লাবিব মুহান্নাথ। জুলাই অভ্যূত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলনে রয়েছে তার পদচারণা। তবে উত্তরায় জুলাই আগস্টের আন্দোলনের চরম মূহুর্তে তার ভূমিকার প্রশংসা সবার মুখে মুখে। সেই গল্প বলেছেন দৈনিক সংগ্রামকে। অনুলিখন ইবরাহীম খলিল।
২ জুলাই সন্ধ্যায় উত্তরাতে বসে প্রসঙ্গ উঠতেই বলা শুরু। বিরামহীন বলে চলা। মজার ছলে তিনি চলে বলেছেন। আমরা কয়েকজন শুনছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষার্থী এবং নারীদের ওপর নির্মম হামলার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির তিনি। উত্তরা থেকে ঢাকাতে গেছেন জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হবেন কি হবেন না তা বোঝার জন্য। কারণ উত্তরার স্কুল-কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশের সাথে তার উঠা-বসা। সেদিন দুইটা কি আড়াইটার দিকে ঢাবির ছাত্রলীগের সৈকত এবং হাবিবের অনুসারীরা বিশাল অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। আরেকদিক থেকে সবাই দৌড়ে চলে যাচ্ছে। আমরা ছিলাম শেষ লেয়ারে। আমরা ফাইট করছি। ওদের চেয়ে না হলেও আমরা তিশ’গুণ মানুষ। ওরা যদি দ্ইু শ’ হয় আমরা ছয় হাজার মানুষ। তারপরও দৌড়ে চলে গেছে একটা অংশ। আমি যখন পেছনে তাকাই তখন দেখি আমার পেছনের দুইটা লাইন হলো মেয়েদের। মনে মনে ভাবলাম আজকে মাইর খাইছি। তখন আমিও দৌড়াচ্ছি। দৌড়াতে দৌড়াতে ভিসির দপ্তরের কাছে যেতে যেতে আমার পিঠে দুইটা লাঠির আঘাত পড়ে। ভিসি দপ্তরের সামনে দুইটা লাল বাস দাড়ানো ছিল। যখন পিটুনি খেয়ে ফেলেছি তখন মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে যায়। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে লাল বাসে উঠলাম। তখনো ভাবছি আজকে আমি শেষ। কারণ ছাত্রলীগ অবশ্যই লালবাসে আক্রমণ করে। আমি দেখি ছাত্র লীগ চারটা মেয়েকে লাঠি দিয়ে বুক বরাবর গোঁতা দিচ্ছে। তখন যাকে দেখছে তার ওপর আক্রমণ করছে। মেয়েদের এরকম অপমান করছে আর ছেলেদের পেটাচ্ছে। আমি গিয়ে লাল বাসের সিড়ির নিচে যে ফাঁকা জায়গাটা অন্ধকার থাকে সেখানে আশ্রয় নিলাম। এবং শুয়ে পড়লাম। ছাত্রলীগের ছেলেরা বাসের সব চেক করলেও ওই জায়গাটা চেক করেনি। এরপর ২০/৩০ মিনিট পর একটা মিছিল আসে। তখন আমি বের হয়ে যাই। আমার মনে খুব রাগ তৈরি হয়। কারণ অনেক আন্দোলন করেছি কিন্তু কোন আন্দোলনে মাইর খাইনি। কারণ আমার স্ট্রাটেজির কারণে বার বার আমরা জিতে যাই।
আজীবন ছাত্র লীগ পিটিয়েছি। কোনদিন মাইর খাইনি। এবার ঢাবিতে গিয়ে মার খেলাম। ওই দিন যখন ছবি তুলতে গেছে তখন আমি মুখে হাত দিয়ে রেখেছি লজ্জায়। ঢাবির বিবিএর একটি ছেলে আমাকে আজিমপুর নিয়ে যায়। সেখানে আমার প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। এরপর ঢাকা মেডিকেলে যাই সিএনজিতে করে। সেখানে গিয়ে দেখি এদিকে ওদিকে দুই দিকেই ছাত্রলীগ। আমরা ছয়জন সেখানে আটকা পড়ে যাই। আমাদের চারজনের