সেনাবাহিনীর অভিযানে ইন্টারপোলের ওয়ারেন্ট জারি করা পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ গ্রেফতার হলেও এখনো অধরা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের অন্তত ডজন খানেক দাগি সন্ত্রাসী। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ‘ডেভিল হান্ট’ অপারেশন চললেও দুর্ধর্ষ অপরাধীরা অধাই ছিল। এসব সন্ত্রাসীরা অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছিল। তবে আলোচিত দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেফতার হলেও আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করা দাগি অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এখনো অধরা।

এদিকে অস্ত্র আইনের মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে মো. ফাতেহ আলীর (৬১) আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এছাড়াও তার অপর তিন সহযোগীর ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। তারা হলেন- আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ (৫৩), এম এ এস শরিফ (২৫) এবং মো. আরাফাত ইবনে মাসুদ (৪৩)। গতকাল বুধবার বিকেলে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজধানীতে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আগে থেকেই যৌথবাহিনীর ‘ডেভিল হান্ট’ অপারেশন চলছে। সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে চলমান যৌথ অভিযানের মধ্যেই অপরাধ নিয়ন্ত্রনে না আসায় গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। সূত্রমতে কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে নাম আসে আলোচিত কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর। তাদের গ্রেফতারের জন্য গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়। এবং ধীর্ঘ গোয়েন্দা তৎপরতায় মঙ্গলবার ভোর থেকে টানা তিন ঘন্টার অভিযানে অস্ত্র, গুলী ও অনান্যসরঞ্জামসহ দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে সেনাবাহিনী।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দাগি অপরাধীদের অনেকেই জামিনে বের হয়ে এসে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখল, হামলাসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে অপারেশন ডেভিল হান্ট অভিযান শুরু হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের অপারেশন ডেভিল হান্ট অভিযানে গ্রেপ্তার করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ওই বৈঠকে বিভিন্ন বাহিনীর কার্যক্রমে কোনো বাহিনী কী কাজ করছে সুষ্ঠুভাবে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা ও শান্তি শৃঙ্খলা বজায়ে রাখা সরকারের সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয়।

কারা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ৫ আগস্টের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন ও খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন। সেখান থেকে খোরশেদ আলম ওরফে রাসু নামে আরেক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীও মুক্তি পান। অন্যদিকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল। পাশাপাশি এস এম আরমান, শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, হাবিবুর রহমান তাজ, আকতার হোসেন ও সোহেল রানা চৌধুরী ওরফে ফ্রিডম সোহেলও এই কারাগার থেকে মুক্ত হন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্তি পান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী ও শাহাজাদা সাজু। কারাগার থেকে বেরোনোর পর রাজধানীতে তাদের অনেকের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মোহাম্মদপুরে জোড়া খুনের ঘটনায় পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।

পরে গত জানুয়ারিতে এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় পিচ্চি হেলাল ও ইমনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের বিষয়টি আবারো সামনে আসে। তবে পরিবারের দাবি, জামিনে মুক্তি পাওয়ার কদিনের মধ্যে ইমন দেশের বাইরে চলে যান। তবে পুলিশ বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন দেশ ত্যাগ করেছেন কি না, ইমিগ্রেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা বের করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ১০ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখমের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার সোসাইটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক ও সভাপতি ওয়াহিদুল হাসান দিপু। পরে পুলিশ ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, এর নেপথ্যে রয়েছে পিচ্চি হেলাল ও ইমনের আধিপত্য বিস্তার আর চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্ব। গত বছরের ১৫ ও ১৬ আগস্ট যথাক্রমে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান ইমন ও পিচ্চি হেলাল। তারা কারাগারে থেকেই অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন। কারামুক্তির পর তারা আধিপত্য বিস্তারের জন্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। তবে গত ১৮ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনে ইমনের মা সুলতানা জাহান দাবি করেন, ইমন বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন, তাকে ষড়যন্ত্র করে মাল্টিপ্ল্যানের সামনের ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে। মায়ের দাবি, ছেলে ইমন আওয়ামী নেতা ও মন্ত্রীদের রোষানলে পড়ে একাধিক মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেলখানায় আটক ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইমন জামিনে মুক্তি পেয়ে ইমন বিদেশে চলে গেছেন। পুলিশ বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দাগি অপরাধীরা গা ঢাকা দিয়েছে। দেশের বাইরে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য বার্তা পাঠানো হয়েছে সীমান্তে ও বিমানবন্দরে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার চালু করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত কমান্ড সেন্টারটির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী-পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, কোস্টগার্ড, আর্মডফোর্স ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যুক্ত।

জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে সুইডেন আসলাম, যোশেফ, বিকাশ ও প্রকাশকে ধরতে ৫০ হাজার টাকা করে প্রথম পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একটি তালিকা প্রকাশ করে। এদের ধরিয়ে দিতে ১ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় যাদের নাম ছিল, তারা হলো কালা জাহাঙ্গীর, মোল্লা মাসুদ, পিচ্চি হান্নান, সুব্রত বাইন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, হারিস আহমেদ, খোরশেদ আলম রাসু, পিচ্চি হেলাল, আলাউদ্দিন, কামাল পাশা, নাঈম আহমেদ টিটন, লিয়াকত, আরমান, জাফর আহমেদ মানিক, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, ইমাম হোসেন ওরফে ফ্রিডম ইমাম, ফ্রিডম সোহেল, মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, ভিপি হান্নান, শামীম ওরফে আগা শামীম, মশিউর রহমান ও আবদুল জব্বার মুন্না।

এদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কিলার আব্বাস, পিচ্চি হেলাল, রাসু, টিটন, আরমান, বিকাশ, মশিউর রহমান কচি ও লিয়াকত গ্রেপ্তার হয়। তালিকার মধ্যে পিচ্চি হান্নান র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন। আলাউদ্দিন তেজগাঁও বেগুনবাড়ি খালে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনার পর জনতার গণপিটুনিতে নিহত হন। লিয়াকত ২০০৭ সালে ছাড়া পাওয়ার পর ২০০৮ সালে লালমাটিয়ার বাসা থেকে কে বা কারা ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর খোঁজ মিলেনি। ২০০৪ সালে কাফরুলের শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর আদাবর এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। ২০২৪ সালের ১৫ এপ্রিল মালয়েশিয়ায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে তানভীরুল ইসলাম জয় মারা যান। বাকিদের মধ্যে টোকাই সাগর আমেরিকায় পালিয়ে যায়। প্রকাশ, সুব্রত বাইন, জয়, ইমাম, ফ্রিডম মানিক, মোল্লা মাসুদ ও ভিপি হান্নান ভারতে আত্মগোপন করে। এছাড়া জিসান আত্মগোপন করেন দুবাইয়ে। এদিকে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে ২০১২ সালে বিকাশ জামিনে মুক্তি পেয়ে লাপাত্তা হন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পিচ্চি হেলাল, রাসু, ফ্রিডম সোহেল, মশিউর রহমান কচি, টিটন ও কিলার আব্বাস জামিনের মুক্তি পান। তেইশ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে মগবাজারের আরমান ও খিলগাঁওয়ের কামাল পাশা কারাবন্দি রয়েছেন। গত বছরের ১৫ আগস্ট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন মুক্তি পান। এদিকে চাঁদার দাবিতে এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসায়ী এহতেশামুল হকের ওপর হামলার তিন দিন আগেই সানজিদুল ইসলাম ইমন মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গেছে। ছদ্মনাম, ঠিকানায় পাসপোর্ট করে দেশ ছেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের ১৩ আগস্ট কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পায় শীর্ষ সন্ত্রাসী টিটন। টিটনকে ২০০৪ সালে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় টিটন ছিল ২ নম্বরে। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবর এলাহী হত্যা মামলায় আদালত তাকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন। টিটন জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর লাপাত্তা হয়ে গেছে। গত বছরের ১২ আগস্ট মুক্তি পায় ফ্রিডম রাসু। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় তার অবস্থান ছিল ৬ নম্বরে। রাসুর বিরুদ্ধে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাসহ ১৩টি মামলা রয়েছে। সব মামলায় জামিন পায় রাসু। জামিনের পর রাসুর অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। গত ১৬ আগস্ট কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পায় পিচ্চি হেলাল। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর পিচ্চি হেলালকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলাসহ আটটি মামলা রয়েছে। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় পিচ্চি হেলাল ছিল ১৬ নম্বরে। জামিনে মুক্তির পিচ্ছি হেলাল মালয়েশিয়ায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। গত বছরের ১৩ আগস্ট সোমবার রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পায় রাজধানীর আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস।