শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘাতে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পুলিশ লাঠিপেটা করে, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের সচিবালয়ের ভেতর থেকে বের করতে পারলেও আশপাশের এলাকায় কয়েক ঘণ্টা ধরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষ চলে। এই সংঘর্ষের মধ্যে আহত ৭৫ শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছেন।

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সোমবার বিমানবাহিনীর যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের দাবি ওঠে। মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতায় পরীক্ষা স্থগিতের সেই ঘোষণা আসে সোমবার রাত ৩টার দিকে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে সেই খবর না পৌঁছানোয় কেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসতে হয় তাদের।

শিক্ষা উপদেষ্টার বরাতে তথ্য উপদেষ্টা সোমবার গভীর রাতে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি ফেইসবুকে জানান। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে অনেক পরে, যা নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার এবং শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে প্রথমে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করতে যায়। সেখান থেকে বেলা দেড়টার দিকে তারা সচিবালয়ের সামনে জড়ো হন। ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, নূর মোহাম্মদ কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ, কমার্স কলেজ, আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, মিরপুর কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ আরো কিছু শিক্ষার্থী এ কর্মসূচিতে অংশ নেন।

এ ছাড়া আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের ফটকে এসেছে। যারা এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে এসেছে শিক্ষার্থীরা। শুরুতে তারা সচিবালয়ের তিন নম্বর ফটকের সামনে বিক্ষোভ দেখান। পরে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রের বাকি ফটোগুলোও বন্ধ করে দেন। এ সময় লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে সচিবালয় থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে সচিবালয়সংলগ্ন জিপিও মোড়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরাও পুলিশের দিকে পাল্টা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পিছু হটে একদল পুরানা পল্টন মোড়ের দিকে এবং আরেক দল বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকের দিকে সরে যান। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে স্টেডিয়াম এলাকায় অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

স্থানীয়রা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়ার মুখে একপর্যায়ে দুই ভাগ হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। তাঁদের একটি দল জিপিও মোড় এলাকায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়।

সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের দেখা যায়কয়েকজনকে ধরে আনতে। কাউকে আটক করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ওসি খালেদ মনসুর বলেন, এখনো কাউকে আটক করা হয়নি। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যান চলাচল শুরু হয়েছে।

সিটি কলেজের শিক্ষার্থীর তানভীর বলেন, গোপালগঞ্জের সামান্য কারণে এইচএসসি পরীক্ষার স্থগিত করেছে। অথচ কালকে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, বারবার বলার পরও তারা এইচএসসি পরীক্ষার স্থগিত করেনি। রাত ৩টা বাজে যখন স্থগিত করেছে ততক্ষণের সব শিক্ষার্থীরা জানতেও পারেনি। সকালবেলা অনেকের পরীক্ষা দিতে বেরিয়েছে। এগুলো স্পষ্ট দায়িত্ব অবহেলা এবং একঘেয়েমি। আমরা এই শিক্ষা সচিব, শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ চাই। তাদের পদত্যাগ নিশ্চিত না করে ঘরে ফিরে যাব না।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান আরেফিন বলেন, প্রশ্নপত্রে ভুল, দায়িত্বে অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণে আমরা শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগ চাইছি। শিক্ষা বোর্ড সংক্রান্ত সব দায়িত্বশীলকে বহিষ্কার করতে হবে। সব শিক্ষা বোর্ডে একই প্রশ্নের পরীক্ষা হতে হবে। মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং সঠিক তথ্য প্রকাশেরও দাবি জানান তিনি।

এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের দাবি মুখে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় সরকার। তাদের অন্যান্য দাবি পর্যালোচনার জন্য কমিটি করা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান। কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে তিন নম্বর গেইট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। তারা সচিবালয়ের ভেতরে রাখা গাড়ি ভাঙচুর শুরু করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর হন। শিক্ষার্থীদের সচিবালয়ের বাইরে সরিয়ে দিতে তারা লঠিপেটা ও টিয়ার শেল (কাঁদানে গ্যাস) ছুড়তে শুরু করেন। কিছু সময় পর সচিবালয়ের সামনের এলাকা অনেকটা ফাঁকা দেখা যায়। তবে পরে জিরো পয়েন্টে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় মুহুর্মুহু সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ পাওয়া যায়।

বিকেল ৫টার দিকেও শিক্ষার্থীরা গুলিস্তান ও জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছিল। সচিবালয়ের অনেকগুলো ফটক তখন খুলে দেওয়া হয়। আটকা পড়া কর্মকর্তা কর্মচারীরা সেই সুযোগে বেরিয়ে যেতে পারেন। পরে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছুড়ে গুলিস্তানের দিক থেকেও শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়। বিকাল পৌনে ৬টার দিকে গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট এলাকা স্বাভাবিক হয়।

আহত ৭৫ জন ঢাকা মেডিকেলে

বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপে আহত ৭৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আহত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। সামির নামের একজনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।

আহত শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন, মো. হাসান, তানভীর, সাকিব, বেরাতুল, রিফাত, আবির মাহমুদ, তানভীর, রিফাত, বিজন, তামিম, ইমন, সিয়াম, মেহেদী, সাদমান, সামিরা, মারুফ, সাকিব, মাহিম, রোহান, হাসিব, সায়েম, জিদান, রায়হান, রোমান, প্রান্ত, মাহিদ অনতু, বিশাল, ইমরান, আহনাদ, মাহি নাঈম, সাফি, স্বাধীন, তাসিন, ইমরান, ধ্রুব, শান্ত, তামিম, তন্ময়, জিসান, আজাহার, শাহেদ খান, জিসান, পারভেজ, নাঈম, নিহান, নাফিজ, ইমাদ, শাহিন। এদের বয়স ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্যে।

লাঠিসোঁটা নিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশকারী ওরা কারা?

শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগ চেয়ে গতকাল সকাল ১০টা থেকে শাহবাগে জড়ো হয় কিছু শিক্ষার্থী। এর আগে তারা সোমবার রাতে এই আন্দোলনের ঘোষণা দেন। এরপর তারা মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের সামনে যান। সেখানে দীর্ঘক্ষণ আন্দোলন শেষে শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করে নেয় প্রশাসন। এরপরও তারা আন্দোলন চালিয়ে যায়। একপর্যায়ে লাঠিসোটা নিয়ে সচিবালয়ের মূল গেট ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে।

শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক সচিবালয়ে প্রবেশ করেই সেখানে থাকা বিভিন্ন সরকারি গাড়ি ভাঙচুর চালাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে সচিবালয়ের কর্মরতরা গাড়ি ভাঙচুর ঠেকাতে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষে বেধে যায়। তখন পুলিশ ও সেনা সদস্যরা ধৈয্যের বাধ খুলে লাঠি চার্জ করে এবং তাদের বের করে দেয়। শিক্ষার্থীদের একাংশ সড়কে বের হওয়ার ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। পুলিশও টিয়ারশেল ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পালটা ধাওয়া দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে।

জুলাই অ্যালায়েন্সের ব্যানারে থাকা শিক্ষার্থীদের দাবি, ‘রাতে আমাদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এরপর পরীক্ষাও স্থগিত করে সরকার। তখন আমরা পিছিয়ে আসি। এরপরেও আমাদের কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু শিক্ষা সচিব প্রত্যাহারের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবাই সচিবালয়ের সামনে থেকে চলে যায়। এরপর কারা লাঠিসোটা নিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করে এবং গাড়ি ভাঙচুর করে তা জানা নেই। এ ছাড়া পুলিশের সঙ্গে কারা সংঘর্ষে জড়িয়েছে তাও জানা নেই। এরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে আসছে। এদের প্রতিহত করা দরকার।’

আন্দোলনের ধরণ দেখে সাধারণ মানুষদের অনেকেই বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ব্যানারে যুবকরা কারা। তাদের হাতে লাঠি কেন? পুলিশ তো শুরু থেকেই তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন। পুলিশ আগ বাড়িয়ে তাদের কিছুই বলেনি। তাহলে তারা সচিবালয়ের মূল গেট ভাঙ্গল কেন? আবার ভেতরে প্রবেশ করে সরকারি গাড়িগুলো ভাঙচুর চালালেন কেন? আসলে তারা কারা এবং কি বা চান তারা?’

এদিকে সচিবালয়ের সামনে থেকে পুলিশ বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে। আটকের সময় তারা বলেছিল, ‘ দোকানের শ্রমিক তারা। কিন্তু পরে তারা স্বীকার করেছে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মী তারা। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দামের ডাকে সারা দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতেই তারা সচিবালয়ের সামনে লাঠিসোঁটা নিয়ে যোগ দেয় এবং সংঘর্ষে জড়ায়।’

পুলিশের ধারণা, রাষ্ট্রীয় শোক চলছে ঠিক সেদিনই পরিবেশ নষ্ট করতেই একটি নিষিদ্ধ দলের নেতাকর্মীরা সুযোগ নিয়ে ঝামেলা তৈরি করতে এসেছিল। তাদের বেশিরভাগই নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

জানতে চাইলে রমনা বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, ‘পুলিশ শুরু থেকে কিছুই বলেনি। এরপরেও শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক সচিবালয়ে তা-ব চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও সেনা সদস্যরা দুর্বৃত্তদের সরিয়ে দিয়েছে। বেশ কয়েকজন আটক রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।