গণভোট অধ্যাদেশ ২০২৫ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনু্ষ্ঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। আইন উপদেষ্টা জানান, ভোটারদের সুবিধার্থে গণভোটের ব্যালট হবে ভিন্ন রঙয়ের।

পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে ব্রিফ করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন, কারণ জুলাই সনদে বর্ণিত সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলোতে জনগণের ‘মতামত বা সম্মতি’ জানার জন্য সরকার গণভোট আইন প্রণয়ন করেছে। গণভোট কীভাবে গ্রহণ করা হবেÑতার পুরো প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে নির্ধারণ করতেই গণভোট অধ্যাদেশ তৈরি করা হয়েছে। অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আজ অথবা কাল এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

আইন উপদেষ্টা জানান, এ আইন প্রণয়নে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া গেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল, কয়েকজন উপদেষ্টা ও আইন মন্ত্রণালয়ও প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, গণভোটে থাকবে মাত্র একটি প্রশ্নÑ ভোটাররা জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫ এবং সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত চারটি প্রস্তাবের প্রতি সম্মতি জানান কি না। ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ দুটি ঘর থাকবে; সম্মত হলে ‘হ্যাঁ’, না হলে ‘না’-তে সিল দিতে হবে। চারটি প্রস্তাব হলোÑ

১. জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন;

২. আগামী জাতীয় সংসদকে দুই কক্ষবিশিষ্ট করা এবং প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ গঠন;

৩.জুলাই সনদের ৩০টি সংস্কারÑনারীর প্রতিনিধিত্ব, বিরোধীদল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্ব, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ইত্যাদিÑএসব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর বাধ্যবাধকতা;

৪. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন।

আইন উপদেষ্টা বলেন, জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি দলই ৩০টি প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে; এনসিপিও একই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে। এজন্যই বলা হচ্ছে, এ ৩০টি প্রস্তাবে ‘ঐকমত্য’ হয়েছে। অধ্যাদেশের অ্যাপেন্ডিক্সে এ ৩০টি প্রস্তাব সংযুক্ত থাকবে, যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ জানতে পারে গণভোটে কোন বিষয়ে মতামত চাওয়া হচ্ছে। আইন উপদেষ্টা আরও জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেসব কেন্দ্রে হবে, সেই কেন্দ্রগুলোতেই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে; একই ভোটার তালিকাই ব্যবহার করা হবে।

গণভোটের ব্যালট সংসদ নির্বাচনের ব্যালট থেকে আলাদা রঙের হবে, যাতে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি না হয়। নির্বাচনের জন্য নিয়োজিত রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তারাই গণভোটে দায়িত্ব পালন করবেন।

আসিফ নজরুল বলেন, কোনো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভোট স্থগিত করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে যে কিছু কেন্দ্র ছাড়া অন্যান্য কেন্দ্রের ফলাফলের ভিত্তিতেই গণভোটের চূড়ান্ত ফল নির্ধারণ করা সম্ভব, তবে সব কেন্দ্রেই পুনর্ভোটের প্রয়োজন হবে না। গণভোটে পোস্টাল ব্যালটের সুযোগও রাখা হয়েছে। ভোট গ্রহণ, শৃঙ্খলা রক্ষা, বাতিল ব্যালট ও গণনাÑএসব ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধানই প্রযোজ্য হবে।

আইন উপদেষ্টা বলেন, ভোট গণনা জাতীয় নির্বাচনের মতোই হবেÑপ্রিজাইডিং কর্মকর্তারা ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ ভোট পৃথক করে গণনা করবেন, ফল সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন; পরে রিটার্নিং কর্মকর্তা বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল একত্র করে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। নির্বাচন কমিশন সব কেন্দ্রের ফলাফল একত্রীকরণ করে গণভোটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করবে। গণভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় বিধি, নির্দেশনা ও পরিপত্র জারি করার ক্ষমতাও কমিশনকে দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট উভয় ক্ষেত্রেই পোস্টাল ব্যালট থাকবে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট হবে সাদা কাগজের ওপর কালো প্রতীক। আর গণভোটের ব্যালট হবে রঙিন কাগজের ওপর দৃশ্যমান যে কোনো কালি।

তিনি বলেন, আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হবে। সে অনুযায়ী নির্বাচনি প্রস্তুতি এগোনো হবে। সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে। প্রবাসীরাও গণভোট দিতে পারবেন।

এর আগে ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নের উপায়সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর ওই ভাষণের আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়।

পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এ আদেশ জারি করেন। তাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একই দিনে করার কথা জানানো হয়। এর মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ আইনি ভিত্তি পায়।