সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। অর্থাৎ, প্রতি ঘনমিটারে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার আবেদন করা হয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। কমিশন ৬ অক্টোবর গণশুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়লে সারের দামও বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কা দেখা দিলেও গতকাল কৃষি উপদেষ্টা বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়লেও সারের দাম বাড়বে না।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বাড়তি দাম কৃষককে দিতে হবে নয়তো সারে সরকারের ভর্তুকি বাড়াতে হবে। পেট্রোবাংলা বলছে, দাম বাড়ালে সার উৎপাদনে চাহিদা মোতাবেক গ্যাস দেওয়া যাবে।

তবে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়লে সার, কৃষি, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।

সূত্র জানায়, দেশে ছয়টি সার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত আশুগঞ্জ সার কারখানা অনেক পুরনো হওয়ায় গ্যাস খরচ অনেক বেশি হয়। তাই কারখানাটি বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্য পাঁচটি কারখানায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ২৫ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে বর্তমানে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৬.৬ কোটি ঘনফুট। দেশে বছরে সারের মোট চাহিদা প্রায় ৬৯ লাখ টন। চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করা হয়।

গ্যাসের দাম বাড়লেও সারের দাম বাড়বে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক বছরের কাজের অগ্রগতি নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।

সার ব্যবস্থাপনা অনুমোদন জাতীয় কমিটিতে দেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারের নীতিমালা করতে জাতীয় কমিটি করা হচ্ছে। পাশাপাশি ডিলারশিপের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে আর থাকবে না সার নিয়ে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট। গ্যাস সংকটের কারণে সারের সমস্যা হবে না।

গত এক বছরে বিদেশ থেকে সার আমদানির ২০ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছ সরকার। কৃষিপণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশ। ১৫ লাখ মেট্রিকটন ধান বেশি উৎপন্ন হয়েছে। কৃষি জমি সুরক্ষায় কৃষি সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে বলেও জানান কৃষি উপদেষ্টা।

পেট্রোবাংলা বলছে, বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব অনুসারে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বছরের ৬ মাস (অক্টোবর-মার্চ) পুরোমাত্রায় গ্যাস দেওয়া সম্ভব হবে। অবশিষ্ট ৬ মাসের মধ্যে এপ্রিল-মে মাসে ১৬.৫ কোটি, জুনে ১৭.৫ কোটি এবং জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, চলতি বছর ১০৮ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। দাম বাড়ানো হলে আরও ৭ কার্গো এলএনজি আমদানি করে সারে সরবরাহ বাড়ানো হবে।

পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১১৫ কার্গো এলএনজি আমদানিতে খরচ হবে ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। দাম বাড়ানো হলে আয় হবে ৪৪ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এর পরও ঘাটতি থাকবে ৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। সরকারের ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বিবেচনায় নিলে ঘাটতি থাকবে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। ঘনমিটার প্রতি গ্যাসে খরচ ২৮.৭৮ টাকা। দাম বৃদ্ধি করলে গড় বিক্রয়মূল্য হবে ২৪.৫৬ টাকা। ঘাটতি থাকবে ঘনমিটারে ৪.২২ টাকার মতো।

পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক জানান, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) সঙ্গে দাম বাড়ানোর বিষয়ে কথা হয়েছে। তারা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির বাড়তি টাকা দিয়ে আরও বেশি এলএনজি আমদানি করে সার উৎপাদনে দেওয়া হবে।

বিসিআইসি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান জানান, গ্যাসের দাম নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। এতে শিল্প মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তাঁরা এ বিষয়ে কাজ করছেন। গ্যাসের দাম বাড়লে সার উৎপাদনে যে বাড়তি টাকা লাগবে, তা দেবে সরকার।

বিসিআইসি সূত্রে জানা গেছে, এখন প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের উৎপাদন খরচ ৩৮ টাকা। ডিলারদের কাছে বিক্রি করা ২৫ টাকায়। সরকার কেজিপ্রতি ১৩ টাকা ভর্তুকি দেয়।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজানুর রহমান সার কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন। বাড়তি টাকা দিয়ে আরও বেশি এলএনজি আমদানি করে সার উৎপাদনে দেওয়া হবে। তাতে করে গ্যাস অভাবে বন্ধ ৪টি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হবে।

নিয়ম অনুযায়ী আবেদন পাওয়ার পর বিইআরসি যাচাই-বাছাই শেষে গণশুনানির মাধ্যমে দর ঘোষণা করা হয়। বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা পেট্রোবাংলার প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পেট্রোবাংলার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে দর চূড়ান্ত করার কোনো সুযোগ নেই। প্রস্তাব আসতে হবে গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে। আমরা বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য বলেছি।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়ে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে বিষয়টি অবগত হয়েছি আমরা।

এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের সার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৪০ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ১০ টাকা। এসব সার কেনার পাশাপাশি সার কারখানার জন্য ১০ হাজার টন ফসফরিক এসিড কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে এ সংক্রান্ত তিনটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির আওতায় মরক্কো থেকে ৩০ হাজার টন টিএসপি সার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ও মরক্কোর ওসিপি নিউট্রিক্রপস-এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হওয়া চুক্তির আওতায় এই সার কেনা হবে। এতে মোট ব্যয় হবে ২১২ কোটি ৯৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির আওতায় কানাডা থেকে ৪০ হাজার টন মিউরেট-অব-পটাশ (এমওপি) সার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কানাডিয়ান কমার্শিয়াল কর্পোরেশন থেকে এই সার আনতে ব্যয় হবে ১৭৭ কোটি ৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পৃথক এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির আওতায় মরক্কো থেকে ৪০ হাজার টন ডিএপি সার আমদানি করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মরক্কোর ওসিপি নিউট্রিক্রপস থেকে এই সার আনতে ব্যয় হবে ৩৮১ কোটি ৬৯ লখ ৩০ হাজার ৩২০ টাকা।

বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো), বাংলাদেশ-এর কাছ থেকে ৩০ হাজার টন ব্যাগড গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই সার কিনতে ব্যয় হবে ১৬৬ কোটি ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকা।

বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে চট্রগ্রামের টিএসপিসিএল-এর জন্য ১০ হাজার টন ফসফরিক এসিড আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। টিএসপি সার উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ফসফরিক এসিড ও রক ফসফেট বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে ১০ হাজার টন ফসফরিক এসিড আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক উম্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হলে একটি দরপত্র জমা পড়ে। প্রস্তাবটি কারিগরিভাবে রেসপনসিভ বিবেচিত হয়।

দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে টিইসি কর্তৃক সুপারিশ করা রেসপনসিভ একমাত্র দরদাতা প্রতিষ্ঠান গুয়ানজি পেনগুই ইকো-টেকনোলজি, চায়না এই ১০ হাজার টন ফসফরিক এসিড সরবরাহ করবে। এতে মোট খরচ হবে ১০২ কোটি ১৮ লাখ ৫৮ হাজার ৭৪০ টাকা। প্রতি টন ফসফরিক এসিডের দাম ৭৯৩ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলার।