জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদ বা জীবদ্দশায় ১০ বছর নির্ধারণের বিষয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। তবে বিএনপিসহ তিনটি দল এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। গতকাল রোববার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা জানান।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আজকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রথমটি হলো, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল এবং দ্বিতীয়টি হলো সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি। দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমরা একটি স্পষ্ট প্রস্তাবের জায়গায় এসেছি, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। কিন্তু এ বিষয়ে এখনও পূর্ণ ঐকমত্য হয়নি।’
তিনি জানান, বিএনপি, এনডিএম ও বিএলডিপিÑএই তিনটি দল তাদের মতামত পুনর্বিবেচনার জন্য সময় চেয়েছে। তারা বিষয়টিকে উচ্চকক্ষ গঠন ও এনসিসির কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত হিসেবে দেখছে এবং পরবর্তী আলোচনায় এটি আবার উত্থাপন করবে।’ অধ্যাপক রীয়াজ আরও বলেন, ‘তিন দল বাদে বাকি সব রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবে একমত হয়েছে। আমরা আশা করছি আলোচনার ধারাবাহিকতায় সবাই একমত হতে পারবে।
দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের মূলনীতির ওপর একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। দলগুলোর মতামত ও অবস্থান বিবেচনা করে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে একটি সংশোধিত প্রস্তাব তৈরি করা হবেÑ যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও গণতন্ত্রের বিষয়গুলো সংবিধানে সংযুক্ত বা পুনর্ব্যাখ্যার বিষয়ে সুপারিশ থাকবে।’ রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে আগামী দুই দিনের জন্য আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। আলী রীয়াজ বলেন ‘দলগুলো তাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পর্যালোচনার সময় চেয়েছে। আমরা আশাবাদীÑএই সময়ের মধ্য দিয়ে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান পাওয়া যাবে। এদিকে আগের অবস্থানেই রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
বিএনপির বক্তব্য :
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মেয়াদ ও বার এই বিতর্কে না থেকে সর্বোচ্চ এক ব্যক্তি জীবদ্দশায় কত বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, আমি সেই প্রস্তাব করেছি। সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা লিখিত প্রস্তাবে এবং আমাদের ৩১ দফার লিখিত প্রস্তাবের মধ্যে যা ছিল সেটা পুনরায় উল্লেখ করেছি। কোনো ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না। এখানে মেয়াদটা নিয়ে সবসময় বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা এসেছে। কারো কারো প্রস্তাবের মধ্যে দুইবার এসেছে। বারের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা হচ্ছে যদি কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে একবারের জন্য, ধরুন তিন মাসের জন্য হলেন। মেজরিটি পার্টি আরেকজনকে প্রধানমন্ত্রী করলেন। তারপর হয়ত আগেরজন প্রধানমন্ত্রী হলেন। তাহলে তো তার দুইবার পূরণ হয়ে যায়নি। এই দুইবার, তিনবার বা পাঁচবারও এক বছরের ভেতরে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বার নিয়ে ব্যাখ্যাটা যথেষ্ট নয়।
তিনি বলেন, মেয়াদের ক্ষেত্রে আমরা যে বিষয়টা মাথায় রেখে কথা বলেছিলাম সেটা হচ্ছে, সাধারণত সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর। পাঁচ বছর সংসদ বহাল থাকবে কি না সেটা সংসদের ওপর নির্ভর করে। আমাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে যে সংসদ পাঁচ বছরের হবে।
বিএনপির এ নেতা বলেন, তিনবারে হোক, চার মেয়াদে হোক, সর্বোচ্চ বছরটা যদি আমার উল্লেখ করতে পারি, একজন লোক জীবদ্দদশায় এত বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, আমি স্পেসিফিক কোনো বছর উল্লেখ করিনি। সেটা ডিসাইড করার ক্ষমতা এককভাবে আমার দলের পক্ষ থেকে আমার নেই। যদি একটা মেয়াদ ডিসাইড করে, তাহলে আমাকে আমার দলীয় ফোরামে আলোচনা করতে হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ যদি এখানে নির্ধারণ করা হয়, তবে তার সঙ্গে এনসিসির আলাপটা আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারভুক্ত সব জিনিস যদি একটা পাওয়ার ফাংশন দিয়ে এনসিসি গঠন করা হয়, তার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারব না।
তিনি বলেন, উচ্চকক্ষে একটা জেনারেল বিল পাস হতে ৫০ শতাংশ মেজরিটি লাগবে। সংবিধান সংশোধনের কথা বলা আছে উচ্চকক্ষে। দুই-তৃতীয়াংশের মেজরিটির মধ্য দিয়ে উচ্চকক্ষে সংবিধান সংশোধনের কথা বলা আছে। তখন কেউ দুই-তৃতীয়াংশ পাবে না। সেই জিনিসগুলো একসঙ্গে আলোচনা হবে।
‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে আমরা আগেই বলেছি। এই বিষয়টা আজকে আসেনি কিন্তু এটা রিলেটেড। যদি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সদস্য সংখ্যা যদি ১০০ হয়, আর যদি নারী আসন একশ হয়, সংসদের নিম্নকক্ষ যদি ৩০০ হয়, ৫০০ সদস্যের মধ্যে আমরা বলেছি গোপন কক্ষে ব্যালটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে পারে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কি হবে, না হবে, আইনে নির্ধারণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে আরও ক্ষমতা দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়টা, সরকার পরিচালনার বিষয়টা রিলেটেড। এ বিষয়গুলো অন্তত এনসিসি, উচ্চকক্ষের বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সঙ্গে একই প্যাকেজে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে এলে তখন সুবিধা হবে। আলাদা আলাদাভাবে যদি প্রত্যেকটা বিষয়ে ডিসাইড করতে যাই, তখন আমরা একমত হতে পারব না।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংবিধানের মূলনীতির প্রশ্নে আপনারা জানেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। এভাবে বলা আছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আর্টিকেল ৮, ৯, ১০, ১২ ধারাগুলোতে উল্লেখ করা আছে। এখানে সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক প্রস্তাবে ছিল, এই আর্টিকেলগুলো বিলুপ্ত করা হবে। তার বিকল্প হিসেবে উনারা কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। আমাদের লিখিত প্রশ্ন এবং পরবর্তী আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে, সিদ্ধান্ত না আলোচনা মধ্যে রয়েছে– সাম্য এবং মানবিক মর্যাদা, সুবিচার ও গণতন্ত্র। এই চারটা সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত করা যায় কি না। এখন মূলনীতি ডিসাইড করবে কীভাবে? এখানে যারা আলোচনা করছেন তারা অনেকে পঞ্চদশ সংশোধনীতে যেভাবে আছে তার পক্ষে।
তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আমরা পুরোটাই বিলুপ্ত চেয়েছি, যার মধ্যে এই মূলনীতিগুলো আছে। আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থা বহাল চাই।
জামায়াতের অবস্থান :
জীবদ্দশায় একজনের ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা উচিত না বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে এমন কথা বলেন তিনি।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, বার ও মেয়াদ নিয়ে ঝামেলার মধ্যে প্রস্তাব করেছিলামÑএকজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ দশ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ বিষয়ে সবাইকে একমত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বার ও মেয়াদের ব্যাখ্যায় যাওয়ার দরকার নেই। তিনটি দল ছাড়া সবাই এই প্রশ্নে এক জায়গায় এসেছি। জামায়াতের এই নায়েবে আমীর বলেন, অর্থাৎ একজন ব্যক্তি তার জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সেটা যত বারই হোক। এটা জাতির আকাক্সক্ষা, আমি মনে করি। এটিই আমাদের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে।
তিনি বলেন, এমন নজির বহুদেশে আছে। এটা বাংলাদেশেও জরুরি বলে আমরা মনে করি। এ নিয়ে আমরা প্রায় ঐকমত্যে এসেছি। বিকালে আরও দুটো পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা হবে।
এনসিপির মত
সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চারটি মূলনীতি রয়েছে সেগুলো বাদ দেওয়ার পক্ষে নিজেদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলছে, ৭২-এর ‘মুজিববাদী’ মূলনীতি তারা রাখার পক্ষে না। এ চারটি মূলনীতি বাদ দিতে হবে। এগুলো বাদ দিয়ে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত চার মূলনীতি রাখার ক্ষেত্রে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জাবেদ রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের একটা প্রস্তাব ছিল যে, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের যে মূলনীতি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, এর সঙ্গে গণতন্ত্রকে যুক্ত করে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ছিল, চারটি মূলনীতি যুক্ত থাকবে।
এনসিপির এই নেতা বলেন, আমাদের অবস্থান স্পষ্ট- ১৯৭২ সালের মূলনীতি আমরা বাতিল চাই। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে যদি অন্য কোনো শব্দ এখানে আনা হয় অথবা অন্য কোনো মূলনীতির বিষয়েও আমরা ওপেন আছি। কিন্তু আমাদের মূল পয়েন্ট হচ্ছে ৭২-এর চার মূলনীতি বাদ দিতে হবে।
এসময় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে ঐক্য কমিশনের সংলাপে মতানৈক্যের প্রসঙ্গ টেনে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা সাংবাদিকদের জানান, জাতীয় ঐকমত্যের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সংক্রান্ত বিষয়ে ছাড় দিতেও রাজি আছে তাদের দল।
নূর যা বললেন :
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যেভাবে ঐকমত্যের বিষয়ে আলোচনা চলছে, তাতে কেয়ামত পর্যন্তও শতভাগ ঐকমত্য হবে না বলে মন্তব্য করেছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেছেন, ‘মূল বিষয়গুলো গত তিন দিনের মতো আজকেও অমীমাংসিত।’
ঐকমত্য কমিশনের আগেকার আলোচনা শেষ করতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার বিরতিতে এ মন্তব্য করেন নুরুল হক নুর।
ঐকমত্যের সঙ্গে নিজেদের অনেক প্রস্তাব থেকে সরে এসেছেন বলে মন্তব্য করেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো বিষয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একমত হচ্ছি আমরা। কিন্তু এখানে কিছু কিছু দল একেবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। দুই থেকে তিনটি দল তাদের পার্টির কনফার্মেশন নিতে হচ্ছে, দল থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না।’
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ কোনোভাবেই শতভাগ ঐক্যের জায়গা তৈরি হবে না। এ জন্য আমরা বারবার বলেছি, কতটুকু পর্যন্ত আলোচনায় একমত হলে তাকে ঐকমত্য বলবেন কিংবা কতটি দল একমত থাকলে সেটাকে ঐক্য বলবেন, এটার একটা মাপকাঠি ঐকমত্য কমিশনকে নির্ধারণ করা দরকার। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে বলেছি, আপনারা এখানে রেফারির ভূমিকায় আছেন, সবার আলাপ-আলোচনা শুনে আপনাদের একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে।’
বৈঠকে আলী রীয়াজ ছাড়াও আরও উপস্থিত রয়েছেন, ঐকমত্য কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।