বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকারি হিসেবে জুলাই বিপ্লবে সারাদেশে অন্তত ৮৩৪ জন ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন। এই সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আলিয়া মাদরাসার ও কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও ছিল মাঠে। ঢাকার তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসা থেকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ৫ জন শহীদের তালিকা পাওয়া গেছে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত ৫জন শহীদ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এরমধ্যে ৩ জন টঙ্গী শাখার, ২ জন যাত্রাবাড়ী শাখার ছাত্র ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন গর্বিত শহীদ মো. ওসমান পাটোয়ারী (২২)। ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে শহীদ ওসমান পাটোয়ারী সহ চার শিক্ষার্থী নিহত হন। শহীদ ওসমান পাটোয়ারী রায়পুর উপজেলার চরমোহনা ইউনিয়নের দক্ষিণ রায়পুর গ্রামের পাটওয়ারী বাড়ির ছেলে। শহীদ মো. ওসমান পাটোয়ারীর পিতার নাম মো. আবদুর রহমান। তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, টঙ্গী শাখার আলিম শ্রেণির ছাত্র শহীদ ওসমান। ৪ আগস্ট ২০২৪ রোববার লক্ষ্মীপুর শহর (তিতা খাঁ মসজিদ রোড) ছাত্রলীগ যুবলীগের সন্ত্রাসীরা ও পুলিশ যৌথভাবে আক্রমণে শরীরে ৫৫ গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি।

জুলাই বিপ্লবে অংশ নিতে মায়ের কাছে আকুতি: ‘আম্মু তুমি অনুমতি দাও। আমার মন বলে, হৃদয় বলে-আমরা গেলে এই সরকারের পতন হবেই হবে, বিজয় হবেই হবে ইনশাআল্লাহ। তোমরা যদি আমাদের আটকে রাখো, তাহলে দেশ থেকে কীভাবে অন্যায় দূর হবে? কীভাবে পরিবর্তন আসবে? ঘরে বসে থেকে আমি কাল কিয়ামতের মাঠে কী জবাব দেব? তোমরা কী চাও না শহীদের মা-বাবা হতে আম্মু? শহীদের মর্যাদাই বুঝলে না? তোমাদের ঈমানের ঘাটতি আছে এখনো। আমাকে তুমি আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিয়ে দাও। আল্লাহ যেন আমাকে আজকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন। আমাকে কিছু টাকা দাও, যাওয়ার সময় আমার ভাইদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে যাব।’

৩ আগস্ট রাতে ও ৪ আগস্ট ২০২৪ সকালে এসব বলেই শত বাধা অতিক্রম করে মাকে বুঝিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার অনুমতি নেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথীপ্রার্থী মো. ওসমান পাটোয়ারী (২২)। মা রেহানা আক্তার কোনোভাবেই ছেলেকে বোঝাতে না পেরে অনুমতি দিলেও ওসমানের বাবা মো. আবদুর রহমানকে বিষয়টি জানান। বাবা ফোনে বোঝানোর চেষ্টা করতেই ওসমান বলেন, ‘বাধা দিও না। আব্বু তুমি আমারে মাফ করে দিও, আমি আজকে যাব। আমার ভাইরা শহীদ হচ্ছে, আমাকে বাধা দেবে না।’ কথাগুলো বলেই ওসমান ফোন কেটে দেন বলে জানিয়েছেন তার বাবা আবদুর রহমান। এরপর ৪ আগস্ট সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন মো. ওসমান পাটোয়ারী। বাবা আবদুর রহমান নির্বিকার হয়ে তখন শুধু ঢাকার বাসা থেকে সন্তানের জন্য দোয়া করছিলেন। ওসমানকে ছেড়ে দিয়েছেন আল্লাহর হেফাজতে। এরপর সেদিন বিকালে লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে পূর্ণ হয় ওসমানের শহীদি তামান্না।

মিল্লাত মাদরাসার মেধাবী ছাত্র ওসমান পাটোয়ারীর দ্বীনের দায়ী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না: তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার সাবেক শিক্ষার্থী ওসমান পাটোয়ারী ছিলেন খুবই মেধাবী। দাখিল-আলিম দুটোতেই পেয়েছেন জিপিএ ৫। স্বপ্ন দেখতেন দ্বীনের দা’য়ী হওয়ার। সে জন্য আবেদন করেছিলেন মাদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী ওসমান সব সময় ছিলেন প্রতিবাদী। এতটাই প্রতিবাদী ছিলেন, বাবা-মায়ের করা ভুলকেও বিনয়ের সঙ্গে ধরিয়ে দিতেন। শেখ হাসিনার জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন সব সময়ই। জুলাই বিপ্লবের শুরু থেকেই ওসমান লক্ষ্মীপুর দক্ষিণ রায়পুরের নিজ বাড়িতে ছিলেন। এক হাত ভাঙা থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনে অংশ নিতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু শেখ হাসিনার গণহত্যার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতাকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন ওসমান। কিন্তু তাতে কোনোভাবেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি তিনি। ৩ আগস্ট ২০২৪ রাতেই সরকার পতনের আন্দোলনে যাবেন জানিয়ে ছোট বোন আমেনা আক্তার ওহীকে বার্তা দিয়েছিলেন, ‘ভাইয়ার জন্য দোয়া করিও। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। মরে গেলে মাফ করে দিও। কিছু হলে পরিবারের প্রতি খেয়াল রাখিও। আম্মু-আব্বুর কাছে থাকিও। কিছু বলা যায় না। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দোয়া করিও। আল্লাহ হাফেজ।’

আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ভাঙা হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেন ওসমান এ যেন হামাস নেতা আরেক ইয়াহিয়া সিনওয়ারের গল্প: জুলাই বিপ্লবে যাওয়ার জন্য ভাঙা হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেন আগেই। ৪ আগস্ট সকালে মাকে বুঝিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ও বাবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নেন তিনি। এরপর ১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন ওসমান পাটোয়ারী। তিনি প্রতিবেশী ইয়াসীন আরাফাত ও জিহাদুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কয়েকটি বাধা পেরিয়ে এগোতে থাকেন আন্দোলনস্থল বাগবাড়ীর উদ্দেশে। সরকার পতনের আন্দোলনে লক্ষ্মীপুর জজ কোর্টের সামনে গিয়ে ছাত্র-জনতার সঙ্গে যোগ দেন তারা। তখনো লক্ষ্মীপুর শহরের গলি ও প্রবেশদ্বারগুলোয় দেশি-বিদেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবস্থান নিয়েছিল আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। একপর্যায়ে আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা করে। এ সময় সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করতে গেলে লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী সা’দ আল আফনান গুলিতে শাহাদতবরণ করেন। আফনানের শাহাদাত ওসমানসহ লক্ষ্মীপুরে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই ভাঙা হাতে লাঠি তুলে নেন ওসমান। এরপর তারা ইটপাটকেল ও লাঠি নিয়ে লড়াই করে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের লক্ষ্মীপুর শহর ছাড়তে বাধ্য করেন। এ লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা। ছাত্র-জনতার তোপের মুখে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গিয়ে একত্র হয় সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাহউদ্দিন টিপুর বাড়ির আশপাশে।

শহীদ ওসমানের সেই দিনের সাহসী ভূমিকার জন্য অনেক লাশ গুম হওয়া থেকে বেঁচে যায়: সেদিনের আন্দোলনে ওসমান সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন বলে জানিয়েছেন জুলাই বিপ্লবে সহযোদ্ধা ইয়াসীন। তিনি জানান, ওসমান সেদিন কখনো গুলিবিদ্ধ ও আহতদের মেডিকেলে নিতে সহযোগিতা করেছেন, আবার কখনো মায়ের কাছ থেকে আনা ১ হাজার ৫০০ টাকার খাবার বিতরণ করেছেন। কখনো বা সাহস জোগাতেন সহযোদ্ধাদের। সবশেষ ওসমানকে তিনি দেখেছেন একজন গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীকে বলতে, ‘ভাই কিছু হবে না, সাহস ধরে রাখেন। আশপাশে থাকা আন্দোলনকারীদের সাহস জোগাতে সেদিন ওসমান একটু পরপরই বলতেন, ‘আমরা সংখ্যায় বেশি। সাহস হারানোর কিছু নেই। আমরা পারব।