হাতে আবার লাঠি ছিল। আমি চার জনকে বলি তোমরা তাদের গ্রুপে ঢুকে যাও। কথা মতো তারা ছাত্র লীগের সাথে মিশে যায়। তখন আমরা দুজন মাঝখানে পড়ে যাই। তখন দেখি বকশিবাজারের দিক থেকে একটা বড় গ্রুপ আসছে ছাত্রলীগের। তখন আমাদের সামনে সিএনজি দেখি। সাথে সাথে সিএনজিতে উঠে পরি। প্রথমে সিএনজি ড্রাইভার শাহবাগে পরে সচিবালয়ের সামনে নামিয়ে দেয়। ততক্ষণে বিকাল হয়ে যায়। সেখান থেকে মেট্রোতে উঠি। এবং এক কোনায় বসে আছি। চোখে আমার কালো চশমা। আমার অবস্থা দেখে একজন ইশারাতে জানতে চাইলো ‘তাহলে মাইর খাইছো!’ আমি ইশারায় জবাব দেই ইয়েস। আমি যখন মেট্রোরেল থেকে মিরপুর নামি তখন দেখি পশ্চিম দিকে আকাশে একদম লাল আভা ধারণ করেছে। আমি আরাফকে বলি আমরা জিতবো। শিউর। হাদিসে আছে আল্লাহ তায়ালা যখন ক্ষমতার পরিবর্তন করেন তখন আকাশে লাল আভা ধারণ করে। সিরিয়াতেও এমনটা ঘটেছিল। সেদিন বাসায় গিয়ে রাতে একটু বিশ্রাম নেই। চোখের নিচে পিটুনি এমনভাবে লেগেছে যে আরেকটু হলে আমার চোখ চলে যায়। বাসায় যাওয়ার পর রাজউকের কিছু ছেলে আমাকে নক দেয় যে, কালকে আমরা নামবো। আপনারা থাকলে আমরা সাহস করতে পারি। আমি তাদের বলি আমরা আন্দোলন করবো আর আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে আরেকজন রাজনীতি করে দিবে সেটা হতে দিতে চাই না। প্রথম কথা বা শেষ কথা হলো উত্তরাতে কোন জুনিয়রের ওপর ছাত্রলীগের আক্রমণ হতে দিই নাই। ছাত্র লীগ ২০১৮তে মাইর খেয়েছে ২০২০ এ মাইর খেয়েছে। ২০২৪ এর ১৬ তারিখেও আমরা ছাত্রলীগকে মাইর দিয়ে শুরু করেছি। পরের দিন টঙ্গিতে শিবিরের সাথে কথা হয়। আমরা প্ল্যান করি যে যদি মিল্লাতের ত্রিশজন থাকে তাহলে রেডিক্যাল হবো নয়তো মানববন্ধন করে চলে আসবো। কথা অনুযায়ী কাজ। সোহেল নামের একজন আছে মিল্লাতে। তাকে নিয়ে রেকি করলাম। কোন দিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগ বসে আছে। ১৬ তারিখে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা উত্তরার বিএনএস সেন্টারের দিক দিয়ে বের হবো না। বের হবো আজমপুর দিয়ে। আমরা তখন ৫০ থেকে ৬০ জন। সিদ্ধান্ত হয় যে আমরা ডিভাইডারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবো। সবাই তখন বলে না আমরা মাঠ দখল করে ফেলবো। ততক্ষণে দেখলাম আমাদের মানুষ বাড়ছে। আমাদের মধ্যে এমন ভাব যে কেউ প্রেমে ছ্যাকা খেয়েছে। আবার কেউ বাবা মায়ের সংসারে বোঝা হেেয় বসে আছে। সবার মত যে মরে গেলে কারো কোন আফসোস থাকবে না। তখন আমরা নতুন রাস্তা থেকে বাঁকানো রড সংগ্রহ করি। মারলে যেন গলা বরাবর কাবু হয়ে যায়।
