বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, জুলাই যোদ্ধাদের জাতীয় বীর উপাধি দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেও ফ্যাসিবাদের হাত থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারেনি। কারণ আওয়ামী লীগ বিরোধী দলমত রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে দমন পীড়ন করেছে। কিন্তু ছাত্রদের নেতৃত্বে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণে জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়। জাতি ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত হয়। ছাত্র-জনতা গুলীর সামনে বুক পেতে দিয়ে জীবন ও রক্ত দিয়েছে। তাই ছাত্র-জনতার সাহসিকতার মর্যাদা রাষ্ট্রকে দিতে হবে।
গত শনিবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ (যাত্রাবাড়ী-ডেমরা অঞ্চল) উদ্যোগে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের’ সাথে মতবিনিময় সভা প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় তিনি আরো বলেন, আগে আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে দেশের মালিক মনে করতো; আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ার পর এখন আরেকদল নিজেদেরকে দেশের মালিক মনে করা শুরু করেছে। এজন্য তাদের দলীয় নেতাকর্মীরা সারাদেশে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, লুটপাট, দখলদারিত্ব, টেন্ডারবাজি, খুনাখুনি করে যাচ্ছে। তাদের কর্মকান্ডে জাতি অস্বস্তি আর আতঙ্কে রয়েছে। জনগণ রুখে দাঁড়ালে চাঁদাবাজদের রক্ষা নাই উল্লেখ করে রফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশের কোন ইসলামী দল চাঁদা দাবি করে না, আওয়ামী লীগও পলাতক, তাহলে চাঁদা আদায় করে কে?- চাঁদা দাবি করে কে?- এটা জনগণ জানে। আলাদা করে বলতে হবে না কে চাঁদাবাজ। যারা চাঁদাবাজি করা তারা ভাগাভাগি নিয়ে নিজেরা-নিজেরাই নিজ দলের নেতাকর্মীকে খুন করতেছে। তিনি বলেন, ভারতীয় সেবাদাস আওয়ামী সরকার চেয়েছে মানুষকে খুন, গুম করে জুলুম, নির্যাতন চালিয়ে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে। জনগণ ছাত্রদের নেতৃত্ব আওয়ামী জুলুমের বিরুদ্ধে যেভাবে রাস্তা নেমে আসার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা রেখে গোষ্ঠীসহ পালিয়েছে। একইভাবে জনগণ চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামলে চাঁদাবাজদেরও পালিয়ে যেতে হবে।
রফিকুল ইসলাম খান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভিতরে আওয়ামী দোসরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। তারা সরকারের ভিতরে এবং বাহিরে নানারকম ষড়যন্ত্র করছে। দেশ ও জাতিকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাদের ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচতে হলে সরকারকে কঠোর হতে হবে। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ফেরাতে আওয়ামী দোসরদের অপসারণ করতে হবে। প্রশাসনে সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিকদের দায়িত্ব দিতে হবে। তবেই জুলাইয়ের চেতনা বাস্তবায়নে সরকার কাজ করতে পারবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রায় ১ বছর রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকলেও জুলাইয়ের চেতনার প্রতিফলন না হওয়ার অন্যতম কারণ সরকারের ভিতরে আওয়ামী দোসর। জুলাইয়ের চেতনা বাস্তবায়নে কাজ করতে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, জুলাই-আগস্ট বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আমরা সেই লক্ষ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের সাথে মতবিনিময় সভা, এতিম ও দুঃস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ সহ নানামুখী কর্মসূচি পালন করে আসছি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের দিনগুলো স্মরণ করে তিনি বলেন, ছাত্রদের নেতৃত্ব সকল শ্রেনীপেশার মানুষ আওয়ামী লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করে গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দেয়। হাসিনার নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্র লীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা গণহত্যা চালিয়ে দুই সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে। যেখানে রক্ষা পায়নি মায়ের বুকে দুধ প্রাণ করা শিশুও। তারা ৫০ হাজারের অধিক মানুষকে আহত করেছে। বহু মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান সহ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ হাসপাতালে-হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজ খবর নিয়েছেন। ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামী আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। ৫ আগস্ট পরবর্তী জামায়াতে ইসলামী প্রতিটি শহীদ পরিবারকে নগদ ২ লাখ টাকা করে আর্থিক উপহার প্রদান করেছে। রমযানে শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের সঙ্গে ইফতার করেছে। আমীরে জামায়াত সহ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ শহীদ পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপন করেছে। শুধুমাত্র শহীদ পরিবারের সাথে দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে জামায়াতে ইসলামী এমন মানবিক কর্মসূচি পালন করেছে। জুলাইয়ে আত্মদানকারী শহীদের ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী ১০ খন্ডে ১৫শ পৃষ্ঠায় সকল শহীদের তথ্য সম্মিলিত বই প্রকাশ করেছে। