলে জানান আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। বলেন, ‘সংলাপে যেসব বিষয়ে একমত হচ্ছি, সেগুলো বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে।’
তিনি প্রস্তাব করেন, দুটি পথÑ ১. অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামো গঠন করে পরে নির্বাচিত পার্লামেন্টে তা অনুমোদন। ২. গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেয়া। ডা: তাহের বলেন, ‘আমরা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে এই কাঠামোকে আইনগত বৈধতা দিতে চাই।’ তিনি জানান, ‘তারা ঐকমত্যের পক্ষে, কিন্তু সেটা হতে হবে কার্যকর এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে।’ অন্যথায় দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ‘অনিশ্চয়তার দিকে’ চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে চলমান সংলাপে কেয়ারটেকার সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা একমত হয়েছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই হতে হবে, এখানে প্রায় সবাই একমত, একমাত্র বিএনপি কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।’
ডা: তাহের জানান, ‘প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবেÑপ্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের), এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। এরা ১২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্য থেকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান নির্বাচন করবেন।’
যদি একমত না হয়, তাহলে প্রথমে সর্বসম্মতভাবে, পরে এক চয়েস ভোট, তারপর প্রয়োজনে র্যাংক চয়েস ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। এই পদ্ধতিতে ভোটার হবেন মোট সাতজনÑউপরে উল্লিখিত পাঁচ সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতি।
ডা: তাহের বলেন, ‘বিচারপতি দু’জন যুক্ত করা হয়েছে যেন এককভাবে তৃতীয় দল বা অন্য কেউ ডিসাইডিং ফ্যাক্টর না হয়ে যায়। আমরা আশা করি বিচারপতিরা নিরপেক্ষ থাকবেন এবং হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কা কমবে।’ তিনি জানান, ‘বিএনপির আপত্তি মূলত এই যেÑযদি ঐকমত্য না হয়, তাহলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো হোক। তবে জামায়াতসহ অধিকাংশ দল মনে করে, সংসদে পাঠালে তা আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না।’
জামায়াতের এ নায়েবে আমির বলেন, ‘সংসদে পাঁচ-ছয়টা দল আছে, অথচ এই বডিতে ৩০টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। ’