রাস্তার দুই পাশে থাকার কারণে লোকজন কম দেখাচ্ছিল তাই ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের লোকজন আমাকে দেখেই ‘ওকে ধর’ বলে আওয়াজ দেওয়ার সাথে সাথে আমার সাথে থাকা লোকজন ওকে ধরে মারতে মারতে আধ মরা বানিয়ে ফেলে। সেদিন পেছন থেকে আইইউবিএটির শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে আসে। আমরা জানতাম যে বিশাল সংখ্যক লোকজন আসছে। আমরাও এগিয়ে যাই। এরপর ওরা একদম দৌড়ে পালিয়ে যায়। সেদিনের মতো অর্থাৎ ১৬ তারিখের মতো মাঠ আন্দোলনকারীদের দখলে। এরপরদিন ১৭ তারিখ মহররম ছিল। সেদিন রক্তপাত নিষিদ্ধ থাকায় আমরা আর কিছু করিনি। ১৮ তারিখে ছেলে পেলেরা দাঁড়াতেই পারেনি। আগেই সাউন্ড গ্রেনেড ফাটানো হয়। আসলে সাউন্ড গ্রেনেড ফাটালেই জনগণ বুঝে যায় যে আন্দোলনের সময় এসেছে। জনগণ হুট করে মাঠে চলে আসে। প্রথমে ছেলেরা গলিতে থাকে। সাউন্ড গ্রেনেডের সাথে সাথে ৪ হাজার হয়ে যায়। সেদিন দুপুর ১টা পর্যন্ত খবর পাই ৮জন মারা গেছে। আমরা তখন বলি এটা গুজব। কুয়েত মৈত্রি হাসপাতালে যখন যাই তখন দেখি ৪টা লাশ পরে আছে বাথ রুমে। তখন আমি ওদের জানাজা পড়াই। যখন দেখলাম মারা গেছে তখন আমি নারায়ে তাকবীর সোøাগান দেওয়া শুরু করি। আমরা নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিতে থাকি। তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করি। আমরা ১৭ তারিখ রাতে প্ল্যান করি যে পরের দিন যদি দেখি যে, আন্দোলনে আমরা হেরে যাচ্ছি, তাহলে হেরে যাওয়া যাবে না মবের দিকে মুভ করতে হবে। আমি আর রাফি প্ল্যান করি যে আমরা মসজিদগুলো দখলে নিবো এবং মাইকিং করবো যে আমাদের ওপর পুলিশ অ্যাটাক করছে আপনারা সবাই ঘর থেকে বের হন।
দুপুরের দিকে যখন এদিক দিয়ে অ্যাটাক হচ্ছে আরেফীন রাফিকে আজমপুরে ঢুকিয়ে দেই। এর আগে সকাল বেলা আরেফীন রাফি বাইকে পেেেট্রাল ফুল করে নিয়ে আসে। পরে দোকানিদের কাছ থেকে স্যাডলনের কাঁচের বোতল সংগ্রহ করা হয়। দুপুর ২টার দিকে র্যাব এ্যাটাক করে। একজনকে ফিট করি যে র্যাবকে লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা মেরে দিবে। ও গিয়ে দুটা মেরে দিয়েছে। এতে রাস্তায় আগুন ধরে যায়। র্যাব তাতে পিছনের দিকে সরে আসে। এসময় ছেলেরা র্যাবকে আটকে ফেলে। তখন র্যাব উপরে হাত তুলে আত্ম সমর্পন করে। তখন তারা বলে আমাদের বাচ্চা কাচ্ছা আছে আমাদের ছেড়ে দাও। ছেড়ে দেওয়ার পর নিরাপদ স্থানে গিয়ে গুলি করা শুরু করে। রাফি যখন বুঝতে পারে যে এরকম হয়েছে তখন মসজিদ দখলের পরিকল্পনা করে। মসজিদে গিয়ে মুয়াজ্জিনেেক বলে যে আমরা একটা ঘোষণা দেবো। মুয়াজ্জিন রাজি না হলে হুমকি দেয় যে ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটন হবে এই মসজিদ থেকে। মাইকে ঘোষণা দেয় যে, এখানে গোলাগুলি হচ্ছে আমাদের বাঁচান। বিকালে দেখলাম অনেকগুলো লাশ। আমরা ভাবছিলাম এতোগুলো লাশ হয়তো লুকিয়ে ফেলা হবে। ১৮ তারিখে মূলত ৩৮ লাশ পাওয়া গেছে। আরেফীন রাফি বলে এবার বলো লাশগুলোর কি করা যায়। আমি বলি যে চলো ৬ নস্বর মসজিদে যাই। তখন মাগরিবের আজানের ১০ মিনিট বাকী। মুয়াজ্জিনের কাছ থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে বলা হয়, আজ আমাদের ৩৮জন ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দেখি নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে আজান দেয় না। জিজ্ঞেস করি আজান দিবেন না ? মোয়াজ্জিন বলে না। সভাপতি না করেছে। তখন আরেফীন রাফি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, এখন কি করবো? আমার তো ভয় লাগছে। ১৮ তারিখ উত্তরা ছাত্রদের দখলে ছিল তখনো জনতা আসেনি। ১৯ তারিখ উত্তরা জনতার দখলে আসে। সেদিন ৯০ ভাগ জনতা ১০ ভাগ ছাত্র ছিল। সেদিন বিএনপি নেমেছে, জামায়াত নেমেছে অন্যরাও নেমেছে। সেদিন জাহাঙ্গিরের পিএসকে মেরে ফেলে জনতা। সেদিন পুলিশ নৃশংসভাবে গুলি করে। সেদিন ৭ নম্বরের রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। পুলিশের গুলিতে মাথার মগজ বের হয়ে গেছে এমন লাশও দেখেছি।
২০ তারিখ দেখি মাত্র ৫ জন মানুষ রাস্তায় নেমেছি। একটা কাকপক্ষিও উত্তরার রাস্তায় নেই। সেদিনের অবস্থা হলো দুই তিনজন মানুষ রাস্তায় বের হলেও টিয়ার গ্যাস মারা হচ্ছিল। এই সময়ে দুই তিনদিন আমরা বিশ্রাম নেই। ২৪ তারিখ শুনি আমার নামে মামলা হয়েছে ্উত্তরা পশ্চিম থানায়। তখন আমি গাজিপুর চলে যাই। ২৬ তারিখ আমি আবার ঢাকাতে আসি। ২০-২২ জন ছিলাম। সেদিন আবার ছাত্রলীগ আমাদের ধাওয়া দেয়। সেদিন আর নামতে পারিনি। আমি চলে যাই গাজীপুর আর আরেফীন রাফি চলে যায় বসুন্ধরায়। ২৮ তারিখ আবার নামার প্ল্যান করি। এরপর ২ আগস্ট প্লান করি যে, আমরা সবাই বিএনএসে থাকবো। সেদিন সকালে রাজউকের ছেলেরা আন্দোলন করে। এরপর ১১ নম্বর সেক্টরে নামার প্রস্তুতি নেই। এরপর ছাত্রলীগকে আমরা পিটাই। কারণ ছাত্রলীগ আমাদের ছোটভাইদের মারবে এটা মেনে নেওয়া হবে না। ৪ তারিখ অনেক মারামারি হয়েছে। উত্তরা দখল হয়ে গেছে। ৫ তারিখ সকালে গোছল করে বের হবো ভাবছিলাম বাট আমি বের হইনি। পরে দুই রাকাত নফল নামাজ পরে বের হই। তখন শাহেদ নামের একজনের সাথে দেখা হয়। আমরা পরস্পরের সাথে কথা বলি। আমি তাকে বললাম যে আমার এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা ঋণ আছে মরে গেলে বলে দিস। তখন সে বলে আমি বেচে থাকলে তো। আমারও ৩৫ হাজাার টাকা ঋণ আছে। তখন আমরা দোকানদারকে বলি যদি মরে যাই বলে দিবেন এক লাখ ৩০ হাজার লাবিবের আর ৩৫ হাজার শাহেদের ঋণ আছে। তাহলে সবাই বুঝে নিবে। তখন উসামা বিন হোসাইন নামে শিবির থেকে একটা ছেলে এলো। ও এসে ৩শ’টার মতো লাঠি আমাদের সবার হাতে দিলো। তখন সবাই মিলে রাস্তায় বের হই। আমি শাহেদকে বলি যে গুলি খেলে মাথার মধ্যে খাবা যাতে স্পট ডেড হই। কারণ মাথায় গুলি খেয়ে মরা সহজ। কষ্ট কম হয়। পঙ্গু হলে জীবনভর কষ্ট। আমরা দৌড়ে রাজউকের সামনে গেলাম। দাড়িয়ে বললাম আল্লাহ আজকে বদর না তবুও আজকে তিনশ’জনই আছি। ওরা যতজনই হউক আমাদের জিতিয়ে দিও। আমরা রাস্তায় উঠলাম আর মনে হলো হুট করে পঙ্গপাল ঢুকলো। দেখলাম এতো মানুষ কত্থেকে আসলো! কয়েকহাজার মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। আমি তখন কিছুটা ঢিল দিলো আর হাজার হাজার মানুূষ ঢাকার দিকে ছুটতে শুরু করলো।