৫০ এর অধিক জেলায় ব্যবহার হয় মারণাস্ত্র
গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশের ৪১ জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকা- চালিয়েছে। এছাড়া অর্ধশতাধিক জেলায় আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দীতে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ৫৪তম ও সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে আলমগীর গতকাল মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের মতো জবানবন্দী দেন। গতকাল সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। জেরার জন্য আগামী ৬ অক্টোবর সোমবার দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ জবানবন্দী নেওয়া হয়। প্যানেলের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
মামলার অপর দুই আসামী হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এরই মধ্যে মামুন আসামী থেকে রাজসাক্ষী হওয়ার পর জবানবন্দী পেশ করেছেন।
গতকাল ট্রাইব্যুনালে তদন্ত কর্মকর্তার পেশ করা জবানবন্দীর অংশবিশেষ ও প্রদর্শন করা ভিডিও সরাসরি বিটিভিতে সম্প্রচার করা হয়।
এদিন, বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলার ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে তৃতীয় দিনের মতো নিজের জবানবন্দী দেন আলমগীর। তিনি এ মামলার সর্বশেষ সাক্ষী। জবানবন্দীতে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে গত বছরের জুলাই আন্দোলন চলাকালীন ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকা- ও ৫০টিরও বেশি জেলায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন এই তদন্ত কর্মকর্তা।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, জুলাইয়ে হত্যাকা- বা নৃশংসতা চলল, এসব বন্ধে আসামীরা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কিনা। আপনি কি তদন্তে পেয়েছেন?
জবাবে সাক্ষী আলমগীর বলেন, না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকা--নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য আসামীরা কোনো পদক্ষেপ নেননি। একইসঙ্গে যারা হত্যা-গুম-জখম করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মূলত জুলাই আন্দোলনসহ গত ১৫ বছরে খুন-গুম, নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
ট্রাইব্যুনালে গতকাল প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।
তদন্তের বরাত দিয়ে ট্রাইব্যুনালে আলমগীর বলেন, ২০২৪ সালের আন্দোলনে সরকার যত গুম, খুন, জখম, অপহরণ ও নির্যাতন করেছে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা। এছাড়া তাদের ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে বিরোধী দলমত ও প্রতিপক্ষকে হত্যা, জঙ্গী নাটক, জোরপূর্বক অপহরণ, গুমসহ পাতানো নির্বাচন- সবকিছুর মূলে ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা।
২৯ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দিনের মতো জবানবন্দী দেন আলমগীর। জবানবন্দীতে তিনি বিভিন্ন তথ্যের পাশাপাশি নিজের জব্দ করা জুলাই আন্দোলনের নৃশংসতা নিয়ে যমুনা টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদন প্রদর্শন করা হয় ট্রাইব্যুনালে। এছাড়া গত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। এমনকি জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর তিন লাখ পাঁচ হাজার গুলী ছোড়া হয়েছিল বলে জবানবন্দীতে জানিয়েছেন তিনি। তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালে সেদিন বিবিসি, আল-জাজিরা ও আমার দেশে প্রচারিত প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয়।
এর আগে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম দিনের মতো জবানবন্দী দেন এই তদন্ত কর্মকর্তা। ওই দিন তার জব্দ করা ১৭টি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। এসব ভিডিওতে জুলাই-আগস্টের নির্মমতা ফুটে ওঠে। আগামী সোমবার তাকে জেরা করবেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এরপরই শুরু হবে যুক্তিতর্ক।
এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক আলমগীর। সার্বিক সহযোগিতা করেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা।
আলমগীর চলতি বছরের ১২ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।