চেয়ারম্যান অপরসানের দাবিতে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমপ্লিট শার্টডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর নতুন করে নজরদারী বেড়েছে। আন্দোলনে নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি রফতানি ব্যহত করার ঘটনায় আরো কঠোর হয়েছে সরকার। বিষয়টি অস্বাভাবিক এবং এর পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা । ফলে বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস হয়েছে সরকার। এরই মধ্যে একজনকে বরখান্ত এবং ৪ জন কর্মকর্তাকে অবসর দেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন করে দুর্নীতির অভিযোগ আরও ৫ এনবিআর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুদক । এর আগে গত ২৯ জুন ও ১ জুলাই এনবিআরের ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর ঘোষণা দেয় দুদক।

জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আরও পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বৃহস্পতিবার দুদকের জনসংযোগ বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তদন্তের আওতায় আসা কর্মকর্তারা হলেন ঢাকা পূর্ব কর অঞ্চলের কমিশনার কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল বন্দরের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, রাজশাহীর উপকমিশনার মো. মামুন মিয়া, অতিরিক্ত কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা ও কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ। এর আগে, গত ২৯ জুন ও ১ জুলাই এনবিআরের ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর ঘোষণা দেয় দুদক।

সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সন্দেহভাজন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নজরদারিতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, করদাতাকে হয়রানি, প্রভাব খাটিয়ে সরকারকে রাজস্ববঞ্চিত করাসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে দেখছে। এসব কর্মকর্তার মধ্যে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তদন্ত হচ্ছে। এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি না করলে প্রতিটি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি আরও কম হতো। শুধু তাই নয়, এই অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে সরকার রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে পারেনি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনলাইনে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে দুর্নীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে বিধায় এই চক্র নানা কৌশলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

এনবিআরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে এই চক্রের দাপটে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন। তাদের কারণে সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই চক্র বিগত সরকারের সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিজের পছন্দমতো ব্যক্তিকে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়ে আসত। পরবর্তী সময়ে সেই ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে একজোট হয়ে এই চক্র দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছে। এসব ব্যক্তি ঘুষ ও অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে ট্রাইব্যুনালে প্রভাব খাটিয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ করে দিয়েছেন। সাবেক এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার করে কর ফাঁকির মামলায় অসাধু ব্যক্তিদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। মতিউরের অসাধুতায় মাত্র চার মাসে সরকার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে প্রতি অর্থবছরে সরকার প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেই হিসাবে ১৫ বছরে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা।

এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়াই শেষ কথা হতে পারে না, তাদের আইনের আওতায়ও আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কে আছেন। অন্যদিকে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

সূত্র বলছে, ‘অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাপে থাকেন। বিগত সরকারের সময়ে দুর্নীতির কারণে ঠিকমতো রাজস্ব আদায় হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি অসৎ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনে, তা হলে রাজস্ব খাতে গতি আসবে।

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে। আমি আশা করি, রাজস্ব খাতে গতি আনতে এনবিআরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী একসঙ্গে কাজ করবেন। তবে দুর্নীতিবাজ, অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী, ঘুষখোরদের কোনো জায়গা এনবিআরে হবে না। সাধারণ মানুষকে সেবা প্রদান করাই এনবিআরের দায়িত্ব।’

তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআরের সততা ও জবাবদিহির গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলেই তিনি দুর্নীতিবাজ নন। তদন্ত করে দুর্নীতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। করদাতাকে এনবিআরের কোনো অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়রানি করলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। প্রত্যেক করদাতা আমাদের কাছে সম্মানিত করদাতা।’

অর্থ উপদেস্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সবার বোঝা উচিত যে এনবিআরের কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা রাষ্ট্রের কাজ। সরকারের বদল হতে পারে। কিন্তু রাজস্ব সংগ্রহের কাজ তো ঠিক রাখতে হবে। এনবিআরে কাজ বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করা মোটেই ঠিক হয়নি। তাঁরা কথা বলতে পারতেন। তাঁদের যে ডাকা হয়নি, তা তো নয়। অথচ শেষ দিকে তাঁরা কী চাইলেন? সরাসরি এনবিআর চেয়ারম্যানকে সরানোর দাবি করলেন।

তিনি বলেন, আন্দোলনে এনবিআরের কার্যক্রম ভালোই বিঘ্নিত হয়েছে। শুধু কি তাই? বাজেটের সময় ছিল এ আন্দোলন। অথচ এ সময়ে কত কাজ! ৩১ জুলাই পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। তাঁরা শোনেননি, কোনো তোয়াক্কাই করেননি। অতীতে কোনো দপ্তরে এ ধরনের কান্ড ঘটেনি।