সঙ্গী জিহাদরা সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে চাচ্ছিলেন। তখন জিহাদ ও ইয়াসীনকে কিছু টাকা দিয়ে ওসমান বলেন, ‘আমি বিজয় নিয়ে বাড়ি ফিরব, তোরা চলে যা।’ তাদের বিদায় দিয়ে আবার টিপুর বাড়ির সামনের দিকে যান ওসমান। এরপর আর ওসমানের সঙ্গে দেখা হয়নি ইয়াসীনদের। কিছুক্ষণ পর ওসমানের নম্বরে কল করে জানতে পারেন তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এরপর ইয়াসীন, ফরিদ ও আবুল কালামরা লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন ওসমান টিপুরা গুলিতে শাহাদতবরণ করেছেন। শহীদ ওসমানসহ আরো দুই শহীদের লাশ তখন লুকিয়ে রাখা হয় একটি বারান্দায়। লাশ দিতে রাজি ছিল না সেই বাড়ির লোকজন। এ সময় লাশ গুম হওয়ার শঙ্কা কাজ করছিল ইয়াসীনদের মনে। পরে সেখানে থাকা গার্ড অন্যত্র যেতেই শহীদের লাশ নিয়ে দ্রুত বের হয়ে যান ইয়াসীন-ফরিদরা। তখন ওসমানের পিঠে, হাতে ও মাথায় অনেক গুলির চিহ্ন দেখতে পান তারা।

এদিকে ছেলের শহীদ হওয়ার খবর পেয়েছেন শহীদ ওসমানের বাবা আবদুর রহমানও। কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি তার একমাত্র মেয়ে ওহীকে নিয়ে সন্ত্রাসীদের ভয়ে ছদ্মবেশে কেরানীগঞ্জের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন ওসমানকে শেষ বিদায় জানাতে। বাড়িতে গিয়ে দেখেন ওসমানের শরীর গুলিতে ঝাঁজরা হলেও তার মুখে মুচকি হাসি লেগে আছে। পরে চিকিৎসক অরূপ পাল শহীদ ওসমানের বাবাকে বলেছিলেন, ওসমানকে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে ৫০টিরও বেশি গুলি করা হয়েছে। আইসিইউতে রাখলেও তাকে বাঁচানো যেত না। পরদিন সকালে বাবুরহাট কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে বড় ভাই মো. ওমর ফারুকের ইমামতিতে জানাজার মাধ্যমে শেষ বিদায় জানানো হয় শহীদ ওসমান পাটোয়ারীকে। ওসমানের অসিয়ত অনুযায়ী শহীদি মর্যাদায় শেষ গোসল ছাড়াই শহীদি পোশাকেই রক্তমাখা অবস্থায় পারিবারিক কবরস্থানে শহীদ ওসমানকে দাফন করা হয় ।

শহীদ ওসমানের লাশ কবরে অক্ষত ছিল: প্রায় এক মাস পর ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ ওসমানের লাশ তোলা হয়। সে সময় যেভাবে ওসমানকে দাফন করা হয়েছে, সেভাবেই অক্ষত লাশ পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন তার বাবা আবদুর রহমান। তিনি বলেন, পানিতে ভাসছিল ওসমান। তবু তার গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত দেহে পচন ধরেনি। তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তা আমার সন্তানকে শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন। দেশের জন্য, দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করার জন্য আমার সন্তান শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছে। ছেলের মতো আমরাও শহীদি মৃত্যু কামনা করি। যদি ফ্যাসিস্ট আবারও আসে, ইনশাআল্লাহ আবার আমরা নামব। যিনি আমাদের জীবন দান করেছেন, তার জন্য, তার পথের জন্যই জীবন দেব। ওসমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন শহীদের বাবা মো. আবদুর রহমান।

পুলিশ সূত্র জানায়, ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে চার শিক্ষার্থী নিহত হন। এর মধ্যে ওসমান-সাব্বির হত্যার ঘটনায় ৯১ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করে মামলা হয়। ১৪ আগস্ট অপর নিহত সাব্বিরের বাবা আমির হোসেন বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় সম্মিলিত এজাহার দায়ের করেন। পরে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে লক্ষ্মীপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।