কামাল উদ্দিন সুমন : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া দেনা টানতে গিয়ে বেহাল দশা সরকারের। তবুও নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রমযানে মাসে যেভাবে লোড শেডিং হওয়ার আবাস পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু ঘটেছে তার বিপরিত। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগের ফলে রমযানে মাসে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে গ্রাহক। এছাড়া গ্যাস সংকটও অনেকটা কমে আসছে। তবে গ্রীস্ম মওসুমে বিশেষ করে ঈদের পরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির সম্প্রতি বলেছেন, আগের সরকার বকেয়া রেখে গেছে। জ্বালানি তেলের বকেয়া ইতিমধ্যে শোধ করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বকেয়া পরিশোধে করণীয় ঠিক করা হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক ধরনের ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে। যার জন্য মূলত পূর্ববর্তী সরকারের নীতিকাঠামো দায়ী। এই সংকট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ২১ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বকেয়া প্রায় ৮৪৫ মিলিয়ন ডলার বা ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি আইপিপি এবং সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের কারণে গেলো বছরের শেষ সময় পর্যন্ত পেট্রোবাংলার পাওনা মোট ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায় , প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলএনজি আমদানির জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে মোট ৭২২ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে পেট্রোবাংলার। অন্যদিকে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের জন্য শেভরন বাংলাদেশের কাছে ২২২.৫৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। পেট্রোবাংলার কাছে ৩৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার ভ্যাট বকেয়া রয়েছে এনবিআরের।

এদিকে দায় দেনার চাপে বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ ঝুঁকিতে। তিন বছর ধরে নিয়মিত বকেয়া অর্থ পরিশোধের চাপে আছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। অর্থসংকটে থাকায় বিল দিতে পারছে না পিডিবি ও পেট্রোবাংলা। আবার চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় বিদেশি কোম্পানির বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না বিশেষ ক্ষেত্রে।

পিডিবি ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে বকেয়া বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল পরিকল্পনা ও ভ্রান্ত নীতির কারণে জ্বালানি খাত এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, ২০২২ সাল থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সংকট তৈরি হয়। তখন জ্বালানি আমদানি কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আবার বিল পরিশোধ না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেও সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন করা যায়নি। তাই বিদ্যুৎ–ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ব্যাপক লোডশেডিং করা হয়। গত বছরের ৮ আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জ্বালানি তেলের বকেয়া শোধ হয়েছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের বকেয়া এখনো শোধ করা যায়নি।

বকেয়া নিয়ে বেশি চাপে আছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। বকেয়া শোধে নিয়মিত তাগাদা পাচ্ছে তারা। তবে কিছুটা স্বস্তিতে জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিপিসি। বিগত সরকারের সময় বিপিসির বকেয়া ৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি চলে যায়। ইতিমধ্যে এসব বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে।তবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮ কোটি ডলার বকেয়া জমেছে বিপিসির।

পিডিবি ও পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মার্চ থেকে গরম পড়া শুরু হয়েছে। তাপমাত্রা বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে। বোরো আবাদ, পবিত্র রমযান মিলে এবারের গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট ছাড়াতে পারে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে প্রাথমিক জ্বালানি (গ্যাস, তেল ও কয়লা) সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আর না হলে বসিয়ে রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। এ কারণে লোডশেডিং বাড়তে পারে।

পিডিবির তথ্যমতে, অসম সব চুক্তির ফলে বিগত সরকারের আমলে কেবল ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরও অন্তর্র্বতী সরকারের কাঁধে বিপুল ক্যাপাসিটি চার্জ পূরণের ভার রয়েছে।

জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নেওয়া উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম বিশেষ আইন বাতিল। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে নির্বাহী আদেশের ক্ষমতা বাতিল করে এই ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ আইনের আওতায় করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন চুক্তি পর্যালোচনা, এ খাতের কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান হিসেবে সচিবদের সরিয়ে দেওয়ার কাঠামোগত পরিবর্তনও আনা হয়েছে। এছাড়া ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ পর্যালোচনা, সামিট গ্রুপের এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি বাতিল করাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গ্যাস অনুসন্ধানে গ্রহণ করা ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনাও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার।

গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে এখন বকেয়ার পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বকেয়া ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া গ্যাসে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) বকেয়া ২৭ হাজার কোটি টাকা। বিপুল এই বকেয়ার কারণ হিসেবে এ খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, বড় প্রকল্প, অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে দায়ী করা হয়।

বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৩টি কিন্তু জ্বালানি সংকটে বন্ধ ও কারিগরি কারণে সক্ষমতার তুলনায় কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে প্রায় ৫০টি কেন্দ্র। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন কারণে বড় সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রায়ই ভরসা করতে হয় আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩১ হাজার মেগাওয়াট হলেও গড়ে ১১ থেকে ১২ হাজারের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। অদক্ষ ও অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসে থাকলেও মাসে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।

সম্প্রতি এক সাংবদিক সম্মেলনে বিভিন্ন কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত আর্থিক চাপে আছে। বিপুল অর্থ পাচার হওয়ায় বকেয়া পরিশোধে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এছাড়া বর্তমানে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হয়। সে ক্ষেত্রে কয়লা, গ্যাস ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে কী দামে বিদ্যুৎ কেনা হবে, সে বিষয়ে একটি মানদণ্ড ঠিক করা হবে।

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম গত মঙ্গলবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এ সরকার রাজনৈতিক না তার পিছুটান নেই। বরং সবাই সৎ। কিন্তু বিগত দিনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুন্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

তিনি বলেন, পরিবর্তন বলতে অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি বিষয়ের কথা বারবার বলছে। সেগুলো হচ্ছে বিশেষ বিধান আইন বাতিল, মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে দেওয়া। আমি বলতে চাই, ক্ষমতা যদি বিইআরসির হাতে ফিরেই আসে তাহলে তার প্রতিফলন কোথায়? কাঠামোগত যে প্রক্রিয়াই গ্রহণ করা হোক না কেন, ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের যে সক্ষমতা তা জ্বালানি বিভাগ ও তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আছে বলে আমার মনে হয় না। এর ফলে জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।