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল, রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। শহীদের পাশাপাশি আগামীতে আহতদের নিয়েও বই প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহন করবে জামায়াতে ইসলামী। শহীদ-আহতদের, জামায়াতে ইসলামী দলীয় সম্পদে পরিণত করেনি। আমরা বরাবরই বলেছি শহীদ ও আহতরা জাতীয় সম্পদ। যাদের জীবন ও পঙ্গুত্বে নতুন বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে কিন্তু প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও কোন শহীদ পরিবার কিংবা আহতরা ভাতা পায়নি। সরকার কেবল ভাতা দেওয়ার ঘোষণাই দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, শহীদ ও আহতদের আকাঙ্খা এড়িয়ে গিয়ে সংস্কারের আগে, গনহত্যার বিচার নিশ্চিত না করে নির্বাচন দিলে জনগণ সেই নির্বাচন মেনে নিবে না। কারো রক্তচক্ষু কিংবা কোন চাপে সংস্কার, গনহত্যার বিচার নিশ্চিত না করে নির্বাচনের দিকে গেলে নতুন করে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটবে এজন্য তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সকল গনহত্যার বিচার, রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করণ, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের ও আহতদের পুনর্বাসন এবং জুলাই সনদ ঘোষণার দাবি জানান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর আব্দুস সবুর ফকিরের সভাপতিত্বে এবং যাত্রাবাড়ী মধ্য থানা আমীর এডভোকেট এ.কে আজাদের পরিচালনায় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি ও ঢাকা-৫ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মোহাম্মদ কামাল হোসেন, শহীদ আসলামের বোন শারমিন আক্তার, জুলাই যোদ্ধা (আহত) মোহাম্মদ ইউসূফ, শহীদ মাহাদী হাসানের পিতা জাহাঙ্গীর হোসেন, শহীদ নুর হোসেনের মা নুরুন্নাহার বেগম, জুলাই যোদ্ধা (আহত) শাহ আলম, শহীদ মুনতাসীর রহমানের পিতা সৈয়দ গাজিউর রহমান, ঢাকা-৫ আসনে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পরিচালক ও মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক মোকাররম হোসাইন খান, যাত্রাবাড়ী পশ্চিম জোনের পরিচালক মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য সৈয়দ সিরাজুল হক, যাত্রাবাড়ী থানা আমীর অধ্যক্ষ সাদিক বিল্লাহ প্রমুখ।
সভায় আহত জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তারা বলেন, দেশ ও জাতিকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করতে জীবন ও রক্ত দিতে হয়েছে। ফ্যাসিবাদ মুক্ত নতুন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১১ মাসেও জুলাই সনদ ঘোষণা করতে পারেনি, গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি, শহীদ পরিবারকে এবং আহত-পঙ্গুত্ব বরণকারীদের পুনর্বাসন করতে পারেনি। যা অতন্ত্য বেদনাদায়ক। তাই অনতিবিলম্বে প্রতিটি হত্যাকান্ডের বিচার নিশ্চিত করতে এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে ও ফ্যাসিবাদের পথ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি জুলাই ঘোষণাপত্র সনদের দাবি জানান।
সভাপতির বক্তব্যে আব্দুস সবুর ফকির বলেন, জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক ঘোষিত মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগ শহীদ পরিবারের সদস্য এবং আহতদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। যাদের আত্মদানের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদের স্মরণীয় করে রাখতেই জামায়াতে ইসলামী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। বন্য প্রাণীকেও মানুষ এভাবে গুলী চালাতে পারে না, যেভাবে শেখ হাসিনার নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের উপর গুলী চালিয়েছে। যেটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই গণহত্যার বিচার করতেই হবে।
লিডারশীপ ট্রেনিং এর সমাপনী অনষ্ঠান: জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, আগামী নির্বাচন উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দেরকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নাঠে ময়দানে মানুষ জামায়াতের পক্ষে রয়েছে। জনগণ ভোট দেয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীকেই ভোট দিবে ইনশাআল্লাহ। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে নতুনভাবে চিনছে। এজন্য প্রার্থী দেরকে এলাকাভিত্তিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। কারণ প্রার্থীকে কেন্দ্র করে সকল কাজ সম্পন্ন হয়। তাই প্রার্থীকে নিজ এলাকার সকল ভোটারের কাছাকাছি যেতে হবে, বিপদ-আপদে পাশে থাকতে হবে। আগামী নির্বাচন নিয়ে জনগণের মাঝে আকাঙ্খা থাকলেও ভোটারদের ভিতরে এখনো শঙ্কা কাজ করছে যে নিজের ভোট প্রদান করতে পারবেন কি না! এই শঙ্কা দূর করার জন্য প্রার্থীর পক্ষ থেকে ভোটারদের ভোট প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে এবং ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল শনিবার বগুড়া অঞ্চল ও কুড়িগ্রাম জেলার আসন প্রার্থী, আসন পরিচালক ও আসন সদস্য সচিবদের নিয়ে ২ দিনব্যাপী লিডারশীপ ট্রেনিংয়ের সমাপনী সেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। উপস্থিত ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, আবদুস সাদেক ভূইয়া, আব্দুর রহিম, নজরুল ইসলাম ও ইয়াসিন আরাফাত প্রমুখ। প্রেস বিজ্ঞপ্তি।