ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসে গুমরহস্য। ১৬ বছর ধরে যে ঘটনা দেশে সব চেয়ে বেশি আতঙ্কের ছিল। গুম নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কারা গুমের সাথে জড়িত, কিভাবে কেন গুম করা হয়েছে এসব তথ্য মেলে গুম প্রতিবেদনে। শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার হয়েছেন ৭৩০ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ৮৩ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে। এসময় কয়েকজন গুম থেকে ফিরে আসলেও এখনো খোঁজ মেলেনি ৩৩০ জনের। ওই ব্যক্তিদের ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। গুমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বজায় রেখে সম্প্রতি ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে আজ ৩০ আগস্ট পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম হওয়া সব ব্যক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সনদ হিসাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স’ সম্মেলনে যে আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয় তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়। ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনে গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনের বছরগুলোয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় যা দ্বিগুণ ছিল। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৪৬৬ জনকে হত্যা করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এ বছরই সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ গুম হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশে সংগঠিত গুমের ঘটনায় পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি (গোয়েন্দা পুলিশ) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর মতো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সরাসরি জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। গুম-সংক্রান্ত ‘কমিশন অব ইনকোয়ারির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৭ শতাংশ গুমের ঘটনায় এই সংস্থাগুলো জড়িত ছিল। এমনকি, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং আদালতের সহযোগীর ভূমিকার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিণতি : গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছে। গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মইনুল ইসলাম চৌধুরী একথা জানিয়েছেন। এগুলো হলো- এক. গুমের শিকার ব্যক্তিকে হত্যা করা। দুই. বিচারের আগেই মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে জঙ্গি তকমা দিয়ে বাংলাদেশেই বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার দেখানো। তিন. তাকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে গ্রেফতারের ব্যবস্থা করা। চার. ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া। গুম কমিশনের ২য় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টা বরাবর জমা দেওয়ার পর আজ দুপুরে রাজধানীর গুলশানে গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারির কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ সব কথা বলেন। গুম কমিশনের সভাপতি বলেন, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও বহু অপরাধী ও তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস, অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানারকম ভীতিকর ও আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তবুও বহু ভুক্তভোগী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে সে কাহিনি তুলে ধরেছেন। গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারির সভাপতি আরো বলেন, বিগত সরকারের শাসনামলে গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ অভিযানের ছায়াতলে ইসলামি উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ছিলেন- মেধাবী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিক থেকে সাধারণ জনগণ। মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ প্রক্রিয়ায় তারা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়েছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করে এবং নির্যাতন ও গোপন আটকের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করেছিল। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছিল।

ফিরে এসেছেন তিনজন: ৮ বছর পর কথিত বন্দিশালা ‘আয়না ঘর’ থেকে মুক্ত হয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা নিজ নিজ বাসায় ফেরেন। আবদুল্লাহিল আমান আযমী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মরহুম গোলাম আযমের ছেলে। আর আহমাদ বিন কাসেম দেশের সনামধন্য শিল্প উদ্যোক্তা স্বৈরশাসনের রোষানলে পড়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ছেলে। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট আহমদ বিন কাসেম (আরমান)কে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এবং এর কয়েকদিন পর ২৩ আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয়। এছাড়াও ৫ বছরেরও বেশি সময় নিঁখোজ থাকার পর ফিরে এসেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা, সাবেক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ল্যাফট্যান্টে কর্ণেল হাসিনুর রহমান বীর প্রতীকসহ আর কয়েকজন।

না ফেরা স্বজনদের আকুতি: হাসিনা সরকারের পতন, আয়না ঘরের সন্ধান এবং কিছু মানুষ গুম থেকে ফেরে আসার পর অনেকের মনে আশা জেগেছিল প্রিয় জন হয়তো ফিরে আসবে। হয়তো গুম হওয়া মানুষটিকে দীর্ঘ দিন পর ফিরে পাবে স্বজনরা। কিন্তু তা হলো না। রাষ্টীয় বাহিনীর বন্দিশালা আয়না ঘরে কয়েকজনকে পাওয়া গেলেও অনেকেরই খোঁজ মেলনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। যার ফলে সেবব নানুষেল স্বজনরা আবারও হতাশ হয়েছেন। আবার তারা রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। একটি মানবন্ধনে এভাবেই আকুতি জানা শোনা যায়- ‘আমরা বিচার পাচ্ছি না। আমাদের জন্য কোনো দেশ স্বাধীন হয়নি। আমরা তো আমাদের বাবাদের ফেরত পাইনি। আমাদের এখনো কেন এভাবে দাঁড়াতে হয়? আয়নাঘরে কোনো লোক নেই, তাহলে ওই লোকগুলো কই? আমাদের বাবারা, আমাদের চাচ্চুরা কোথায়? তাদের এভাবে মেরে ফেলতে পারে না। ’রাজধানীর হাইকোর্টের মাজার গেইটের সামনে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিল গুমের শিকার বংশাল থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃদি। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ থেকে যখন পারভেজ হোসেন নিখোঁজ হন, তখন তার মেয়ে হৃদির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। ছোট্ট সেই শিশুর বয়স এখন প্রায় ১৪ বছর। কিন্তু এখনো বাবাকে খুঁজে পায়নি সে। পায়নি বিচারও। তাইতো গুম সংক্রান্ত কোনো অনুষ্ঠান হলেই বাবার ছবি হাতে সেখানে ছুটে যায় হৃদি। অবস্থান কর্মসূচিতে হৃদি বলছিল, ‘আমরা বিচার চাই। আমার ভাইটা তো বাবাকে দেখেইনি। আমি শুধু আমার বাবাকে ফেরত চাই। ’ ‘বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর অভিযুক্ত কর্মকর্তা এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের’ দাবিতে এই অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে ‘মায়ের ডাক’। অবস্থান কর্মসূচিতে গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনই একজন লক্ষ্মীপুরে গুমের শিকার ওমর ফারুকের ছেলে ইমন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে আমার বাবাকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার আট মাস অতিবাহিত করলেও আমাদের স্বজনদের সন্ধান দিতে পারেনি। আমাদের একটাই দাবি, যেসব কর্মকর্তারা গুম-খুনের অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের দ্রুত অপসারণ করতে হবে। যদি তাদের চাকরিচ্যুত করা না হয়, তাহলে আমরা নিরাপদ নই, আমাদের পরিবার নিরাপদ নয়। আমরা চাই যেসব কর্মকর্তারা গুম-খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। তাদের বিচার করা হোক। বিচারের সময় এখনই। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে। এরপর থেকে আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, গত ১৩ বছর ধরে আমরা রাস্তায় আছি। কিন্তু খুবই বিস্ময় ও আশ্চর্যের ব্যাপার আজকেও আমাদের দাবি আদায়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে। এর থেকে লজ্জার কথা আর কিছু হতে পারে না।