জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী ৫ আগস্ট মঙ্গলবার গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিন বিকেল ৫টায় জাতির সামনে জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হবে। গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার পর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে এ কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি পোস্টে লেখেন, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। আগামী ৫ আগস্ট মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় গণঅভ্যুত্থানের সকল পক্ষের উপস্থিতিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।

এছাড়া গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিকেল ৫টায় গণঅভ্যুত্থানে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের উপস্থিতিতে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করা হবে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, ঘোষণার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।

এদিকে আগামী ৫ আগস্টের মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষিত হবে বলে জানান তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নিজের ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ কথা জানান। মাহফুজ আলম লেখেন, জুলাই ঘোষণাপত্র এখন বাস্তবতা। ৫ আগস্টের মধ্যেই ঘোষিত হবে ঘোষণাপত্র। ঘোষণাপত্র ইস্যুকে গণচেতনায় বাঁচিয়ে রেখে এটা বাস্তবায়নের পথ সুগম করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচিত বিষয় এই জুলাই ঘোষণাপত্র। অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে সম্প্রতি জুলাই ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন দলকে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের খসড়ায় ২৬টি দফা রয়েছে। প্রথম ২১ দফায় মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের মানুষের অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। পরের ৫টি দফায় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের আকাংখা, আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুম-খুন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধের দ্রুত উপযুক্ত বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। বহুল আলোচিত জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় বলা হয়েছে। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে। বিশেষ করে নির্বাচিত সরকারের সংস্কার করা সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই স্বীকৃতির উল্লেখ থাকবে। এ ছাড়া সংবিধানের তফসিলেও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ সংযুক্ত থাকবে। এ ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে। খসড়া ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের প্রতিষ্ঠিত বাকশাল বা একদলীয় শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহি জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় বলে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের কথা যেমন এতে উল্লেখ রয়েছে, পাশাপাশি এক-এগারোর ‘ষড়যন্ত্রমূলক বন্দোবস্তের’ কড়া সমালোচনাও ঘোষণাপত্রে আছে।

ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, পিলখানা ট্র্যাজেডি, শাপলা চত্বরে গণহত্যার মতো আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে।

অবৈধভাবে ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে (২০১৪, ’১৮ ও ’২৪) দেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে বলেও জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়, তথাকথিত উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের নেতৃত্বে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিগত পতিত দুর্নীতিবাজ আওয়ামী সরকার বাংলাদেশ ও এর অমিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এর পরিবেশ-জলবায়ু ও প্রাণবৈচিত্র্য বিপন্ন করে।

ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে, যা পরে ১ দফায় রূপান্তরিত হয়। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন দেন। তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে অবৈধ, অনির্বাচিত, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট (২০২৪) পদত্যাগ করেন এবং তিনি মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

সূত্র মতে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার লক্ষ্যে ছয়টি কমিশনের প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হয়েছে। গত ৩১ জুলাই এই সনদ তৈরি করার লক্ষ্য রয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষ হয়। গত সোমবার দলগুলোকে সনদের একটি খসড়াও দেওয়া হয়েছিল। তবে সে খসড়ায় সনদ বাস্তবায়নের যে পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কিছু দলের আপত্তি ছিল। গত বুধবার ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি তুলেছে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি।

গত বৃহস্পতিবা দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সবশেষ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ছিল সাতটি বিষয়। সেগুলো হলো ১. সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপদ্ধতি ২. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি ও ক্ষমতা ৩. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো ও নির্বাচনপদ্ধতি) ৪. রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি ৫. রাষ্ট্রের মূলনীতি ৬. সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ এবং ৭. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব। পুরোপুরি ঐকমত্য না হলেও সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ঐকমত্য কমিশন। আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে দলগুলোকে একটি ধারণাপত্র দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি, এমন কয়েকটি বিষয়ও সবশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

সূত্র মতে, গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেয়। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে আইনবিধি সংস্কার করে বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব, এমন অনেক সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। অন্যদিকে ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পৃথক আলোচনা করে কমিশন। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি, এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ৩ জুন থেকে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাবগুলোকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে ১৩টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথম পর্বে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার একটি তালিকা দলগুলোকে দেওয়া হয়। সেখানে মোট ৬২টি বিষয় এবং কোন প্রস্তাবে কয়টি দল একমত হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলোর বেশির ভাগই বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ রয়েছে ৬টি। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৮টি সুপারিশ ছিল। ৩০টি দল প্রথম পর্বে একমত পোষণ করে।

দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ১৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, এমন বিষয়ের মধ্যে রয়েছে এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান, হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত স্থানান্তর, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি, জরুরি অবস্থা জারিসংক্রান্ত, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; ইসি গঠনপদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করা হবে; পুলিশ কমিশন গঠন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছে, একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না, এ প্রস্তাবে তিন-চতুর্থাংশ দল একমত এবং সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব। এগুলোর মধ্যে সেসব বিষয়ে বিএনপিসহ যারা একমত হয়নি, তারা জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারবে।

সংরক্ষিত নারী আসন ২০৪৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০টি থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা এবং সেখানে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনার পর হ ঐকমত্য কমিশন ৫০টি আসন বহাল রাখা এবং ৩০০ সাধারণ আসনের মধ্যে ৫-৭ শতাংশ আসনে দলগুলো নারী প্রার্থী দেবে, এমন প্রস্তাব দেয়। পরে নারী আসন নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানান, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করার বিষয়ে প্রায় সব দল একমত হয়েছে, যদিও দু-একটি দলে এতে দ্বিমত রয়েছে। কিছু দল সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ১০০ আসনে উন্নীত করার পক্ষে, আবার কিছু দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের পক্ষে। সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলী রীয়াজ জানান, সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রাখা হবে। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে বিদ্যমান ৩০০ সংসদীয় আসনের জন্য প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। পরবর্তী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। এটিও সংবিধানে যুক্ত হবে।

আলী রীয়াজ জানান, কমিশন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বিষয়ে একটি সাধারণ ধারণাপত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে বিবেচনার জন্য দিয়েছে। কমিশন প্রস্তাব করেছে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই নিয়োগ দিতে পারেন।

সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জোরালো আপত্তি দিয়েছে বিএনপি। তারা এ সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে যুক্ত না করে আইনের মাধ্যমে নিয়োগ করার পক্ষে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে অর্থাৎ সারা দেশে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে তারা উচ্চকক্ষে আসন পাবে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল এই প্রস্তাবে একমত। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের এতে আপত্তি জানায়। উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কী হবে, তা নিয়েও মতভিন্নতা আছে। এমন পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে কমিশনকে একটি সিদ্ধান্ত দেওয়ার ভার দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রের মূলনীতি প্রশ্নেও দলগুলো বিভক্ত মত দিয়েছে। সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এরই মধ্যে একটি সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ সব দলের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। দলগুলোর উদ্দেশে আলী রীয়াজ বলেন, আপনারা যে দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা চেষ্টা করছি এসব বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছাতে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই জাতীয় সনদের একটি খসড়া দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, এই সনদের অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে অঙ্গীকার করবে রাজনৈতিক দলগুলো।

জানা গেছে, এ ঘোষণাপত্রে কী কী উল্লেখ থাকবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে। একই সঙ্গে সেটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে ভিন্নমত। সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে জুলাই ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি ও কার্যকারিতা চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ বিষয়ে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছিলেন, আমরা বাংলাদেশে নতুন একটি সংবিধান প্রত্যাশা করি। এনসিপি মনে করে, নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে, সেই নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনায় জুলাই ঘোষণাপত্র সংযুক্ত করতে হবে। সেই জুলাই ঘোষণাপত্র রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির জায়গায় জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যদিকে জুলাই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্তের বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘোষণাপত্রের পুরোটা না নিয়ে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের চেতনাটুকু ধারণ করে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চতুর্থ তফসিলে শুধু ‘জুলাই অভ্যুত্থান ২০২৪’ আনা যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। তখন কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতা শেষ। সেই ঘোষণাপত্র চতুর্থ তফসিলে এসে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, প্রতিটি আইন কিন্তু সংবিধানে উল্লিখিত নয়। বলা হলো, এটা তফসিলে থাকবে, এটাই লেজিটিমেসি (বৈধতা), স্বীকৃতি। তিনি আরও বলেন, ঘোষণাপত্র লিটারেচার হিসেবে, ডকুমেন্টারি হিসেবে আর্কাইভে থাকে, সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকে না।