প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গঠনে বিদ্যমান আইন ও প্রবিধানমালা পর্যালোচনার জন্য সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। এর মাধ্যমে সরকার ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের উদ্যোগ নিল। এর আগে পুলিশ সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে ১৫ দফা সুপারিশ করেছিল। সেই ১৫ দফা সুপারিশ ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এছাড়া স্বতন্ত্র ফৌজদারী তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সুপারিশ পেতে ওই কমিটি গঠন করা হলো। এই বিশেষজ্ঞ কমিটি ‘পুলিশ কমিশন’ এবং স্বতন্ত্র ফৌজদারী তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্যমান আইন ও প্রবিধানমালা পর্যালোচনার পর এ ব্যাপারে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করবে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই পাল্টে যাবে গোটা বাহিনীর অবয়ব।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ জুন গঠিত ৭ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (পুলিশ ও এনটিএমসি অনুবিভাগ)। আর পুলিশ-১ অধিশাখার যুগ্ম সচিবকে করা হয়েছে কমিটির সদস্য সচিব। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদ মর্যাদার), লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের একজন প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদা সম্পন্ন), জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-২ অধিশাখার যুগ্ম সচিব, সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদা সম্পন্ন) এবং পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো: আবুল কালাম আযাদকে।

সূত্রমতে, এই বিশেষজ্ঞ কমিটির ৯টি কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অধ্যাদেশ প্রণয়নের সুপারিশ, অধ্যাদেশের অধীনে প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়নের সুপারিশ, ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধনের সুপারিশ, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ও ১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধানমালা সংশোধনের সুপারিশ, অবকাঠামো, জনবল, বাজেট এবং আনুষাঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ এবং পুলিশকে জনবান্ধব ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক বাহিনী/প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য পুলিশ আইন, ১৮৬১ এর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন/পরিমার্জন অথবা নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ, বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকার সুরক্ষায় ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সুপারিশ, জনবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গঠনে পিআরবি, ১৯৪৩ এর পরিবর্তন/পরিমার্জন অথবা নতুন প্রবিধানমালা প্রণয়নের সুপারিশ এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের সেন্ট্রাল ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) হালনাগাদ কার্যক্রমের সুপারিশ প্রদান এবং সিডিএমএস এর আওতায় সংরক্ষিত তথ্যের বিষয়ে পর্যালোচনা ও সুপারিশ প্রদান করা।

এদিকে, গত ২২ জুন এক চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ পুলিশ সংস্কার কমিশনের ১৫ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে করণীয় বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণে পুলিশ সদর দপ্তরকে নির্দেশনা প্রদান করে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ সদর দপ্তর কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার কাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরকে চিঠি দিয়েছে সে আলোকে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, পুলিশ সংস্কার কমিশন সামগ্রিক বিষয় ধর্তব্যে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের বিষয়ে নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করে। প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন আইনের আওতায় অন্তর্ভূক্ত একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে নাকি সাংবিধানিক কাঠামোভূক্ত একটি প্রতিষ্ঠান হবে তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে হওয়া বাঞ্ছনীয়। এছাড়া পুলিশ কমিশন গঠন, কার্যপরিধি, সাংবিধানিক বা আইনি বাধ্যবাধকতা, আইনে অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন বিষয়াদি বিচার বিশ্লেষণ ও যথাযথ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা প্রয়োজন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

জননিরাপত্তা বিভাগের চিঠিতে ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদী বাস্তবায়ন তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। আর এটি বাস্তবায়নে কাজ করবে আইন ও বিচার বিভাগ, অর্থ বিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর।

কবে নাগাদ পুলিশ কমিশন গঠিত হতে পারে জানতে চাইলে জননিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, বিষয়টি আন্ত:মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিধায় আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য সময় নির্ধারণ হবে।

জানতে চাইলে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমরা পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ করিনি। পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়টি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখতে বলেছিলাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখতেই হয়তো বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে।

এদিকে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন একটি স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করেছিল সরকারের কাছে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তারা বর্তমানে পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত ফৌজদারি মামলা তদন্তের বাইরে একটি স্বতন্ত্র তদন্ত সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করেছিল। পুলিশ এই প্রস্তাবের জোরালো বিরোধিতা করে জানিয়েছিল স্বতন্ত্র সংস্থা গঠিত হলেও ফৌজদারি মামলার গুণগত মান যে বৃদ্ধি পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। এক্ষেত্রে পুলিশ সদর নানা যুক্তি তুলে ধরেছিল বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কাছে। কিন্তু কমিশন শেষ পর্যন্ত একটি স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করেছিল সরকারের কাছে। তাদের এই সুপারিশের ভিত্তিতেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আইন ও বিচার বিভাগ, অর্থ বিভাগ,স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস বাস্তবায়নে কাজ করবে। এটিও আন্ত:মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিধায় আলোচনা সাপেক্ষে বাস্তবায়নযোগ্য সময় নির্ধারণ করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।